ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

বন্ধুত্ব একটি স্বার্থহীন সম্পর্ক

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৪, ২ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৮:৪৪, ২৯ আগস্ট ২০২০
বন্ধুত্ব একটি স্বার্থহীন সম্পর্ক

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমন একটি বিশেষ জাতের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও পৃথিবীর বড় বড় খ্যাতিমান লেখক, কবি, গবেষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে নানা উক্তি করেছেন। বন্ধু নিয়ে তৈরি হয়েছে গান, কবিতা, সিনেমা। বাস্তব জীবনেও প্রকৃত বন্ধুর অনেক উদাহরণ রয়েছে।

আমাদের চলার পথে যে সবচেয়ে বেশি সময় সঙ্গ দেয় সে বন্ধু। তাই খাঁটি বন্ধু প্রতিটি মানুষের জীবনেই দরকার। মহান দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, দুর্ভাগ্যবান তারাই যাদের প্রকৃত বন্ধু নেই। আবার তিনিই বলেছেন, বন্ধু হলো এক আত্নার দুটি শরীর অথবা প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয় কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয় ততই উৎকৃষ্ট হয়।

এসব মন্তব্যের অর্থ হলো বন্ধত্ব নামক সম্পর্কটি চির নতুন, চির উদ্দীপনায় ভরা, সুখময়। তবে তা যদি প্রকৃত বন্ধুত্ব হয়। কারণ আজকাল সবকিছুর মধ্যেই যে হারে ভেজাল ঢুকে গেছে বন্ধত্ব নামক এই সম্পর্কটিও গুটিকয়েক খারাপ বন্ধুর কারণে কুলষিত হচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমরা দুই বন্ধু ও ভালুকের গল্পটা জানি। যেখানে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে রেখেই নিজে বাঁচার তাগিদে গাছে ওঠে। যদিও অন্য বন্ধু তাৎক্ষণিক বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায়। কিন্তু এই গল্পটার মোরাল হলো বিপদের সময় যে বন্ধু তোমাকে ত্যাগ করে সে প্রকৃত বন্ধু নয়। তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই উত্তম।

কথায় কথায় আমরা বলি, ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। বন্ধু শব্দটি খুব ছোট কিন্তু এর অর্থেও ব্যাপকতা সিমাহীন। কোনো সুনির্দিষ্ট গণ্ডীতে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। সে চেষ্টা করা কেবল অর্থহীন শক্তির অপচয় মাত্র। বন্ধু মানে একে অপরের সুহৃদ। দুটি হৃদয় যখন সব সংকীর্ণতা, হিংসা, কপোটতা, ক্রোধ মুক্ত হয়ে একত্রিত হয়, পাশে থাকে, পরামর্শ দেয় সেই বন্ধু।

বন্ধুত্ব বা বন্ধু নিয়ে এত কথা লিখতাম না। কিন্তু আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বন্ধু দিবস পালন করা হয়। এই দিনে বন্ধুরা একে অপরকে উপহার দেয়, সবাই মিলে পার করে কিছুটা বাড়তি সময়। কবে কোথায় প্রথম এর সূচনা হয়েছিল তা নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। তবে বেশ কিছু ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়, উনবিংশ শতাব্দির ত্রিশ থেকে চল্লিশ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বন্ধু দিবস পালন করার রীতি শুরু হয়। প্রথম দিকে কিছু কার্ড তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধু দিবস পালন শুরু করে। বন্ধুরা একে অপরকে কার্ড ও অন্যান্য গিফট উপহার দিয়ে এদিনটি পালন করতো। ধারণা করা হয় ১৯৩৫ সালের দিকে আমেরিকাতে প্রথম বন্ধু দিবস পালন হয়। পরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়।

আবার একইসঙ্গে প্যারাগুয়ের নামও শোনা যায়। ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম ৩০ শে জুলাই বন্ধু দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। তবে ২৭ এপ্রিল ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই অফিসিয়ালি আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। কিন্তু ভারতসহ অনেক দেশ আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বন্ধু দিবস পালন করে আসছে।

আত্নার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে হয় আত্নীয় এবং বন্ধু। তবে আজকাল ভার্চুয়াল বন্ধুর অভাব নেই। এদের কোনটা যে আসল,  কোনটা নকল বোঝা কঠিন। বন্ধুত্বের এই অবাধ প্রাপ্যতার যুগে নিজের প্রোফাইলে থাকা মা, বাবা, ভাই, বোন সবাই বন্ধু। তবে বন্ধুর বেশে প্রতারণার হারও ক্রমেই বাড়ছে। বন্ধুর উপর বিশ্বাসে চিড় ধরছে। এত বন্ধুর ভিড়ে আসল বন্ধুটিকে চিনে নেওয়ার কাজটিও কঠিন হয়ে পড়েছে।

এখন প্রশ্ন- কে বন্ধু হতে পারে? এরা কি পরিবারের বাইরের হতে হবে? আসলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে কেউ বন্ধু হতে পারে। তবে বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা থাকা দরকার। এই যোগ্যতা কোনো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সার্টিফিকেটের যোগ্যতা নয়। এই যোগ্যতা কাছে আসার যোগ্যতা, অন্যকে বোঝার যোগ্যতা, ভালোবাসার যোগ্যতা এবং সর্বোপরি বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার ও বিশ্বাস করার যোগ্যতা। এই বিশ্বাসের ওপরই বন্ধুত্বের বাঁধন শক্ত হয়। যার বন্ধুর ওপর বিশ্বাস যত বেশি তারা তত ভালো বন্ধু। আমাদের ক’জনেরই বা আজ সে যোগ্যতা রয়েছে। আমরা তো কেবল স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকি। স্বার্থ ফুরালে চম্পট দেই। বন্ধুত্বের সুযোগে আঘাত করি। কিন্তু এই সমাজকে বাঁচাতে আজ নিঃস্বার্থ বন্ধুর খুব দরকার।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধুর প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। তখন মানুষ হয় নিঃসঙ্গ। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন সময় সাহচর্য পাওয়া বন্ধুরা তখন কে কোথায় থাকে তা জানাও যায় না। অন্তর দিয়ে কেবল সে সময়ের স্মৃতি হাতরানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মনের কোণে সেই গান গুনগুন করে বাজে- কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই...।

লেখক: সাংবাদিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়