ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

জিআই পণ্য হতে পারে টাঙ্গাইল শাড়ি

বেলাল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১২, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৭:০৩, ১৬ জানুয়ারি ২০২৪
জিআই পণ্য হতে পারে টাঙ্গাইল শাড়ি

বাংলাদেশ বঙ্গবেসিন খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ার নদী বিধৌত ছোট্ট একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটিতে সবুজের গালিচা বিশ্ববাসীকে জানান দিয়ে যায় তার উর্বরতার ইতিহাস। এখানে রেশম পোকার পুচ্ছে হাসে ঝলমলে সিল্ক, জামদানি, কৃষক মাঠে সোনা ফলায়, নদী বক্ষে ভাসে রূপালী ইলিশ, মৃত্তিকা রূপ দেয় বাসন-ভূষণ আর রসনা ভেজায় অমৃতসম রসালো ফজলি।

এসব গুণধারী সামগ্রীই তার আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল আজ বিশ্ব দরবারে। বলতে চাচ্ছি, আমার দেশের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের কথা। এ যাবৎ ২১টি পণ্য জিআই সনদ পেলেও আরও শতাধিক পণ্য যে  জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেটরের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হবে তা বলা অত্যুক্তি মনে করছি না। ওপার বাংলায় যদি ১৯৯৯ সাল থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে ৪১৭টি পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে দাঁড় করাতে পারে, তাহলে এপারের আবহাওয়া ও জলবায়ুও তার অনুগামী হবে এটাই আশাব্যঞ্জক। মূল প্রতিবন্ধকতা শুধু  আমাদের অনুসন্ধিৎসু চাহনির অপ্রতুলতা।

গত বছর ৬ ফেব্রুয়ারি গিয়েছিলাম টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানাধীন বল্লা বাজার সংলগ্ন টেঙ্গুরিয়া গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের অধীনস্ত কালিহাতি সার্ভিস সেন্টারে। এ অঞ্চলের তাঁতিদের সমস্যা সমাধানে ‘ইস্টাবলিশমেন্ট অব ফ্রি হ্যান্ডলুম সার্ভিস সেন্টার ইন ডিফরেন্ট লুম ইনটেনসিভ এরিয়া’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এক একর জমির উপর গড়ে উঠে এই সার্ভিস সেন্টারটি।

সেখানে কর্তব্যরত ম্যানেজার (অপারেশন) মো. মনজুরুল ইসলামের কথা হয়। তার ভাষ্যমতে টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই পণ্যের তালিকায় স্থান পাওয়ার যৌক্তিকতা অত্যধিক। কেননা, টাঙ্গাইল শাড়ির একটি সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস রয়েছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো একটি কুটির শিল্প। বৃটিশ যুগ থেকেই শাড়ি বুননের ইতিহাস থাকলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এর ব্যাপক প্রসার হয়। এখানকার সবচেয়ে পুরোনো তাঁতি সম্প্রদায় হলো, পাথরাইলের বসাক সম্প্রদায়। তবে ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতিদের বংশধররাই মূলত টাঙ্গাইলের পুরাতন তাঁতি বা কারিগর।

তিনি জানান, টাঙ্গাইল থেকে অনেক তাঁতি ওপার বাংলায় চলে যান এবং সেখানে টাঙ্গাইল শাড়ির আদলে অনেক শাড়ি তৈরি করছেন। আর তা টাঙ্গাইল শাড়ি নামেই বিক্রয় করা হচ্ছে। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের ঢাকাতে যেমন শাড়ি তৈরি হতো, তেমনি তৈরি হতো মুর্শিদাবাদেও।

মনজুরুল জানান, পূর্বে টাঙ্গাইল শাড়ির সুতা তৈরি করা হতো দেশীয় তুলা থেকে। সে সময় কুমিল্লা কটন বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। বর্তমানে কটনের সঙ্গে যোগ হয়েছে সিল্ক, পলেস্টার, জরি, জুট ইত্যাদি। বাংলাদেশে তুলা চাষের জন্য ঝিনাইদহ জেলা শীর্ষস্থানে অবস্থান করলেও বর্তমানে পাহাড়ী অঞ্চলেও তুলার চাষাবাদ হচ্ছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আমাদের চাহিদার ১.৫-২ শতাংশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। আর বাকি চাহিদা পূরণের জন্য বিদেশের দিকে ছুটতে হয়। তুলা বা সুতা আমদানি করে শাড়ি তৈরি করতে তা অনেকটাই ব্যয়বহুল। যার প্রভাব পড়ে শাড়ির উপর। ফলে টাঙ্গাইল শাড়িতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে বিভিন্ন ধরনের সুতা। একসময় বল্লা টু রামপুর রোডে প্রচুর পরিমাণে এই রেশম বা গুটি গাছ ছিল। যা তুঁত গাছ নামে পরিচিত।

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির সমৃদ্ধ ইতিহাস ঘাটলে এর আলাদা একটা কদর করতে ইচ্ছে করবে। এর প্রস্তুত প্রক্রিয়া, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সহজলভ্যতা, গুণগত মান আর আবেদনময়ী রং ও ডিজাইন তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। এ সম্পর্কে প্রায় সবাই অবগত আছেন।

শাড়ি ও নারী যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে বাঙালির সংস্কৃতির সাথে। আর আবহমান গ্রাম-বাংলার চিরচেনা দেহাবরণ হলো টাঙ্গাইলের শাড়ি। এই টাঙ্গাইলের শাড়ির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই এই ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি নারীর প্রেমময় দেহাবরণ হিসেবে শাড়ি তৈরি করা হতো। তৎকালীন কোলকাতা ছিল শাড়ির বাজারের জন্য প্রসিদ্ধ একটি শহর। তাই টাঙ্গাইলে তৈরি হলেও দেশ বিভাগের আগে টাঙ্গাইল শাড়ির হাট বসত কোলকাতায়। বর্তমান টাঙ্গাইল তার প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। তখন অবশ্য এর নাম টাঙ্গাইল ছিলো না, আটিয়া নামে পরিচিত ছিলো।

বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটকদের লেখনীতেও সন্ধান মেলে টাঙ্গাইল শাড়ির কথা। যাতে ভৌগোলিক নির্দেশকের আলামত সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর  ভ্রমণ কাহিনীতেও উঠে এসেছে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের কথা। জেমস টেলর মির্জাপুর উপজেলার তুলার কথা ব্যক্ত করেছেন। সেখানে বাপ্তা, হাম্মাম ও পাঁচ মিশালী সুতার কথা রয়েছে।

তাঁত শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে টাঙ্গাইলের সফট্ সিল্ক ও কটন শাড়ির মধ্য দিয়ে। যেগুলো যুগ যুগ ধরে এখনো চলে আসছে। বলাই বাহুল্য যে, সুতি শাড়ির জন্য টাঙ্গাইল শাড়ির জুড়ি মেলা ভার। সফট্ সিল্ক তো আছেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক সময় মসলিনও তৈরি হতো এখানে।

টাঙ্গাইল শাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো শাড়ির পাড়। অর্থাৎ কিনারার সুনিপুণ শৈল্পিক কারুকাজ, যা শাড়ি প্রেমী নারীদের বিমোহিত করে তোলে। জামদানি শাড়ি ব্যতীত টাঙ্গাইল শাড়ির প্রধান আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে শাড়ির পাড়।

প্রবাসী বাঙালিদের মাঝেও টাঙ্গাইল শাড়ির প্রেমময় আবেদন কোনো অংশে কম নয়। ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্য প্রাচ্যের অনেক দেশেই এখন অনলাইনের কল্যাণে পৌঁছে যাচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়ি।

টাঙ্গাইলের সুখ্যাতি স্বদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আজ বিশ্বব্যাপী। এভাবেই বিশ্বময় ছড়িয়ে যাক দেশের সুনাম। বাংলাকে চিনুক সৌন্দর্যের আবরণে আর টাঙ্গাইল শাড়ি স্বীকৃতি পাক জিআই পণ্য হিসেবে।

(লেখক: তরুণ উদ্যোক্তা এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী, এমবিএ (ম্যানেজমেন্ট), সরকারি সা'দত কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল।)

/মেহেদী/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়