ঢাকা     মঙ্গলবার   ২১ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৭ ১৪৩১

উচ্চহারে তামাক কর বৃদ্ধিতে রাজস্ব বাড়বে, কমবে মৃত্যু

ইকবাল মাসুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ১০ মে ২০২৪  
উচ্চহারে তামাক কর বৃদ্ধিতে রাজস্ব বাড়বে, কমবে মৃত্যু

বিশ্বজুড়ে মানব মৃত্যুর প্রতিরোধযোগ্য প্রধান আটটি কারণের মধ্যে ছয়টির সাথেই তামাকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) রিপোর্ট মোতাবেক, তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যায় তামাকের কারণে। 

তামাকসেবীদের ভিতর তামাকজনিত বিভিন্ন রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি এবং তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি। এ কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে।

দেশে প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ৩৫.৩ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে, সংখ্যার হিসেবে যা সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। আবার ১৩ থেকে ১৫ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্করাও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার থেকে পিছিয়ে নেই। শতকরা হিসেবে সেটিও প্রায় ৬.৯ শতাংশ।  

ধূমপান করে না কিন্তু পরোক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতির শিকার হয় এমন মানুষের সংখ্যা সামগ্রিকভাবে মোট ধূমপায়ীর সংখ্যার চেয়েও বেশি এবং সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় ৪ কোটি। অথচ এটি নিয়ে আমরা ততটা উদ্বিগ্ন নই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পৃথিবীতে সর্বাধিক তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এ দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম, বিড়ি আরও সস্তা। প্রতিবছর বাজেটে তামাক পণ্যের দাম বাড়ানোর কথা বলা হলেও বেশীরভাগ সিগারেটের দাম প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে অথবা সামান্য বেড়েছে। ফলে বর্তমানে সিগারেট অধিক সহজলভ্য হয়ে পড়ছে। তাই ট্যাক্স বৃদ্ধির মাধ্যমে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা জরুরি। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তামাক কর কাঠামো পরিবর্তন করা জরুরি। 

বাংলাদেশে বৈশিষ্ট্য ও ব্র্যান্ড ভেদে সিগারেটে বহুস্তরবিশিষ্ট করকাঠামো চালু থাকায় বাজারে সিগারেট অত্যন্ত সস্তা এবং সহজলভ্য। ফলে ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার পরিবর্তে ভোক্তা তুলনামূলক কম দামে সিগারেট বেছে নিতে পারছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিগারেটের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে প্রায় একইরকম রয়েছে। কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক পণ্যের সহজলভ্যতা অবশ্যই কমাতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে সিগারেটের ক্ষেত্রে প্রস্তাবনা হিসেবে বলা যেতে পারে, নিম্নস্তরে ৬৩ শতাংশ এবং মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে যথাক্রমে ৬৫ শতাংশ করভারসহ মূল্যস্তর ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করা। নিম্নস্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৬০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৭.৪০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। মধ্যম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৮০ টাকা নির্ধারণ করে ৬৪.৮০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। উচ্চ স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে ১০৫.৩০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক করা এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে ১৩৭.৭০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। 

আগামী অর্থ বছরে সুপারিশ অনুযায়ী বিদ্যমান কর ব্যবস্থা সংস্কার করলে ধূমপান কমবে, জীবন বাঁচবে এবং রাজস্ব আয় বাড়বে। এছাড়া সিগারেটের ব্যবহার প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কমবে। প্রায় ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে এবং ১০ লক্ষাধিক তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে; দীর্ঘমেয়াদে ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৯৬৮ প্রপ্তবয়স্ক এবং ৫ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৬ তরুণের অকাল মৃত্যুরোধ করা সম্ভব হবে।

এ ছাড়া নিম্নস্তরে সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি তুলনামূলক স্বল্প আয়ের মানুষকে ধূমপান ছাড়তে উৎসাহিত করবে এবং একই সাথে উচ্চ স্তরে সিগারেটের দাম বাড়ানো হলে ধূমপায়ীদের সস্তা ব্রান্ড পছন্দের সামর্থ্য সীমিত হবে এবং বিড়ি এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে এসব পণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করবে এবং একইসাথে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হবে অর্থাৎ ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। 

এ ছাড়া তামাক নিয়ন্ত্রণে আরো কিছু বিষয়ে দৃষ্টি রাখলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব হবে। সেগুলো হলো- তামাকপণ্যের সহজলভ্যতা হ্রাস করতে মূল্যস্ফীতি এবং আয় বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। করারোপ প্রক্রিয়া সহজ করতে তামাকপণ্যের মধ্যে বিদ্যমান বিভাজন তুলে দিতে হবে। সকল ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য উৎপাদনকারীকে করজালের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। পর্যায়ক্রমে সকল তামাকপণ্য অভিন্ন পরিমাণে (শলাকা সংখ্যা এবং ওজন) প্যাকেট/কৌটায় বাজারজাত করা। একটি সহজ এবং কার্যকর তামাক কর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন (৫ বছর মেয়াদি) করা, যা তামাকের ব্যবহার হ্রাস এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে এবং তামাকপণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহাল করতে হবে।

প্রস্তাবিত কর সুপারিশসমূহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের তামাক করনীতিকে বিশ্বের সর্বোত্তম করনীতিগুলোর কাতারে নিয়ে যাবে। টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট এবং অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক কর্মপরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। আর এই লক্ষ্য অর্জনে তামাকপণ্যে কর বৃদ্ধি হচ্ছে একটি সাশ্রয়ী পদক্ষেপ। একইসাথে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জনে অন্যতম কার্যকর উপায় তামাকপণ্যে কর বৃদ্ধি। 

প্রস্তাবিত তামাক কর সংস্কারের ফলে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে যা দিয়ে সরকার দেশের স্বাস্থ্যখাত ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারসমূহে অর্থায়ন করতে পারবে। এটি সরকার এবং জনগণ উভয়ের জন্যই লাভজনক।

লেখক: পরিচালক, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টর, ঢাকা আহছানিয়া মিশন 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়