ঢাকা     শনিবার   ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২৩ ১৪৩১

আমরা ভুলে যাই কী করে?

মামুন রশীদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১০:২৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আমরা ভুলে যাই কী করে?

‘প্রধান মুন্সি চিত্রগুপ্ত অচিরাৎ গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়া বলিলেন, ‘ভগবন, অদ্য পি, এন্ড ও কোম্পানির স্টীমারে ভীয়া ব্রিন্ডিসি একখানি সরকারী চিটি এবং সমীরণ যানে একখানি বেনামি দরখাস্ত প্রাপ্ত হইয়াছি; উভয়ই বঙ্গদেশ হইতে প্রেরিত এবং উভয়ই ‘জরুরি শব্দাঙ্কিত’।’

উদ্ধৃত বাক্যটি দীনবন্ধু মিত্রের ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ গল্প থেকে নেওয়া। এখানে পুরো বাক্যটি অপ্রাসঙ্গিক হলেও, আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই একটি শব্দের দিকে। ‘সমীরণ যান’- যাতে চেপে একটি বেনামি দরখাস্ত এসেছে। বঙ্গদেশ থেকে এমন বহু দরখাস্ত প্রেরিত হয়, আসে কিন্তু ‘সমীরণ যান’ শব্দটির ব্যবহার দীনবন্ধু মিত্রের এই গল্পটি ছাড়া আর কোথাও নেই। ‘সমীরণ যান’-এর সমীরণ অর্থ বায়ু বা বাতাস। সেখানে ভেসে যে যানবাহন চলে- তাই সমীরণ যান। যা আজকের উড়োজাহাজ, এরোপ্লেন, বিমান বা প্লেন। আমরা পরের শব্দগুলোই বেশি উচ্চারণ করি। আর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ ‘প্লেন’। কিন্তু ‘সমীরণ যান’ শব্দটি কোথাও নেই। নেই, কারণ এই পরিভাষাটি আমরা গ্রহণ করিনি। করতে পারিনি আমাদের অক্ষমতা থেকে, আমাদের অজ্ঞতা থেকে। 

বাংলায় পরিভাষা তৈরিতে সবেচেয়ে এগিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি একাই অসংখ্য শব্দের পরিভাষা তৈরি করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘মোবাইল ফোনে’র পরিভাষা তৈরি করেছিলেন ‘মুঠোফোন’। তিনি একটি স্বতন্ত্র কাব্যগ্রন্থও রচনা করেন ‘মুঠোফোনের কাব্য’ শিরোনামে। কিন্তু সেই শব্দটিকেও আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের কাছে মুঠোফোনের চেয়ে, মোবাইল ফোন শব্দটিই বেশি আদরণীয় ও গ্রহণীয় হয়ে রয়েছে।

আরো পড়ুন:

ভাষা প্রবাহমান, একথা আমাদের জানা। আমরা জানি, যে ভাষার গ্রহণ ক্ষমতা যতো বেশি, সে ভাষা তত বেশি প্রবহমান। সেই প্রবহমানতার রথ দেখিয়েই বাংলা ভাষায় দেদারছে ঢুকে পড়ছে বিদেশি শব্দ, যত্রতত্র ব্যবহার হচ্ছে বিদেশি শব্দ। একসময় বিদেশি শব্দের পরিভাষা তৈরির কাজটি সচেতন বা অবচেতন ভাবেও করতেন কবি-সাহিত্যিক, লেখক এবং সাংবাদিকরা। কিন্তু আজ যেন সে দিন ফুরিয়েছে। আজ আর আমরা পরিভাষা তৈরিতে উৎসাহী নই। বরং হালে আমাদের মাঝে এমন প্রবণতাই বেশি, যেখানে লেখায় দুড়দাম বিদেশি শব্দ ঢুকিয়ে দিলেই মিলছে বাহাবা। যে শব্দটির পরিভাষা রয়েছে, তাও ব্যবহারে আমাদের অনাগ্রহ। বরং লেখায়, বলায় হরহামেশা বিদেশি শব্দ ব্যবহারের মধ্যেই যেন ফুটে উঠছে মুন্সিয়ানা। অথচ ভাষার কারিগর কবি-লেখক। তারা ভাষার রক্ষক। কিন্তু তাদের হাত ধরেই যদি ভাষা ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে, তাহলে সেই সাহিত্য দাঁড়িয়ে থাকে কিসের ওপর? আমরা শেকড়ের সন্ধান করি, কিন্তু আমাদের শুরুই যেন হয় শেকড় কাঁটার মাধ্যমে। 

মাতৃভাষা আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রতীক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয়তাবোধ পুষ্ট হয়েছে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছি। অথচ ভাষা আন্দোলনের দেশেই অবলীলায় বিনা প্রয়োজনে নানান ভাষা থেকে শব্দরা আসছে। অনেক শব্দের পরিভাষা আমাদের আছে, আবার বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক শব্দের পরিভাষা নেই। যে শব্দগুলোর পরিভাষা নেই, সেগুলোও চাইলেই করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। রাষ্ট্র যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে পরিভাষার প্রচার সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কতোটা আন্তরিক, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে  বলে অনেকের অভিমত। আমরা উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলছি, এ ক্ষেত্রে ‘মেট্রোরেল’, ‘কর্নফুলী টানেল’ এবং ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই তিনটি স্থাপনা আমাদের গর্ব। কিন্তু কি আশ্চর্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা এ তিনটি স্থাপনার কোনোটিরই বাংলা প্রতিশব্দ চালু করতে উদ্যোগী হইনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাদের মতোই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। বহুভাষাভাষী ভারতের সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা নেই। তবে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয় হিন্দি এবং ইংরেজি। 

রাষ্ট্রভাষা না হয়েও হিন্দি এবং ইংরেজির দাপটে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ছে- এমন অভিযোগ তো হরহামেশাই। অথচ সেখানেও বাংলাভাষার পৃষ্টপোষকতা রয়েছে। ‘কলকাতা মেট্রো’ রেলের বয়স, আমাদের অনেক আগের। মেট্রোরেলে আগাম টিকিট, যা র‌্যাপিড পাস, বা এমআরটি হিসেবে চিহ্নিত, আমাদের মেট্রোরেলের সেই আগাম টিকেটের গায়ে কোথাও বাংলা ভাষার ছাপ নেই। অথচ গুগল করলেই দেখা যায় কলকাতা মেট্রোর র‌্যাপিড পাস। সেখানে ইংরেজি বর্ণমালার তুলনায় ছোট করে হলেও বাংলার স্থান রয়েছে। স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘মেট্রো আমাদের গর্ব’। এমনকি আমরা যখন, আমাদের অগ্নিনির্বাপক সংস্থা, যাকে একসময় দমকল বাহিনী হিসেবেও চিনেছি, সেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি থেকেও বাংলাকে হটিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। আমাদের সড়ক পরিবহন সংস্থাকে চিহ্নিত করছি বিআরটিসি, সড়কে চালক এবং গাড়ির সনদ দেওয়ার প্রতিষ্ঠানকে নামাঙ্কিত করছি বিআরটিএ নামে। এসব আলামত কিসের? 

আমাদের একশ’র বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার সনদ দিচ্ছে। আমরা উচ্চশিক্ষায় বাংলায় ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিচ্ছি, সভা-সমিতিতে। অথচ আমাদের শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে বাংলা নাম রয়েছে এমন সংখ্যা তো হাতের আঙুলেই গোনা যাবে। উদাহরণ না বাড়িয়েই বলা যায়, ভাষাকে রক্ষা করার জন্য যে পরিবেশ, তা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আমাদের যে সমস্যা তা হয়তো আমরা চিহ্নিত করতে পারছি না। আমাদের মধ্যে ভাষার প্রতি ভালোবাসা আছে। কিন্তু তারপরও ভাষাকে রক্ষা করা, আরও সমৃদ্ধ করা, ভাষার ঐহিত্য রক্ষায় আন্তরিকতার অভাবই যেন প্রতি পদে। অথচ এমন তো হবার কথা নয়। 

আজকে গোটা দুনিয়ার আগ্রহ ল্যাতিন আমেরিকার সাহিত্যে। খুব সূক্ষ্মভাবে না দেখেও, মোটাদাগেও যদি দেখা যায়, তাহলেও স্পষ্ট সেখানের সাহিত্যের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিষয়টি। ইউরোপ থেকে স্বাধীন হয়েছে ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলো। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত, তাদের ভেতরে যে আধুনিকতা, জাতীয়তার ধারণা তা গড়ে ওঠে ইউরোপকে দেখে।  কিন্তু স্বাধীনতার পর, রাজনৈতিক সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাহিত্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় হয়ে এসেছে তা হলো জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছে, শূন্য থেকে। কারণ, তারা পূর্বের যে জাতীয়তাবোধ, ইউরোপের দেখানো যে জাতীয়তা তা অস্বীকার করেছে। তাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছে স্বদেশিকতার ভেতর দিয়ে। এ ক্ষেত্রে সাহিত্য বড় ভূমিকা রেখেছে। সাহিত্যে নানাভাবে, হয়তো কখনো কখনো মাত্র কয়েকটি শব্দে, মাটিগন্ধা, সেই অকৃত্রিম আবহকে রপ্ত করা হয়েছে। সাহিত্যকে মাধ্যম করা হয়েছে জাতীয়তা বোধের। তাদের এই জাতীয়তা বোধের সঙ্গে আমাদের জাতীয়তা বোধের পার্থক্যও স্পষ্ট। তাদের জাতীয়তাবোধে, স্বাধীনতার প্রশ্নে ভাষা বড় অনুষঙ্গ ছিল না। কারণ, কয়েকশ বছরের উপনিবেশিক শাসনে এ অঞ্চলের নিজস্ব ভাষাই হারিয়ে গেছে। সেখানে বড় স্থান দখল করেছে স্প্যানিশ। যে ভাষায় কথা বলে আমেরিকা মহাদেশের প্রায় কুড়িটি দেশের মানুষ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট ল্যাতিন আমেরিকার জাতীয়তাবোধে যেখানে ভাষার প্রশ্নটি গুরুত্ব পায়নি, সেখানে আমাদের বড় এবং প্রধান অনুষঙ্গ ভাষা। আর এই ভাষাকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত জাতীয়তাবোধই আমাদের প্রেরণা। কিন্তু সেই পথে থেকে কি আমরা আধুনিকতার নামে সরে যেতে বসেছি? আমাদের ভেতর থেকে কি জাতীয়তা বোধের ধরন পাল্টে যেতে বসেছে? 

না হলে, যেখানে ভাষাকে সামনে রেখে আমাদের সেতুবন্ধন, জেগে ওঠা, সেই ভাষাকেই কি করে বারবার আমরা আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু করে তুলছি? ভাষাকে মাধ্যম করে যেখানে ল্যাতিন আমেরিকার ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’কে অতিক্রম করছে তাদের সাহিত্য, ভিত শক্ত করছে জাতীয়তা বোধের। যে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের সাংবাদিক-সাহিত্যিকরা। সেখানে আমরা কেন বিমুখ? আমরা কেন বিদেশি শব্দ আত্মস্থ করতে উন্মুখ? ‘নানান দেশের নানান ভাষা৷/বিনে স্বদেশী ভাষা,/পুরে কি আশা’ কবি রামনিধি গুপ্তের এই জিজ্ঞাসাই বা আমরা ভুলে যাই কি করে? 

মামুন রশীদ : কবি, সাংবাদিক
 

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়