ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গহীন বিলাপের কাহিনি

মাহবুব আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৮, ১২ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১২:৩৭, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২
গহীন বিলাপের কাহিনি

সে বছর জুন মাসের শেষের দিকে আকাশ যেভাবে সারাক্ষণ মেঘলা আর থেকে থেকে অঝোর বৃষ্টি, রাতের মধ্যপ্রহরে আকস্মিক কোনো ফাঁকে চাঁদের আলো লুকোচুরির মতো নেমে আসে, সাইফুল-হবিবর-রাজ্জাক তখন বেজাইমোড় বটগাছের কাছে ঝুপড়ির মতো ক্যাম্পে বসে আশপাশে সতর্ক পাহারায়, কোথায় কী ঘটে নাকি ঘটছে অথবা কেউ পালিয়ে যায়; আর ঠিক আকস্মিক একটি দল ধরা পড়ে। 

এটি কাকতালীয় নয়, এমনই ঘটে চলেছে মাস দুয়েক ধরে, গোচরে-অগোচরে, তেমনই ঘটে চলে যা অবশ্যম্ভাবী ইতিহাস। ওদিকে বাংকারের ভেতরে দুজন আর্মি ঘুমে-আধোঘুমে প্রায় অচেতন, তাদের নাকডাকার ঘূর্ণায়মান শব্দ ক্রমশ উপরে উঠে যায়, যেখানে বালুর বস্তা ব্যারিকেড এবং জেড বি ফিফটি থ্রি মেশিনগান তাক করে দাঁড়িয়ে থাকে একজন, তার উঁচু দৃষ্টি রাতজাগা কুকুরের মতো চকচকে ক্ষুরধার, বুঝিবা রাতের গহীনে জ্বলজ্বল কোনো অগ্নিগোলক দিগন্তের প্রান্তসীমায় অচেনা জিঘাংসার শিকার অন্বেষনে প্রচণ্ড উদগ্রীব। এরা হাজার মাইল দূরে পরিবার-পরিজন রেখে পাকিস্তানের অখণ্ডতা আর সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ বেতনভুক্ত সৈনিক। সেই উঁচু থেকেই সতর্ক ডাক ভেসে আসে। তারা তিনজন জেগেই ছিল। হবিবর জবাব দেয়, ‘হাঁ স্যার দেখা হ্যাঁয়।’

এই বাক্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সাইফুল আর রাজ্জাক হাতের পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি রাইফেল উঁচু করে বোল্ট টেনে রেডি হয়ে থাকে যাতে ট্রিগার টেনে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিবিচ্ছুরণ ঘটে, আর বন্যশূকর হত্যার মতো মানুষ মেরে বড় তৃপ্তি; এইসব ভেবে ভেবে রাতের গভীরতায় হুংকার ছড়িয়ে দেয় কেউ। এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয় জলপাইতলি, সরকারপাড়ার সরু অলিগলি পেরিয়ে সীমান্ত, ওপারে ভারত; মানুষজন পালিয়ে বাঁচতে মরিয়া। 

সেই রাত ছিল পূর্ণিমা, মেঘের আড়ালে লুকোচুরি জোছনার আলোয় ভাসা ভাসা আবার বেশ স্বচ্ছ দৃশ্যমান হতে থাকে দলটি। কোনো শিশুর কান্না কি ভেসে আসতে আসতে কেউ নিশ্চিত মুখ চেপে ধরে? অদ্ভুত গোঙানির শব্দে রাত মৃদু কেঁপে থমকে দাঁড়ায়। হবিবর এই কাজ করতে চায়নি, কিন্তু ধরা পড়ে গেল সেদিন; জান বাঁচানো ফরজ। প্রাণ বাঁচাতে তিন জায়গায় মিথ্যে বলায় গুনাহ্ নেই, একটি হলো যুদ্ধক্ষেত্র, আদতে তখন যুদ্ধ চলছিল কিনা জানা নেই, যুদ্ধের মতো পরিবেশ, মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক, বাতাসে হাজারও খবর হাজারও গুজব, এসবের মধ্যে যখন দিন কয়েক আগে দুতিনটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেল গঙ্গাসাগর দিঘিপাড়ে, বুঝতে বাকি রইল না কোনো কিছু; সে তাই মিথ্যে বলেছিল। তার কাছে কলেমা তাইয়েবা-তাশাহুদ জলবৎ তরলং, তবু আরও শোনায়, সুরা বাকারার দু’তিনটি আয়াত ক্বেরাতের সুরে সুরে আর খুব সহজে বিশ্বাস অর্জন করে ফেলে। 

তখন ক্যাপটেন জুলহাস খানের কটকটে চোখ নরম হয়ে এসেছে, মে মাসের তাপদাহ দিনশেষে মৃদু বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে ঘামের তীব্র গন্ধ; আর হবিবর এসবের মধ্যেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। গ্রামে কেউ নেই, দুচারজন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ প্রাণের ভয়ে ঘরের কোণায়, অন্ধকার ছায়ায় চোখ গুঁজে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে, অথচ হবিবর আটক হয়ে গেল; আসলে সে তখন সত্যি সত্যি খান আসছে নাকি পুরোটাই এই যেমন রাখালের ‘বাঘ আইছে বা রে বাঘ আইছে’ গল্পকাহিনি কে জানে। দিঘির পুব দিকে নবীন এক মেহগনি গাছ, কিছুদিন হয় শরীরের সকল পাতা বৃন্তচ্যূত করে নব পল্লবে সেজেছে, বাতাসে মৃদুমন্দ দোল, সেটির ছায়া ছায়া পটভূমিকায় দুএকটি দোয়েল লেজ নেচে নেচে এই ডাল আর ওই ডাল করছিল, সাত-আটজন থমকে দাঁড়ায়। হবিবরের সামনে কয়েকজন হাতে ধরে আছে অ্যাসল্ট এম সিক্সটিন নাকি চায়নিজ অটোম্যাটিক রাইফেল কে জানে। অস্ত্র তো মানুষের প্রাণ নেয়। হবিবরকে দেখে কেউ হুংকার ছেড়ে দেয়- ‘হল্ট।’

হবিবরের শিরদাঁড়া বেয়ে মৃত্যুর হিমশীতল শিহরন নেমে যেতে শুরু করে আর অসহায়-নিরুপায় স্থির দাঁড়িয়ে যায়; মাথার উপর দুহাত তোলা। মাদরাসার ছাত্র হলেও সবসময় টুপি থাকে না। সেটির জন্য আফশোসও হয়। তখন তার পেছনে পুকুরের জলে কতগুলো হাঁস ভুতুড়ে নির্জন পাড়ায় বেশ দাপটে এমন অদ্ভুত-বিকট শব্দ তুলে যায় যে সমুদয় নির্জনতা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ‘এ্যাই ছালে হল্ট! একতরাফ নি পে খাঁড়ে হো যাও।’

হবিবর বোঝে না, তখন কেউ বুটের লাথি মেরে ফেলে দেয়। বিহারি আছে দুজন। তাদের শিরোদেশে সাদা কাপড়, একেই বুঝি কাফনপট্টি বলা হয়; বাজারে শোনা গেছে এমন কথা। হবিবর হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বসে পড়ে কিংবা গড়িয়ে যায়, দুচোখে অদ্ভুত ভাসা ভাসা অন্ধকার, সে দেখছে কিন্তু কিছুই দেখছে না; বোধকরি বোধশক্তি নেই।
‘আবে মাদারচোদ লিলডাউন হো যাও, আদমি লোগ কাঁহা হ্যাঁয়? সব ছালে ভাগ গিয়া ক্যায়া?’
‘জি সাহাব সব ভাগ গিয়া।’
‘কিঁউ ভাগা? ছালে লোগ মালাউন হ্যাঁয়, মাজাবারকা মুক্তিফৌজ, এ্যাই তুম মুক্তি হো?’
‘জি নেহি সাব, হাম তো সাচ্চা পাকিস্তানি হ্যাঁয়। পাকসার জমিন সাদবাদ, কিশোয়ারে হাসিন সাদবাদ।’
‘আচ্ছা আচ্ছা ক্যায়া করতে হো?’
‘মাদরাসা মে পড়তে হ্যাঁয় সাব।’
‘সাব নেহি, স্যার পুকারো।’
‘জি স্যার।’
‘মাদরাসা? উয়ো ক্যায়া?’
‘মক্তব মে স্যার মক্তব।’

হবিবরের সেই তো কাজের শুরু, একটি রেজিস্টার খাতার তালিকায় নাম উঠে গেল, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে, হিন্দুদের ষড়যন্ত্র রুখতে হবে, বাঁচাতে হবে পেয়ারে ওয়াতন্ পাকিস্তান, সরকার এরজন্য বেতন দেবে; যেখানে টাকা আর কি সমস্যা? অতএব কয়েকদিনে শিখে নেওয়া হলো থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর ট্রেনিং। পকেটে কায়েদে আযমের ছবি ছাপা সবুজ রং নোটও চলে এলো। মনে ফুর্তি। আওয়ামী লীগ দেশ বিভক্ত করতে চায়, ভারতের গোলাম বানাতে চায় জাতিকে, যা কখনোই করতে দেওয়া হবে না, হিন্দুরা মাথার উপর প্রভু হয়ে থাক, এটি কোনোমতেই সহ্য করার নয়; অতএব যেদিন কাঠের পরিবর্তে সত্যি সত্যি রাইফেল হাতে এসে গেল দেহমনে নতুন শক্তি আর অদ্ভুত উন্মাদনা। এখানে-ওখানে বিল আর জলার ধারে কানিবক কিংবা দুএকটি বালিহাঁস শিকার করার বাসনা পূরণ হয়নি কোনোদিন, একটি টু টু বোর বন্দুক বা এয়ারগান ছিল না, এবার রাইফেল আর কার্তুজ, বোল্ট টেনে ট্রিগারে আলতো ছোঁয়া, ব্যস পড়ে যাবে শিকার, কিন্তু কাজ তো পাখি শিকার নয়, মানুষ মারতে হবে; চমকে ওঠে হবিবর। জীবনে ঈদ-উল-আয্হায় গরু-ছাগল জবেহ্ করা দেখতে পারে না, রক্ত দেখলে মাথা গুলোয়, বমি আসে, মানুষকে গুলি করে মারবে কী করে? সেই মানুষ মারার নাকি অনুমতি নিতে হয় না।

এখন পর্যন্ত মানুষের দিকে রাইফেল তাক করার সময় আসেনি, আল্লাহ্ না করুক তেমন পরিস্থিতি আসে, এসব কাজ ভালো লাগে না; কোথায় এই বরিষণ সময়ে দিঘির জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরবে, কত আনন্দ, অথচ সে কিনা কী করতে বাধ্য হয়, কবে যে শেষ হবে এই দুর্যোগকাল কে জানে; রক্ত আর লাশ দেখতে ভালো লাগে না। এইসব ভাবনার মধ্যে দূরে বেশ দূরে ক্ষেতের মধ্যদিয়ে আইল ধরে যে সাত-আটজন সন্তর্পনে এগিয়ে যেতে থাকে, হবিবর দেখেছিল; কিন্তু না দেখার ভান করা যায় না। সাইফুল-রাজ্জাকও দেখেছে। মানুষগুলো সম্ভবত বারাইয়ের হিন্দুপাড়া থেকে রওয়ানা দিয়েছে, এখন সকলেরই গন্তব্য ভারত; বাংলাদেশ নিরাপদ নয়। পাকিস্তান সেনারা শহর থেকে গ্রাম, সেখান থেকে প্রত্যন্ত অজপাড়া-গাঁয়ে ছড়িয়ে গেছে, নির্বিচারে হত্যা করছে মানুষ, শিশু-নারী-বৃদ্ধ কেউ বাদ পড়ছে না; এ ছাড়া আরও অনেক নির্যাতন কষ্টের খবর শোনা যায়। মেয়েদের ধরে ধরে ধর্ষণ করছে, সাচ্চা মুসলমান তৈরির ইমানি কাজ- কি বীভৎস! 

হবিবর-সইফুল-রাজ্জাক এসব গল্প করে। কী করতে পারে তারা? হবিবর পালিয়ে যাবে। সময় আর সুযোগের অপেক্ষা। সেই প্রতীক্ষারও অবসান হতে চলেছে। এসবের মধ্যে এসে গেল আবছায়া রাতের দেয়ালে ছায়া ছায়া মানুষের দল। তারা পুবে গঙ্গাসাগর দিঘির পেছন পাড় ঘেঁষে দক্ষিণে যেতে থাকে, হবিবর অন্ধকারের মধ্যদিয়ে পিটপিট অপাঙ্গে দেখে যায়, যেন কেউ দেখেনি, সেও না, সাইফুল-রাাজ্জাকও, আলো-আঁধারি রাত, কখনো মেঘলা আকাশ কখনো বৃষ্টি, তাই কথা বলেনি, মানুষগুলো চলে যাক, প্রাণ বাঁচাক, কিন্তু মেশিনগান তাক করে থাকা বেলুচ সেনা ঠিক দেখে ফেলে, সুতরাং নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তৎপর আর সতর্ক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাদের সরু দৃষ্টি দূরের ছায়াগুলোকে অনুসরণ করতে করতে ক্ষেতের মধ্যে জলের শব্দও খুঁজে পায়, সেই জলে শত শত জোঁক; হবিবরের শরীর শিহরে ওঠে। তখন বাংকারের ভেতরে আধশোয়া পাঞ্জাবি দু-জনও বাইরে চলে এসেছে। রাজ্জাক চেঁচিয়ে ওঠে- ‘কাঁয় বা রে...তোরা কারা বা রে...এই হেঁ?’

হবিবর বোঝে, এরা প্রাণভয়ে নিজের ঘরদোর মায়াময় আপন সংসার আর পরিচিত মাটির গন্ধ ফেলে পালিয়ে যাওয়া মানুষ। দিন কয়েক আগেও এমন একটি দল বারাই হয়ে চলে গেছে। ভিন দেশে কারা শরণার্থী হতে চায়? সেখানে কি নিজ দেশের মতো আরাম-সুখ-শান্তি আছে? নেই নেই। তারা তবু বের হয়ে এসেছে অচেনা দেশের অনিশ্চিত জীবনযাপনের শেষ ভরসায়। আগে প্রাণ, প্রাণের চেয়ে আর কোনো বড় টান বা মায়া নেই। 

তখন হবিবর একা ছিল, পরনে লুঙ্গি, সাধারণ পোশাক, এখন যেমন খাঁকি প্যান্ট-কোর্তা আর খয়েরি রং কাপড়ের জুতো ছিল না। সে একরকম যতটুকু জানা, ভাসা ভাসা বোধ, বলে দেয়, শিখিয়ে দেয় কীভাবে পেরিয়ে যেতে হবে দশ-বারো মাইল পথ। কিন্তু এবার? ছয়জনের একটি দল, দু-জন মহিলা, এয়োতি আর মধ্যবয়সি বিধবা, একজন বারো-তেরো বছরের কিশোরী, ঝাঁকড়া চুল চকচকে দৃষ্টি ম্লান, তার কোলে দেড়-দুই বছরের শিশু, নিশ্চয়ই ছোটভাই, আর দু-জন পুরুষ, পঁয়ত্রিশ-উর্ধ্ব একজন, অন্যজন প্রায় বৃদ্ধ; অর্থাৎ একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার। হবিবর যখন তাদের দেখে, বুঝিবা গরু-ছাগলের মতো দেখে দেখে মানুষগুলো গুনে নেয়, তারা সত্যি সত্যি মানুষ নয়, কেননা তারা ভয়ংকর কাঁপছিল, আকুতি স্বরে কাঁদছিল, সেই কান্নার ধ্বনি বড় অসহ্য বড় করুণ আর বেদনাদায়ক, কোনো অচেনা খাঁ-খাঁ শূন্যতা ছড়াতে ছড়াতে রাত অন্ধকার করে দিতে থাকে আর সে-সময় পুনরায় ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হয়ে আকাশ অন্ধকার। পাকিস্তান সেনা তিনজন মুখোমুখি। তাদের দু-একটি কথা শেষ হলে নির্দেশমতো সরিয়ে নেওয়া হয়, তারা বোধকরি একদল পশু আর মৃত্যুর আদেশ হয়ে গেছে, সেই বিভীষিকাময় ভয়ার্ত পরিস্থিতি-পরিবেশ অঝোর বৃষ্টিপাতে আরও কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হতে শুরু করে।

মানুষগুলোকে উত্তরের পরিত্যক্ত দোকানঘরে নিয়ে যাওয়া হলে কান্নার রোল কিছু স্তিমিত হতে হতে গোঙানির স্বর, তারপর আচমকা একেবারে স্থবির-নিশ্চুপ হয়ে যায় মধ্যরাত। হবিবর আর সাইফুল সতর্ক চোখে তাদের দেখে নেয়। এক-দুই-তিন-চার গুনে গুনে মোট ছয়জন মানুষ। শিশুটি তখনো সেই কিশোরীর কোলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাতৃস্তন্য চোষণরত দৃশ্য এঁকে অলীক স্বপ্ন দেখে যায়। হবিবর-সাইফুল-রাজ্জাক ফিসফিস করে কথা বলে, ‘বাড়ি কোঠে বা রে তোমার? বারাই দিয়া যাবা পারেন নাই?’
‘ওতি রাস্তা বন্ধ বা, হামাক মারেন না বা, হারা হিন্দু, দেশ ছাড়ি চলি যাম বা, তোরা মারেন না।’
‘হারা নহায় বা রে, এই শালো পাঞ্জাবি খুবে খারাপ, জারুয়া, বোঝোছেন...শোনো বা রে তোমরা কমেন মুসলমান হবার চান।’
‘কিন্তুক হারা তো হিন্দু...আচ্ছা যা কমেন করমো, হামাক মারেন না বা।’ 

দোকানঘর বলতে হাসকিং মিলের পেছনে পশ্চিম দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে থাকা বাঁশ বেড়ার সেলুন, পরিত্যক্ত হাতলঅলা একটি চেয়ার, দক্ষিণে কাঠফ্রেমে বাঁধানো আয়না, আধময়লা কাচে তবু ক্ষণে ক্ষণে মেঘের বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে, মেঝেয় খড়কুটো বিস্রস্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গোয়ালঘরের মতো এলোমেলো, গোবরের স্যাঁতসেঁতে ভ্যাপসা গন্ধ বলে দেয় অনেক কিছু। বাংকার থেকে বের হয়ে আসা দুজন সেনার একজন চিৎকার করে ওঠে, ‘সাইফুল ল্যাডার আর বেলচা দে দো উঁয়ো বুড্ডা আর যওয়ান কো...উস তরাফ খোদ্নে কাহো। ইয়ে ছালে লোগ মালাউন, ইন্ডিয়া ভাগ যাতা হ্যাঁয়।’
‘স্যার এক নেক কাম করেন, ইস লোগো কো মুসলিম বানানা হ্যাঁয়।’
‘তুম বহুত চালু চিজ হবিবর, ইয়ে ছালে মুসলমান কিঁউ হোগা? ইসলাম নাপাক হো যায়গা। নেহি কভি নেহি। তুম তিনো সবেরে সব কো মার দোগে ঠিক হ্যাঁয়?’
‘স্যার মেরা সুপারিশ হ্যাঁয়, ইয়ে আদমিলোগ যো মুসলমান হতে চায়, মানে এরাদা কিয়া হ্যাঁয়, তো হাম কিঁউ আল্লাহ্ কা সওয়াব ছোড় দে?’
‘বাত আচ্ছা হ্যাঁয়, মাগার...অ কে, মাদারচোদ লোগো কো বুলাও। ঠেহরো ঠেহরো মুঝে আচ্ছা সে দেখনা হ্যাঁয়।’

পাঞ্জাবির হাতে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন টেন রিভলভার। তার ব্যস্তত্রস্ত হেঁটে যাওয়ায় ভারী বুটের ভেতরে পানি জমে প্যাঁক প্যাঁক শব্দ মৃত্যুদূতের মতো নিঃশব্দতা তুলে ধরে আর মানুষগুলো সেই সেলুনঘরের একেবারে কোণায় সেঁধিয়ে যায়। সে-সময় ঠিক ফুলবাড়ি থেকে একটি জিপ নিশ্চুপ এগিয়ে এসে সাডেন ব্রেক শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। জিপে চারজন সেনা, মধ্যখানে রকেট লাঞ্চার আর অ্যান্টি-ট্যাংক রাইফেল গ্রেনেড প্যাকেট, চালকের পাশে বসে থাকা বিশালদেহী কেউ হয়তো বড় পদের, তার হাতের চুরুট অন্ধকারে আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে আর নেভে; তখন একসঙ্গে কোরাসের মতো অচেনা ধ্বনি দিগন্তে প্রতিধ্বনিত হয়। সে হলো অবিডিয়েন্সির স্যালুট।
‘বাত ক্যায়া হ্যাঁয় সোলজার?’
‘ইধার কোয়ি মালাউন আদমি ভাগরাহা থা স্যার।’
‘বাহুত খুব।’

তারপর সেই টিম থেকে চুরুট দূরের কোনো জমে থাকা বৃষ্টি জলে আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ার অল্পক্ষণ পর সেলুনঘরের মধ্যে ধস্তাধস্তি আর আর্তচিৎকার ভেসে আসে। সেই কিশোরীর আর্তনাদ, সেই মহিলার, সেই বিধবার সাদা শাড়ি আয়নায় লজ্জায় লটকে থাকে, সেই পুরুষ দুজন ধাক্কা খেয়ে বাইরে আছড়ে পড়ে নিশ্চুপ আর শিশুটি কোথাও পড়ে অবিরাম কেঁদে কেঁদে রাতকে দীর্ঘতর প্রলম্বিত নরক বানিয়ে দিতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন বেরিয়ে এসে প্রগাঢ় নিশ্বাস নিতে নিতে বলে, ‘মালাউন লেড়কি বাহুত খাবসুরাত হোতি হ্যাঁয়। আব সাচ্চা মুসলমান পয়দা হোগা। সব লোগ মাজে কার লো, ইয়ে ইমানি ফরয হ্যাঁয়।

হবিবর-সাইফুল-রাজ্জাক বাংকারের পাশে, কদম গাছের টুপটুপ জলপড়া পাতার নিচে স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে, সেলুনঘরের ছায়ান্ধকারে কখনো ফরসা উরুর উথাল-পাথাল ঝলক আর আর্তচিৎকার-গোঙানি, কিছু তার দুর্বোধ্য বেহিসাব যন্ত্রণা, তাদের করার কিছু নেই; তারা পাথরের মতো স্থবির নিশ্চল সময়ের সাক্ষী। চোখের সামনে কী? হবিবরের হাতে পয়েন্ট তিন-শত-তিন রাইফেল, আঙুল ট্রিগারে গিয়ে বারবার হোঁচট খায়, সুড়সুড় করে, কোথায় বোল্ট, কোথায় তার নিজের মাথা আর মস্তিষ্ক, চারপাশে ঘনীভূত অন্ধকারে সব এলোমেলো রহিত বোধশক্তি, কোথায় দেশ আর রাজনীতি? অচেনা কোনো হাহাকার নিশ্চুপ কান্না বুক ঠেলে বিবমিষা হয়ে বেরোতে চায়, নির্মম প্রতিবাদ-প্রতিরোধে জিঘাংসা উসকে তোলে; কেন যে সেদিন ঘর থেকে বের হয়ে পুকুরপাড়ে খান এসেছে কিনা দেখতে চেয়েছিল? কেন আর সকলের মতো পালিয়ে যেতে পারে নাই? এইসব অস্বস্তিকর বিছুটি ভাবনা-দুর্ভাবনা সীমাহীন যন্ত্রণায় রাত ধারহীন ভোতরা করাতের দাঁতে ফালা ফালা হতে থাকে, অনেকক্ষণ; অনন্তকাল।

সেলুনঘরে তারপর কান্না থেমে গেছে, আকস্মিক জেগে ওঠা বন্যশূকরের ঘোঁৎ ঘোঁৎ আর নেই, বাইরে পুরুষ দু-জন শবদেহের মতো এঁদো কাদায় নিথর বসে থাকে, তারা কি জীবিত নাকি মৃত কে জানে। সেই নরককাণ্ড শেষ হলে জিপ পশ্চিমে চলে যেতে থাকে আর বাংকারের উপরে চারিদিকে সতর্ক জেড বি ফিফটি থ্রি মেশিনগান তাক করে রাখা সৈনিক এগিয়ে এসে বলে, ‘সাইফুল, মাদারচোদ লোগো কো আব মুসলিম বানা দো। পেহ্লে তওবা পড়াহো, আসতাগফিরুল্লাহ্ জাম্বিউ আতিবু ইলা ইহে...মালুম হ্যাঁয় তুমকো?’
‘জি স্যার।’
‘ক্যায়া তুমভি মাজে লোগে? পেহলে মাজে লে লো...মাজে লে লো ইয়ার, উসকে বাদ হা হা হা!’

সাইফুল কাঁধের রাইফেল আর খয়েরি ক্যাপ রাজ্জাকের হাতে দিয়ে সেলুনঘরে এগোতে শুরু করলে হবিবর একফাঁকে ধীরলয়ে বটগাছের আড়ালে চলে যেতে থাকে, বুঝিবা তার প্রস্রাবের প্রচণ্ড বেগ, সেই আলো-অন্ধকারে বৃষ্টির ছন্দোবদ্ধ রিমঝিম, মুহুর্মুহু ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুৎ চমক এবং বাতাসের শীত শীত ঢেউ ছাড়া কিছু নেই, আর স্তব্ধ গুমোট ঘরের প্রলম্বিত কান্না-আর্তনাদ শোকমাতমের মতো বিষাদ তেপান্তর জাগিয়ে দূরে-বহুদূরে ভেসে যায়, ভেসে যায়...যেতে থাকে। ঘরের পাশে অন্ধকার ঝোপের কাছে প্যাচপেচে কাদার মধ্যে পড়ে থাকে দুজন মানুষ, রুদ্ধশ্বাস-নির্জীব, তাদের মাটিতে নুয়েপড়া নতজানু চোখ মৃত মাছের মতো জমাট অন্ধকারে ডুবে ডুবে অলৌকিক কিছু হাতড়ে চলে, খনন করে আনতে থাকে কোনো বিশ্বাস, কোনো দেশ আর মানুষে মানুষে বিভেদের দেয়াল ভাঙা কোরাস স্তব।

হবিবর তখন পালাতে থাকে বুঝিবা নিজেকে তাড়িয়ে নিতে থাকে ধাবমান কান্নার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, দিগন্তের শেষসীমায় যা বিদ্যুৎ ঝলকানির মধ্যে মিশে গেছে, সে পালিয়ে যায়, যেতে থাকে, অন্য কোনো ঠিকানায়, অচেনা কোনো গন্তব্যে। সেলুনঘর থেকে তখন পুনরায় আরও একবার...বারবার আর্তনাদ গমক ছড়িয়ে যেতে শুরু করে; পেছনে পড়ে থাকে শোকমাতমের মতো দীর্ঘায়ত প্রলম্বিত কান্নার ধ্বুন। সেই শিশুর চিৎকার মধ্যরাতের দেয়ালে বড় অসহায় গহীন কোনো বিলাপ ছড়িয়ে দিতে থাকে।               

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়