ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

লেখক ও বইয়ের প্রচার

জাকির তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৩, ২ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১২:০৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
লেখক ও বইয়ের প্রচার

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যতদিন ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, ততদিন পত্রিকার কোনো সংখ্যাতেই তাঁর নিজের কোনো বইয়ের বিজ্ঞাপন তো দূরের কথা, কোনো আলোচনাও ছাপেননি। ‘বঙ্গদর্শন’ সেকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা। বাঙালি পাঠককে কোনো বইয়ের খবর সবচেয়ে ভালোভাবে জানানোর জন্য সেই পত্রিকার চাইতে ভালো মাধ্যম আর কী হতে পারে? সেখানে বইয়ের খবরটি অন্তত ছাপার জন্য তাঁর বন্ধু-স্বজন এবং সমকালীন লেখকরা বারংবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিত্বশালী বঙ্কিমচন্দ্র অনড়, অটল।

নিজের বই সম্পর্কে অন্য কোথাও কি কিছু বলেছেন বঙ্কিম? লিখেছেন? সম্ভবত বইয়ের ভূমিকা ছাড়া আর কোথাও নিজের লেখার বিষয়ে কোনো মতামত নিজে প্রকাশ করেননি। কাউকে কখনো তাঁর কোনো বইয়ের আলোচনা লিখতে অনুরোধ করেছেন, এমন উদাহরণও নেই।

একজন সাহিত্যিকের ব্যক্তিত্ব কেমন হওয়া উচিত তার উদাহরণ আমাদের সামনে স্থাপন করে গেছেন আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম পুরুষ বঙ্কিম।

রবীন্দ্রনাথের বইয়ের বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে নিজের সম্পাদিত পত্রিকাতেও। তবে তার ভাষা খুব কাটাকাটা। শুধু বইয়ের নাম, লেখকের নাম, বইয়ের দাম। ব্যস শেষ। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় প্রচারক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। অনেকেই বলেন যে, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার আগে তাঁকে তেমন সম্মান জানায়নি দেশের সারস্বত সমাজ। তথ্যটি ভুল। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রবাসী’ এবং ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার মাধ্যমে শুধু বাঙালি পাঠক নয়, ইংরেজি জানা সকল মানুষের কাছে অবিরাম পৌঁছে দেবার চেষ্টা চালিয়েছেন রবীন্দ্রপ্রতিভার পরিচয়। কবির পঞ্চাশ বর্ষপূর্তিতে কলকাতায় তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয়েছিল, সেকথাও আমাদের জানা। 

তবে রবীন্দ্রবিরোধিতাও যে সেকালে খুব প্রবল ছিল, সেটাও জানা যায়। বিশেষ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নেতৃত্বে কবিকে খুব স্থূলভাবেও হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেগুলোর উত্তর খুব কমই দিয়েছেন। নিজের বিভিন্ন কবিতা এবং গদ্য সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা তাঁকে দিতে হয়েছে অনুরুদ্ধ হয়ে। তবে সেগুলো উৎকট ‘আমিময়’ নয়।

নিজের এবং নিজেদের বই নিয়ে নিজের সম্পাদিত পত্রিকাতে প্রবল মাতামাতি শুরু বুদ্ধদেব বসুর হাতে। গোষ্ঠীসাহিত্যও তাঁরই অবদান। তবে রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে নতুন সাহিত্যধারাটিকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান খুবই মূল্যবান। যদিও বুদ্ধদেব বসুদের হাতেই বাংলাসাহিত্যের আবহমান ধারার সাথে ছেদ ঘটে পুরোপুরিভাবে। বঙ্কিমচন্দ্র এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তও ইউরোপ থেকে নিয়েছেন আঙ্গিক এবং রচনারীতি। কিন্তু অন্তর্বস্তুতে তাঁদের রচনা ধারণ করেছিল বাঙালিত্বকেই। তাই রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আবহমান বাংলা সাহিত্যধারা ছেদহীনই ছিল বলা যায়। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুরা ইউরোপকেন্দ্রিক আঙ্গিক শুধু নয়, ভাষা, ভাবনা-চিন্তাকেও অবলম্বন করে দাঁড় করাতে চাইলেন তাঁদের সাহিত্যকর্ম। সেগুলো ছিল বাঙালি পাঠকের সম্পূর্ণ অচেনা। বাঙালি-মানস থেকে সাতসমুদ্র দূরে। এই অপরিচয় ঘোঁচানোর জন্য বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্গীরা মেতে উঠেছিলেন ব্যাপক আত্মপ্রচারে। তাঁদের বলয়ের বাইরে অন্য কাউকে আদ্যে গ্রহণযোগ্য লেখক বা কবি হিসাবে গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ নারাজ ছিলেন তাঁরা। তাই আন্তর্জাতিক হতে গিয়ে উল্টো হয়ে গেলেন উন্মূল, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, আত্মপ্রচারকুশলী এবং প্রগতিবিরোধী।

সেই আত্মপ্রচারের ধারার সবচেয়ে ঘৃণ্য রূপ দেখছি আমরা এখনকার সময়ে। সেটি পুরোপুরি নোংরাভাবে ধরা পড়ে বইমেলার সময়। আত্মপ্রচার এককভাবে। আত্মপ্রচার যৌথভাবে। আত্মপ্রচার গোষ্ঠীগতভাবে। একথা তো সত্য যে প্রকাশকরা আমাদের বইয়ের প্রচারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেন না, তাই বাধ্য হয়ে বইয়ের খবর পাঠককে জানানোর চেষ্টা করতে হয় লেখক-কবিদেরই। সেই জানানোর চেষ্টাকে দোষণীয় বলা যাবে না।

আশির দশক পর্যন্ত বইয়ের প্রচার ছিল মোটামুটি রুচিশীল। জনপ্রিয় এবং অর্থকরী লেখকদের বইয়ের বিজ্ঞাপন লাগাতার প্রকাশিত হতো পত্র-পত্রিকায়। এর বাইরে শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখক-কবিদের বই নিয়ে ছোট ছোট আলোচনাসভা হতো। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা এবং বিভিন্ন সাময়িকীতে মানসম্মত বইয়ের আলোচনা-সমালোচনা প্রকাশিত হতো। প্রকাশিত হতো গ্রন্থ-পরিচিতিও।

নব্বই দশকের শুরুতে ঘটলো মিডিয়া-বুম। মিডিয়া যে বামনকেও দৈত্য বানিয়ে ফেলতে পারে, সেই বোধটি প্রথম জাগরিত হলো নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। পুঁজিবাদের আরেক হাতিয়ার হিসাবে এদেশে ব্যবহৃত হতে শুরু করল মিডিয়া। এবং সেটিকে কাজে লাগাতে ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে উঠলেন সাহিত্যজগতের বামনরা। কোনোদিন কোনো মানসম্মত পত্রিকায় ছাপার মতো লেখা না লিখলেও বইমেলায় টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করা এবং পত্র-পত্রিকায় চাররঙা বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিবছর সাহিত্যের আকাশে উদিত হতে থাকলেন নতুন নতুন নক্ষত্র। কারো আয়ু এক বছর, কারো আয়ু পাঁচ বছর। কিন্তু তাদের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে গেল সত্যিকারের সাহিত্যের। শঙ্খ ঘোষের কবিতার অমোঘ পঙ্‌ক্তির মতো ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’।

সাথে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া শুরু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এদেশে টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে সংশ্লিষ্ট। তিনি এটিকে বলেছিলেন- ইরেজিং মিডিয়া। কিন্তু ইরেজ হওয়ার আগপর্যন্ত মানুষের রুচির যথাসম্ভব ক্ষতি করে যেতে সক্ষম এই মিডিয়া। পয়সা দিয়ে টিভির অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া, ক্ষমতার জোরে উপস্থিত হওয়া, পদের জোরে উপস্থিত হওয়া। যেন দেশে লেখক বলতে তারাই, কবি বলতেও সেই কয়েকজনাই, চিন্তাবিদ বলতেও তারাই। এই পর্দার বাইরের আর কেউ কবি নয়, লেখক নয়। অথবা তারা লেখক বা কবি হিসাবে ব্রাত্য।

আর এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অরুচির জয়-জয়কার। একক এবং যৌথ আত্মপ্রচার রুচিহীনতার সকল স্তর পেরিয়ে গেছে। ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে, পেইজে, ব্লগে, ইউটিউবে নিজের বইয়ের খবর পাঠককে জানানোর চেষ্টা অপরাধ নয়। বরং না জানানোটাই ক্ষতিকর। সেটি লেখকের জন্য যেমন, পাঠকের জন্যও ক্ষতিকর। তবে আরো বেশি ক্ষতিকর অসাহিত্য এবং দুর্বল রচনাকে মহান হিসাবে প্রমোট করা। সেটিই এখন ঘটে চলেছে অবাধে। যৌথ আত্মপ্রচার দেখলে হাসিও পায়। এমন লেখক আরেকজন লেখকের বইয়ের ব্যাপক প্রশংসা করে ফেইসবুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন, যিনি নিজেই লেখক হিসাবে গৌণ। বিনিময়ে তিনিও অবশ্য আরেকজনের কাছে পিঠ চুলকানি পাচ্ছেন। যদিও সচেতন মানুষ ঠিকই বুঝে যায় এই পারস্পরিক পিঠ চুলকানির মাধ্যমে বাজার দখলের চেষ্টা। তবে এর মাধ্যমে অদীক্ষিত পাঠকদের আগের চাইতে অনেক বেশি বিভ্রান্ত করা সম্ভব হচ্ছে। প্রচারণায় বিভ্রান্ত পাঠক ভাবছেন, এরাই বোধহয় আমাদের দেশের সাহিত্যের এই যুগের প্রতিনিধি। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এরা বিভিন্ন সাহিত্য-সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদেই লেখক। মফস্বলে এদের মানের লেখক শত শত আছেন, যাদের এমন চাকরিগত অবস্থানে নেই বলে তারা মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচিত হতে পারেন না।

এদেশে পাঠকের সংখ্যা এত বেশি নয় যে নিম্ন মাঝারি মানের একজন লেখকের অটোগ্রাফ দিতে দিতে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। অথচ ডাঁই করে রাখা বইয়ের স্তূপের পাশে বসে অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত লেখকের ছবি প্রতিদিন দেখা যাবে ফেইসবুকে। প্রকৃত লেখকরা এমন করেন না। কিন্তু নতুন লিখতে আসা ছেলেমেয়েরা এই নিম্ন-মধ্য মানের লেখকদেরই মনে মনে আইডল বানিয়ে ফেলেন। অচিরে তারাও শিখে যান এই শর্টকাটে আলোচিত হবার স্থূল এবং রুচিহীন পথগুলো অনুসরণ করতে। সপ্তাহে সপ্তাহে ফেইসবুকে আত্মপ্রচার আসে এই মর্মে যে প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে যাওয়ায় গতকাল অসংখ্য পাঠক ফিরে গেছেন বই না-পেয়ে। সেজন্য লেখক এবং প্রকাশক দুঃখিত। আহারে!

কফিনে শেষ পেরেক ঠোকানোর জন্য মাঝে মাঝে আগমন ঘটে কিছু অর্থশালী অতীব শক্তিশালী লেখকের। তারা পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্য ভাড়া করেন সিনিয়র লেখকদের কউকে কাউকে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! যে সিনিয়র লেখকরা সারাজীবন সাহিতচর্চা এবং চিন্তাচর্চার দ্বারা নিজেদের একটি অবস্থানে তুলে নিয়ে যেতে পেরেছেন, তাদেরও কেউ কেউ বিক্রি হয়ে যান শেষ বয়সে এসে। সারাজীবন তারা যা বলেছেন, তার বিপরীত কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন জীবনসায়াহ্নে এসে। কোনো কোনো বই বা পাণ্ডুলিপি না পড়েই তাঁরা সার্টিফিকেট দিয়ে বসেন। ‘একই নামের অমুক লেখকের অমর উপন্যাসটি না পড়লেও চলবে, তরুণ প্রজন্মকে বলব এই লেখকের সেই নামের উপন্যাসটি পাঠ করতে’ অথবা লিখে দেন ‘এই রকম আশ্চর্য সর্বাঙ্গসুন্দর উপন্যাস বাংলাভাষায় আগে কখনো লেখা হয়নি’। এইসব মানুষের শেষ বয়সে পথ-পিছলানোর কারণে পাঠক এখন শ্রদ্ধা করার মতো সিনিয়র লেখক পায় না! যেমন জাতি পায় না একজন আইডল। একটা জাতির জন্য এরচেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে!

রচনার শক্তির জোরে লেখক বা কবি হয়ে ওঠার সাধনায় মগ্ন থাকাটা এখনকার এইসব নিম্ন-মাঝারি মানের বিভিন্ন বয়সী লেখক-কবিদের চোখে বোকামি। কিন্তু দিন শেষে ঠকে যায় এরাই। পাঠকের সাথে প্রতারণা করার নামে সবচেয়ে বড় প্রতারণা করে এরা নিজেদের লেখকসত্তার সাথে। 
কারণ দিন শেষে প্রচার নয়, বেঁচে থাকে কেবল সত্যিকারের সাহিত্য, সত্যিকারের শিল্প।

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়