ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ফিরে ফিরে দেখছিলাম অপরূপ অ‌্যাডামস পিক

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩০, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিরে ফিরে দেখছিলাম অপরূপ অ‌্যাডামস পিক

গাছের ডালে ডালে মৌচাক। চারদিকে মৌমাছির গুন গুন। বাতাসে সুগন্ধি আবহ। ঝিরি ঝিরি হাওয়া। রোদের প্রখর উত্তাপ। ঝরনার একটানা কলধ্বনি। চাবাগানের ছায়াগাছে পাখির কাকলী। এসব নিয়ে অ‌্যাডামস পিক থেকে নামছিলাম।

মৌাছিদের রাজ্য থেকে ফেরার পালা। একপাশে কচি চায়ের পাতা। অন্যপাশে সুষম খাদ। মাঝখানে রাঙ্গামাটির পথ, নিচে বয়ে গেছে ক্রমশ। ওই পথ দিয়েই নামছিলাম আদম পাহাড় থেকে।

শেষ বেলায় ঘটলো আরেক কাণ্ড। সাংবাদিক ইমন আমাদের সঙ্গে নামছিলেন না। কেন? সে নাকি আদম পাহাড়ের চূড়ায় যাবেই! বুঝলাম না কাহিনি। যে লোকটা রাতের বেলা সামান্য একটু দূর উঠেই ফেরত গেল, সে-ই কি না বলছিল চূড়ায় উঠবেই! দিনের বেলাতে! এই সিরিজের অনেক জায়গায় বলেছি- রাতের বেলা অন্ধকারে হাঁটলে কষ্ট কম। কতদূর উঠলাম বোঝা যায় না। তাই উঠা কিঞ্চিৎ সহজ। দিনের বেলা ঠাহর করা যায় কতদূর উঠলাম আর কতদূর বাকি, তাই কষ্টটা বেশি। অনেক সময় হতোদ্যম হতে হয়। তাহলে এই লোক কীভাবে তখন অ‌্যাডামস পিকে যাবার সাহস করছিল?

সমস্যা হলো আরেকটা। পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের হোটেল। সেখানে ড্রাইভার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। নেমেই যত তড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হতে হবে কলম্বো। গাড়ি ভাড়া করা। সুতরাং রাত বারটার  আগেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে। তার মানে দুপুরের মধ্যেই রওনা হতে হবে। ইমন যেহেতু আমাদের সঙ্গে এসেছেন- যাবেনও আমাদের সঙ্গেই। কিন্তু তখন যদি সে অ‌্যাডামস পিক উঠতে যায়, তার নামতে নামতে সন্ধ্যা। কলম্বো আর সেদিন যাওয়া হবে না। ওদিক ফিরোজ, মিলটন, আমাকে ফিরতে হবেই। পরের দিন ক্রিকেট ম্যাচ। মাঠে থাকতে হবেই।

অনেক বোঝানের চেষ্টা করলাম ইমনকে। ফেরানোর চেষ্টা বিফলে। সে যাবেই। আমরাও তাকে যেতে দেব না। কারণ তার জন্যে আমাদের দেরি হয়ে যাবে। শেষে কথা দিলো ইমন- বেশি দূরে যাবে না। ভালো একটা লুকিং পয়েন্ট থেকে ছবি নিয়ে, ভিডিও নিয়ে ফিরে আসবে।

আদম পাহাড়ে উঠার আগের দিন সন্ধ্যায় একটা মন্দিরে গিয়েছিলাম। অনেকটা বড় বৌদ্ধ মন্দির। ওর পশ্চিম পাশেই ছিল একটা টিলা। পুরো টিলাজুড়ে ছিল চা বাগান। সবুজের তুলনা করা হলে চা বাগানের চেয়ে সৌন্দর্য আর কোথাও নেই। নামতে নামতে সেই চা বাগান অব্দি চলে গিয়েছিলাম। তার মানে পাহাড় থেমে নেমে এসেছিলাম। মিনিট দশেকের পথ বাকি ছিল তখনো।

বড় গেট দিয়ে নিচে নামার সময় দেখেছিলাম পাহাড়ের দক্ষিণ থেকে উত্তরে অনেকগুলো ঝরনা নেমে গিয়েছিল। ছোট ছোট ঝরনাগুলো একত্রিত হয়ে সেই নদীতে গিয়ে মিশেছে; ওই যে কিশোর ডানো যেটাকে বলেছিলো রিভার। অসংখ্য দোকানপাট ছিল দুপাশে। সবগুলোই বন্ধ।

যাহোক চা বাগান আর মন্দির পেরিয়ে চলে গেলাম যাত্রা শুরুর প্রান্তে। ওই নদীটার দক্ষিণ পাড়ে, ঠিক যেখান থেকে আদম পাহাড়ে উঠা শুরু হয়। ওই জায়গাটার একটু নিচে ডানো আর অজন্তার বাবার দোকান কাম রেস্টুরেন্ট। চারপাঁচ লোক বসে খেতে পারে। ওই দোকানে গিয়ে বেঞ্চের উপর বসে পড়লাম।

আমার প্রস্তাব ছিল হোটেল রুমে গিয়ে ফ্রেশ হই। পড়ে নাস্তা খাব। ফিরোজ আর মিলটন বললেন, আগে খেয়ে নিই। খুব খিদে পেয়েছিল। হোটেল কক্ষে গেলে আর বেরোতে মন চাইবে না। শরীর ভীষণ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। কথা সত্য। ঘড়িতে তখন বেলা বারোটা। রাত তিনটার দিকে রওনা হয়েছিলাম। আদম পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিলাম সকাল ৭টার দিকে। নিচে নামলাম বেলা ১২টায়। তার মানে নামতেই তো বেশি সময় লাগল!

একেতো ১২টা বেজে গেছে। অন্যদিকে পাহাড় বাওয়ার মতো কঠিন খাঁটুনি। খিদে খুব লেগেছিল। ডানোর বাবাকে বললাম, রুটি বানাতে থাকেন। লোকাল কলা ছিল। চাঁপা কলার মতো ছোট এবং মিষ্টি। কাঁদি থেকে খুলে সেগুলো খাওয়া শুরু করলাম। ছোট ছোট তরমুজ ছিল। সেগুলো কেটে দিলো। প্লেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেটে চালান হয়ে যাচ্ছিল।

ইমনকে ফোন দিলাম। রুটির অর্ডার দিয়েছি। তাড়াতাড়ি আসেন।

ওকে আসছি ভাই, বলেই ফোন কেটে দিল।

রুটি কতগুলো বানাবো? ডানোর বাবা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম বানাতে থাকেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রুটি রেডি। সবজি আগেই রান্না করা ছিল। আলুর দম। গরম গরম রুটি আর সবজি সমানে গিলতে শুরু করলাম। ডানোর বাবা রুটি ভেজে সারতে পারছিল না। তাওয়া থেকে নামাচ্ছিল  আর সাবাড় হচ্ছিল। কটা রুটি খেলাম মনে নেই।

ওদিকে খেয়াল হলো ইমন তখনো আসেনি। তার জন্যেও তো রুটি দরকার। ফোন দিলাম। ধরে না। আবারো রিং, ধরে না। যাক, আমরা খেয়ে নিই আগে। কি যে মজা লাগছিল। রুটি সবজি! যেন অমৃত!

আবার ফোন দিলাম ইমনকে। ধরল। তাড়াতাড়ি আসেন। আমাদের খাওয়া শেষের দিকে। আপনার রুটি ঠান্ডা হয়ে যাবে। ইমন তখন জানালেন, সে নাস্তা খেয়েছে। আর খাবে না।

ওকে ভালো কথা। আমাদের খাওয়া শেষ। তাড়াতাড়ি চলে আসেন। আমরা হোটেলে যাচ্ছি। ড্রেস চেঞ্জ করেই রওনা হব। দেরি হয় না যেন। তাড়াতাড়ি নামেন।

নাস্তা শেষ করে হোটেলের দিকে ফিরছিলাম। ডানো আর অজান্তাকে নিয়ে যেখানে ক্রিকেট খেলেছিলাম সেই ছোট্ট মাঠটার দিকে তাকালাম। ফাঁকা, কেউ নেই। উঠলাম সেই ব্রিজের ওপর। দুপাশে কুল কুল শব্দে বয়ে চলেছে খস্রোতা জল। পাথরের গায়ে গায়ে শব্দ কুড়াচ্ছিল। পূবের ভাটিতে ও নদী অনেক দূরে মিশে গেছে অজানা জঙ্গলে।

আগের দিন আমরা যখন হোটেলে উঠছিলাম, তখন দেখেছিলাম একটা মেয়ে সটান শুয়ে ছিল বিছানার ওপর। দরজা খোলা ছিল। মেয়েটাকে কেমন বিধ্বস্ত উন্মাষিক মনে হচ্ছিল। হোটেলে ফেরার পর আমাদের অবস্থাও সেরকমই। বিছানার ওপর শুয়ে পড়লাম। শরীরে এতটুকু শক্ত নেই।

মিনিট পাঁচেক চোখ বন্ধ করে রাখার পর কিছুটা স্বস্তি পেলাম। চলে গেলাম ওয়াশরুমে। দাঁত মেজে গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করলাম। কিছুটা ফুরফুরে লাগছিল। সবকিছু গুছিয়ে ব্যাগ রেডি। গাড়িতে উঠব। কিন্তু ইমন কই? ফোন দিচ্ছি। একটাই জবাব আসছি ভাই। আরো মিনিট পাঁচেক পর ফোন দিলাম। তখন বললো, ভাই আমি উপরে যাব! বলে কি?

উত্তর দিলাম, আপনি না আসলে বলেন। আমরা চলে গেলাম। আপনি আজ থাকেন। বাই।

কড়া গলার আলটিমেটাম শুনে ইমন বললেন, ওকে ভাই আসছি।

ঠিক আধা ঘণ্টা পর হন্তদন্ত হয়ে ইমন আসলেন। বললো, ভাই- আরেকটু গেলেই পিকে চলে যেতাম! আপনার জন্য হলো না। ওকে নেক্সট টাইম যাব।

দুপুর একটার দিকে রওনা হলাম। উদ্দেশ্য কলম্বো। নালাথান্নিতে প্রবেশের আগে একটা ঝরনার কথা বলেছিলাম। যেখানে নেমে আমরা ছবি তুলেছিলাম। পাশেই ছিল কিছু সোনামুখী বানরের দল। সেই ঝরনা পার হলাম। পার হলাম হোয়াইট হাউজসহ কিছু হোটেল। পূব দিকে যাচ্ছিলাম। প্রথমে পূবে গিয়ে ঘুরতে হবে উত্তরে। এরপর উত্তর দিক থেকে যেতে হবে সোজা পশ্চিমে। ওটা ছিল বিশাল পর্বতশ্রেণি। ওই এলাকা থেকে বোরোনোর ওই একটাই রাস্তা। তাই ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিলাম কলম্বোর দিকে। ওই পাহাড়ি এলাকা বিখ্যাত চা বাগানের জন্য। শ্রীলঙ্কার আর কোথাও এত চা বাগান নেই। ড্রাইভার জানালেন, ওই অঞ্চলের চা নাকি খুব বিখ্যাত। লালমাটির পথ বেয়ে এঁকে বেঁকে যাচ্ছিল গাড়ি। চা বাগান আর সবুজ বনানী সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিচ্ছিল।

অ‌্যাডামস পিকে যাওয়ার আগে পড়ে সেই অনিন্দ্য সুন্দর লেক। যাকে মাস্কেলিয়া ড্যাম বলেছিলাম। যার আরেক নাম মউসাকেলে বাঁধ। জল আটকে রেখে বিদ্যুৎ তৈরি হয় ওখানে। বাংলাদেশের কাপ্তাই বাঁধের মতো। এই লেকে অনেকগুলো বাঁধ রয়েছে।

বলা চলে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত লেকের একটি এই লেক। এর শোভা অতুলনীয়। নিচে লাল মাটি, জলের রঙ ঘন নীল। পাড়গুলো উজ্জ্বল লালচে। পাশ দিয়ে পাইন গাছ, ফাইন গাছ! লেকটা সামান্য বাঁকা। দুপুরের উজ্জ্বল রোদে ওই বাঁকের ফাঁক দিয়ে দেখা আদম পাহাড়ের চূড়া কেবলই অফুরন্ত মায়া ছড়ায়।

অ‌্যাডামস পিক এবং সংলগ্ন পর্বতশ্রেণিকে বলা হয় বাটারফ্লাই মাউন্টেইন বা প্রজাপতি পর্বত। প্রজাপতির মাথার মতো পিক বা চূড়া। আর এর দুপাশের পর্বতগুলো প্রজাপতির ডানার মতো দেখতে। দূর থেকে মনে হয় ওটা মায়ার পাহাড়। সব ধর্মের অনুসারী, এমনকি যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নন; তাদের জন্যও অ‌্যাডামস পিক স্পেশাল কিছু।

ফিরে যাচ্ছিলাম। ক্রমশঃ দূরে যাচ্ছিলাম। তবু অদৃশ্য কোনো মায়ায় কেবলই ফিরে ফিরে দেখছিলাম- অপরূপ অ‌্যাডামস পিক।

সমাপ্ত




শ্রীলঙ্কা/উদয় হাকিম/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়