ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

রাঙ্গাবালী: সম্ভাবনাময় এক জনপদ

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ৯ এপ্রিল ২০২২  
রাঙ্গাবালী: সম্ভাবনাময় এক জনপদ

একসময় বঙ্গোপসাগরের বুকে একটি লাল বালুচর জেগেছিল। প্রকৃতি তাকে সাজিয়েছিল নিজের মতো করে। জনশ্রুতি রয়েছে ১৭৮৪ সালে আরাকান (মায়ানমার) থেকে কয়েকটি রাখাইন পরিবার পালিয়ে এসে সেখানে প্রথম বসতী স্থাপন করে। সেই লাল বালুময় দ্বীপটির নাম রাঙ্গাবালী। অপরূপ সৌন্দর্য্যের এক লীলাভূমি রাঙ্গাবালী।

পটুয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণে সাগর সান্নিধ্যের নৈসর্গিক ভূখণ্ড রাঙ্গাবালী। যার উত্তরে রয়েছে চালিতাবুনিয়া, আগুনমুখা নদী ও চরবিশ্বাস, পশ্চিমে রামনাবাদ চ্যানেল ও কলাপাড়া উপজেলা, পূর্বে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা, চর কুকরি-মুকরি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। 

এক সময় বিচ্ছিন্ন এই অঞ্চলটি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত ছিল। ২০১২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গলাচিপা উপজেলা থেকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে নদীবেষ্টিত এই দ্বীপাঞ্চল একটি স্বতন্ত্র উপজেলার স্বীকৃতি পায়। তখন বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে ছিল না স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, আর্থ- সামাজিক অবকাঠামো, যোগাযোগের সুব্যবস্থাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা। কিন্তু বর্তমানে এসবের অনেক কিছুই দৃশ্যমান। ফলে, রাঙ্গাবালী ধীরে ধীরে আধুনিক ও উন্নত নাগরিক সুবিধা পেতে শুরু করেছে। 
ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই উপজেলার আয়তন ৪৭০ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলাটিতে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস। কৃষি এবং মৎস এই অঞ্চলের উন্নতির মূল চালিকাশক্তি।

রাঙ্গাবালীর তরমুজের দেশব্যাপী ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এ বছর রাঙ্গাবালীতে উৎপাদিত প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা মূল্যের তরমুজ সারাদেশে সরবরাহ করা হয়েছে। এ জনপদের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ সমুদ্র, নদী ও খালবিলে মাছ আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে এসব কিছু ছাপিয়ে রাঙ্গাবালীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই ভূখণ্ডটিকে এক অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে। 

একপাশে সমুদ্র, একপাশে নদী, নদীর পাশে ম্যানগ্রোভ বন, বনে বনে পাখ-পাখালির দুরন্তপনা, হরিণের ছুটে চলা, সব কিছু মিলিয়ে প্রকৃতি যেন তার অপরূপ রঙ দিয়ে সাজিয়েছে রাঙ্গাবালী দ্বীপ। বাংলার আবহমান সংস্কৃতির এক প্রবাহমান প্রতিচ্ছবি ছড়িয়ে রয়েছে এ জনপদের সীমানাজুড়ে। এখানে রয়েছে নানা আকারের ছইলা, কেওরা, গেওয়া, বাইন গোলপাতা, হারগুজি, তাম্বুরা কাটার ঝোপঝাড়। বক, সারস, শামুকখোল, মদনটাকরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে আশ্রয় নেয় বড় গাছের মগডালে। আর ঝোপগুলো ডাহুক, কোড়াসহ নাম না জানা পাখিদের অভয়ারণ্য। গাছে গাছে সেসব পাখিরা আপনমনে সুর দিয়ে যায়।

এখানে ভাটার সময় সাগর তৈরি করে দেয় সীমাহীন খেলার মাঠ। বনের বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে হেলে পড়ে সূর্যের হাসি। বিকেলে সাগর পাড়ের বিশাল মাঠে মহিষ বিচরণ করে। শেষ বিকেলেই বেশি দেখা যায় লাল কাকড়ার ছুটোছুটি। এ যেন সাগরতীরের প্রাকৃতিক এক অসাধারণ দৃশ্য!

রাঙ্গাবালীতে রয়েছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বাস। কথিত আছে, রাখাইনরা এখানে এসে পানির সন্ধানে একাধিক কূপ খনন করে। যেখানে সুস্বাদু মিঠাপানির সন্ধান পায়, সেখানে তারা বসবাস শুরু করে। তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। রাখাইনদের তৈরি বিভিন্ন পিঠা, বিন্নি ভাত ও নবান্ন অনুষ্ঠানের চিঁড়া খুবই মুখরোচক। এভাবেই নানা বৈচিত্র্যের শোভা ছড়িয়েছে এই জনপদে। 

দেশের উপকূলীয় সীমারেখার প্রত্যন্ত এই অঞ্চল তার রূপ ছড়িয়েছে নিজ মহিমায়। রাঙ্গাবালী দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে জাহাজমারা, চর তুফানিয়া, কলাগাছিয়া চর ও সোনার চর। এই চরগুলোতে রয়েছে প্রচুর লাল কাঁকড়া। উপজেলার সর্বদক্ষিণে সোনারচর অবস্থিত। এই স্থানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এ অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন মৌ চাষীদের মধু আহরণের অভয়ারণ্য।

বর্তমানে উপজেলায় বেশ কিছু রাস্তাঘাট, ব্রিজ নির্মাণসহ রাঙ্গাবালীর সর্বত্র বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে পর্যটকদের সুবিধার্থে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মানোন্নয়ন ও যাতায়াতের জন্য আগুনমুখা নদীতে ফেরি সেবাসহ আরও কিছু রাস্তাঘাট ও ব্রিজ নির্মাণ করা হলে রাঙ্গাবালী হতে পারে দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের তীর্থস্থান। এছাড়া এলাকাটি নবগঠিত পায়রা বন্দরের দক্ষিণসংলগ্ন। তাই সমুদ্রের নিকটবর্তী উপজেলা রাঙ্গাবালীকে রপ্তানিমুখী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হলে দেশ উপকৃত হবে।  

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ