ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সেরা কাজটি এখনো করতে পারিনি : মাহফুজুর রহমান খান

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৩, ২২ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেরা কাজটি এখনো করতে পারিনি : মাহফুজুর রহমান খান

মাহফুজুর রহমান খান

অহ নওরোজ : মাহফুজুর রহমান খান। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার। বাংলা সিনেমায় দুর্দান্ত সব সিনেমাটোগ্রাফি উপহার দিয়েছেন তিনি। শখের বশে ক্যামেরা হাতে নিয়েছিলেন এই প্রবীণ সিনেমাটোগ্রাফার। তারপর তা পেশা হিসেবে বেছে নেন।

১৯৭২ সালে আবুল বাশার চুন্নুর ‘কাঁচের স্বর্গ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চিত্রগ্রাহক হিসেবে তার যাত্রা শুরু। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে শতাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি। এ জন্য আজহারুল ইসলাম খানের সহযাত্রী, আখতারুজামানের পোকা মাকড়ের ঘর বসতি, কোহিনূর আক্তার সুচন্দার হাজার বছর ধরে, গোলাম রব্বানী বিপ্লবের বৃত্তের বাইরে, হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, আমার আছে জল ও ঘেটুপুত্র কমলাসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের জন্য নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন মাহফুজুর রহমান।  

সম্প্রতি রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা হয় মাহফুজুর রহমানের। একান্ত এ আলাপচারিতার চুম্বক অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই সাক্ষাৎকার।



রাইজিংবিডি : আপনার ফটোগ্রাফির শুরুটা কিভাবে হলো?
মাহফুজুর রহমান খান: আমি তখন স্কুলে পড়ি। তখন বাড়িতে যখন ঘুরে বেড়াতাম তখন মাঝে মধ্যে আমার কাছে একটি ক্যামেরা থাকত। আমার বাবা আলীগড়ে পড়াশোনা করেছিলেন। বাবার ক্যামেরাটা নিয়েই আমার যাত্রা শুরু। তবে তখন ছবি তুলতাম মূলত শখের বশে।

শখ হিসেবে ছবি তুলতে তুলতে এর মধ্যে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। এর মধ্যে দেখতে পেলাম আমার সব বন্ধুরা ইংল্যান্ড আমেরিকা যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওরা সবাই জুট টেক্সটাইল পড়তে যাচ্ছে। তখন এই জুট টেক্সটাইল বেশ জনপ্রিয় বিষয়। কারণ আমাদের দেশে পাট শিল্পের তখন রমরমা অবস্থা। তো আমি কী করব তা নিয়ে ভাবছি। আমার বাবা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করবে? তখন ভাবলাম, এইটাই বলার সুযোগ। আমি বললাম, ফটোগ্রাফি করব। তখন সে আমাকে বলল, ফাইন। বাট ডু ওয়ান থিং। তখন তো সবে আমি ইন্টারমিডিয়েট দিয়েছি। এরপর বাবা বললেন তা হলে কিছুদিন আমার সাথে একটু বের হও। তোমার অভিজ্ঞতা বাড়বে। ওটা করলে তোমার পক্ষে বিষয়টা সহজ হবে।

রাইজিংবিডি : সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরুর গল্প শুনতে চাই।
মাহফুজুর রহমান খান : প্রথমবার আমি চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করি। কিন্তু আমার মধ্যে তখন প্রবণতা একটাই ছিল ফটোগ্রাফি শিখব। তাই ক্যামেরার ফ্রেম হিসেব করে ফেলতাম। আমি ওটার দিকেই বেশি নজর রাখতাম। এরপর কাজ করতে থাকি। ৬৯ , ৭০,  ৭১ গেল এরপর ৭২ এ এসে আমি পুরোপুরি কাজ শুরু করি। ওই সময় মিঠু ভাই আমাকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে বলেন। তখন চার পাঁচটি সিনেমায় কাজ করেছিলাম। কিন্তু আমার চিন্তা ছিল কীভাবে ফটোগ্রাফিতে আরও ভালো করব।

 

রাইজিংবিডি: বেশ কিছু চলচ্চিত্রে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেও অভিনয়ে নিয়মিত হলেন না কেন?
মাহফুজুর রহমান খান: কারণ ফটোগ্রাফি ছিল আমার প্রধান শখ। পরে এটিকে পেশা হিসেবে নিলাম। ফটোগ্রাফি হচ্ছে নিজের কাছে পৃথিবীর সেরা আনন্দের কাজ। তা ছাড়া মনে হতো শিল্পী হওয়াটা বড্ড কঠিন। তার চেয়ে ফটোগ্রাফার হওয়া ঢের সহজ। তাই ফটোগ্রাফিকেই প্রাধান্য দিয়েছি এবং সফল হয়েছি।


রাইজিংবিডি : শেখার জন্য কোন সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়েছিলেন?
মাহফুজুর রহমান খান : সবসময় চেষ্টা করতাম সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখতে। আমার ভাগ্য হয়েছিল জহির রায়হানের ‘লেট দেয়ার বি লাইট’র সেটে যাওয়ার। এ ছাড়া আরও অনেকের সেটে যেতাম- যেমন রফিকুল বারি চৌধুরীর সেট উল্লেখযোগ্য। তারা সবাই আমার শিক্ষক ছিলেন। আমার তো গুডলাক হচ্ছে আমি অনেক জ্ঞানী মানুষের স্পর্শ পেয়েছি। এ ছাড়া কামাল আহমদ, রাজ্জাক ভাই, শিবলি ভাই, আজহার ভাই, আলমগীর কুমকুম এরা আমাকে অনেক পূর্ণতা দিয়েছেন।

রাইজিংবিডি: হাসন রাজা সিনেমায় আপনি সম্পূর্ণ কাজ করেননি। কিন্তু কেন?
মাহফুজুর রহমান খান : শুটিংয়ের সময় এই সিনেমার প্রধান ফটোগ্রাফার দুলাল অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তার স্থলে চাষী ভাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এ জন্য বেশ কিছুদিন এ সিনোমায় কাজ করেছিলাম। 

 

রাইজিংবিডি : দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন। আপনার কাজ নিয়ে আপনি কতটা তৃপ্ত?
মাহফুজুর রহমান খান : আমিতো এখনো নিজের সিনেমাগুলো দেখি। টেলিভিশনের পর্দায় হোক আর যেখানে হোক, তা দেখি। তবে এখনো শিখছি তাই নিজের কাজ নিয়ে আমি তৃপ্ত নই। তবে এটা ভেবে ভালো লাগে যে, প্রথম দিকে কাজের যতটুকু বুঝতাম তার সবটুকু দিতে চেষ্টা করেছি। তখন হয়তো সত্যজিতের মতো কিংবা বড় বড় মানুষের মতো অতো ভালো জানতাম না। আমারও তো জানার একটা লিমিট ছিল। কিন্তু আমি সবসময় চেষ্টা করেছি সবটুকু দিতে।

রাইজিংবিডি : আপনি প্রযোজক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন। আগে থেকেই কী প্রযোজনার পরিকল্পনা ছিল?
মাহফুজুর রহমান খান : না, তা ছিল না। আমারা কজন ভালো বন্ধু মিলে প্রযোজনার কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের প্রযোজনায় চারটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। এখন আপাতত কোন সিনেমা প্রযোজনা করছি না।


রাইজিংবিডি : হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রে কাজ করে সর্বাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এর কী বিশেষ কোনো কারণ ছিল?
মাহফুজুর রহমান খান : হ্যাঁ, তার ছয়টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এর মধ্যে চারটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলাম। আসলে হুমায়ূন আহমেদ অনেক উঁচুমানের একজন নির্মাতা ছিলেন, যা নতুন করে বলার কিছু নেই। তিনি যখন গল্প শোনাতেন তখন কাজটা সহজেই চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠত। প্রতিটি শর্ট অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তিনি দেখতেন। বিশেষ করে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’য় তিনি যেন পরম মমতায় বাড়তি যত্ন নিয়ে কাজ করেছিলেন। শুটিংয়ের আগে ও পরে রীতিমতো চলচ্চিত্রের প্রতিটি নির্মাণ কাজ নিয়ে গবেষণা করতেন। তার এই অক্লান্ত ও নিবিড় পরিচর্যায় ইউনিটের সবাই ভালো কিছু করার উৎসাহ পেত এবং ভালো কাজের অংশীদার হতো। হুমায়ূন আহমেদের একটি গ্রেট টিম ছিল। সেখানে তার স্ত্রী শাওন,  সহকারী জুয়েলসহ প্রত্যেকেই কাজের প্রতি অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন।

রাইজিংবিডি : আপনার অভিজ্ঞতা থেকে জানতে চাই ভালো সিনেমা নির্মাণের পেছনে সব চেয়ে জরুরি বিষয় কোনটি?
মাহফুজুর রহমান খান : একটা ভালো টিম। সিনেমা কখনো আমি না, সিনেমা আমরা। ভালো একটা টিম না হলে গল্প আর লোকেশন যত ভালোই হোক না কেন ভালো সিনেমা বানানো সম্ভব না। পরিচালককে সিনেমার গল্পটা যেমন ভালো করে জানতে হবে, তেমনি একজন মেকআপম্যানেরও গল্পটা জানা জরুরি। একজন প্রোডাকশন বয়ও সিনেমা টিমের অন্তর্ভুক্ত। তাই ভালো সিনেমা বানানোর পূর্বশর্ত একটা ভালো টিম। আর আমার ভাগ্য ভালো আমি এমন কিছু টিম পেয়েছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের সাথে কাজ করে এতগুলো পুরস্কার পেলাম। হুমায়ূন আহমেদের একটা দুর্দান্ত টিম ছিল।

রাইজিংবিডি : আপনার কাছে নিজের সেরা কাজ কোনটি?
মাহফুজুর রহমান খান : আমার জীবনে সেরা কাজটি এখনো করতে পারিনি। এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এখনো আশাবাদী কাজটি করে যেতে পারব। আমাদের এই সুজলা-সুফলা সোনার বাংলার অপরূপ রূপ তুলে ধরে ক্যামেরায় এমন কিছু কাজ করে যেতে চাই, যা মৃত্যুর পরও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
 
রাইজিংবিডি : নতুনদের উদ্দেশ্যে আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
মাহফুজুর রহমান খান : নতুনদের জন্য উপদেশ নয়,  আমার পরামর্শ হচ্ছে- ক্যামেরার প্রতিটি শর্টকে শেষ শর্ট মনে করে কাজ করতে হবে। এতে কাজের মান বাড়বে। কাজটি সহজেই সফল হবে। ভালোবেসে কাজ করলে কেউ কখনো পিছপা হয় না, এটা আমার বিশ্বাস।

রাইজিংবিডি : সময় দেওয়ায় জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহফুজুর রহমান খান : রাইজিংবিডি পরিবারকেও আমার শুভেচ্ছা।

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মে ২০১৬/অহ/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়