ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

অনুবাদ গল্প || পুতুল বিষাদ

অনিকেত সুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ৩ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১২:৪৫, ৩ মার্চ ২০২৩
অনুবাদ গল্প || পুতুল বিষাদ

আমার নাম স্টিফেন অ্যামোনি। পেশায় ডাক্তার। আমার কাজ ও বসবাস লন্ডনে। বাড়ি টেমস নদীর ধারে। একটি পুতুলকে নিয়ে শুরু আমার এই গল্পের কাহিনি। গল্পটা অদ্ভুত হলেও সত্য। 

বছর পাঁচেক আগে অক্টোবর মাসের এক দিন। দিনটির কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। প্রতিদিনের মতো আমি যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি, তখন টেমস নদীর বুকে প্রভাত সূর্যের আলো ঝিলমিল করছিল। যথারীতি ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার একটি কপি কেনার জন্য আমি বেরিয়েছিলাম। যে রাস্তায় আমার বাড়ি, তার মোড়ে একটি ফুলের দোকান ছিল।

মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছতেই দোকানের বিচিত্র উজ্জ্বল রঙের ফুলগুলি আমার নজরে এলো। আমি অ্যাবি লেনের দিকে ঘুরে হাঁটতে থাকলাম। অক্টোবর মাসের কোমল উষ্ণ রোদটা বেশ লাগছিল আমার। কয়েক মিনিট পর আমি খবরের কাগজের দোকানে পৌঁছলাম। মনে পড়ল, আগামী সপ্তায় আমার ভাগ্নির জন্মদিন। তাই দোকানের জানালায় চোখ বুলিয়ে ওর জন্য একটা জুৎসই উপহার খুঁজতে লাগলাম। নানা খেলার সামগ্রী, খেলনা, কলম, কাগজ, বই, চকোলেট, মিষ্টি এসবের মধ্যে আমার দৃষ্টি ঘুরতে লাগল। ক’বছর ধরেই জিনিসগুলি আমি ওখানে দেখছি। যখন প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি যে ওসবের মধ্যে ভাগ্নিকে দেবার মতো বিশেষ তেমন কিছু নেই, তখনই আমার নজর গেল একটি পুতুলের দিকে- পুতুলকন্যা। জানালার এককোণে আধ-ঢাকা ওর শরীর। পুতুলটি কাপড়ের তৈরি এবং ওর মুখটা তুলির আঁচড়ে আঁকা। 

ঐ মুখের একটা বিশেষত্ব ছিল। খুব সুন্দর, কোমল আর আকর্ষণীয়; কিন্তু চোখ দু’টি ওর বিষাদে ভরা। একটি পুতুলের মুখ বরাবর অভিব্যক্তিহীন হয়। কিন্তু এ দেখছি একেবারেই আলাদা। হাবিজাবি নানা গাদা গাদা জিনিসের ভেতর ওর ওই বিষণ্ণ চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আমার মনটাও কেমন বিষাদে ছেয়ে গেল। জানি, একথা শুনতে অদ্ভুত শোনাবে। আমি দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে ওর মুখটা আরও কাছ থেকে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোকানটির মালিক ছিল জিম কার্টার নামে এক লোক।

‘সুপ্রভাত, ড অ্যামোনি,’ ভেতরে ঢুকতেই আমাকে উচ্ছল কণ্ঠে সম্ভাষণ জানালো জিম। ‘পত্রিকা নেবেন?’
‘হ্যাঁ, জিম। আর আমার ভাগ্নিকে একটা উপহার দেব ভাবছি। আগামী সপ্তায় ওর জন্মদিন।’ 
‘তাই?’ 
‘হ্যাঁ! আমি ওই কাপড়ের পুতুলটা দেখছিলাম। ঐ যে ওই কোণায়, অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে যে পুতুলটির।’

জিম খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘পুতুলটা কিছু অস্বাভাবিক। অন্যসব পুতুলের মত নয়।’
‘সেজন্যই তো দেখতে চেয়েছি ওটা,’ আমি বললাম।
‘এবং ওর দামটাও খুব বেশী।’ 

জিম পুতুলটা নিয়ে আমার হাতে দিলো। বিস্মিত আমি পুতুলটা হাত থেকে প্রায় ফেলেই দিয়েছিলাম। এত সুন্দরভাবে ওটা বানানো যে ওকে বেশ জীবন্ত মনে হচ্ছিল আমার। ওর পোশাকটা ছিল সম্পূর্ণ কাপড়ের তৈরি। হ্যাঁ, ওর মুখ রঙতুলিতেই আঁকা। এবার আমি তা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মনোহর! এই শব্দটাই আমার মনে এলো। ওকে গড়া হয়েছে হৃদয়ের গভীর ভালবাসা দিয়ে এবং এই ভালবাসা আমি পুতুলটার মুখে অঙ্কিত দেখতে পেলাম। 

আলতো হাতে পুতুলটাকে নামিয়ে রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওর দাম?’
‘বারো পাউন্ড, ড অ্যামোনি,’ জবাব দিল জিম। 
আমার মুখের বিস্মিত ভাবটা ওর নজর এড়াল না।
‘ওর দামটা বেশী। আমি তো বলেছি আপনাকে, বলি নি?’ 
‘হ্যাঁ, তা বলেছেন।’ 
‘লন্ডনের কেন্দ্রে এরকম পুতুলের দাম আছে কুড়ি পাউন্ড,’ জিম বলল। ‘কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমি এগারো পাউন্ড নেব।’ 
‘কে বানায় এ পুতুল?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘এত সুন্দর পুতুল যে বানাতে পারে, তার সম্পর্কে জানার কিছু কৌতূহল হচ্ছে আমার।’ 
‘ভদ্রমহিলা থাকেন হার্ডলি স্ট্রিটে। মাঝে-মধ্যে আমার দোকানে আসেন এই পুতুলগুলি নিয়ে।’
‘কী নাম তাঁর?’
‘নিশ্চিত বলতে পারছি না। ‘ক্যালামি’ বা এরকমেরই কিছু একটা হবে।’ 
‘দেখতে কেমন?’ 
‘লম্বা। মাথায় লাল চুল। খুব দামী কোট-হ্যাট পরেন। কিন্তু মুখটা থমথমে। কোনও কোমল অনুভূতি নেই ঐ মুখে। দোকানে এলে কথা বলেন খুবই কম। সত্যি বলতে, তিনি বেরিয়ে যাবার পর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’

কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল জিম, ‘আমি তাঁকে কখনও হাসতে দেখিনি। দুর্বোধ্য এক ব্যাপার। এরকম একজন মহিলা কিভাবে এত সুন্দর পুতুল বানায়।’ 
‘পুতুলটা নিচ্ছি,’ আমি বললাম। 

একটা পুতুলের দাম এগারো পাউন্ড হওয়াটা বাড়াবাড়ি। জিমের হাতে নোটগুলি গুণে দেবার পর নিজেকে কিছুটা বোকা বোকা লাগল। ওটা একটা উপহার, তা ঠিক। তবে আমি জানি ওটা কেনার আসল কারণ কী। আমি চাইনি, ওটা দোকানের জানালায় পড়ে থাক। পুতুলটা বাড়িতে এনে আমার শোবার ঘরে রাখলাম। আমার ঘর ভরে ওঠল ওর সৌন্দর্যে। 

একটা বাক্সের ভেতর ওকে আলগোছে রাখলাম আমি। তারপর একটা বাদামী-রঙ কাগজে বাক্সটা মুড়ে নিলাম। বিকালের দিকে কাছের ডাকঘরে গিয়ে পাঠিয়ে দিলাম ভাগ্নিকে। 

পরবর্তী দিনগুলিতে ঐ পুতুলটি, কিংবা ওর কোমল সুন্দর মুখ আর বিষণ্ণ চোখ দু’টি নিয়ে আমার ভাবনা থামল না। যে নারীটি ঐ পুতুল বানিয়েছে, জিমের বর্ণনা অনুযায়ী তার চেহারাটা আমি কল্পনা করলাম। এরকম একজন নারী কিভাবে এত সুন্দর পুতুল গড়তে পারে! বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন। সুতরাং, আদতে কে এই নারী? আমার জানার খুব আগ্রহ হল। কিন্তু এদিকে আবার ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। এলাকার শিশুরা অসুস্থ হতে লাগল। আমিও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। এবং শীঘ্রই ঐ নারী আর এবং পুতুলের কথা ভুলে গেলাম। কয়েক সপ্তাহ পর একদিন আমার ঘরের টেলিফোনটা বেজে ওঠল। ওপ্রান্তে এক নারীকণ্ঠ, ‘ড অ্যামোনি?’ 
‘হ্যাঁ।’ 
‘আপনি কি বাড়িতে রোগী দেখতে যান?’
‘হ্যাঁ, কখনও কখনও।’
‘ফী কীরকম নেন?’ কণ্ঠটা বেশ কর্কশ। মহিলা যেন ভাবছে, অসুস্থ ব্যক্তির চাইতে আমার কাছে অর্থটাই বড়। 
‘পাঁচ পাউন্ড,’ আমি বললাম। ‘কিন্তু আপনি যদি দিতে অক্ষম হন, সেক্ষেত্রে আমি ফী দাবি করছি না।’
‘সমস্যা নেই। আমি পাঁচ পাউন্ড দিতে পারব।’
‘আপনার নাম?’
‘রোজ ক্যালামিট। হার্ডলি স্ট্রিটে যে কেকশপটি আছে, তার পাশের বাড়িতেই আমি থাকি। দোতলায় আমার ঘর।’
‘শীঘ্রই আসছি,’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। 

দশ মিনিটের ভেতর আমি পৌঁছে গেলাম সেই বাড়িতে। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা ছিল সংকীর্ণ, নোংরা ও প্রায় অন্ধকার। সিঁড়ির শেষধাপে পৌঁছতেই একটা দরজা খুলে গেল। ‘ড অ্যামোনি?’ প্রশ্ন করল কর্কশ কণ্ঠ। 
‘হ্যাঁ।’ 
‘প্লীজ ভেতরে আসুন। আমি রোজ ক্যালামিট।’

মহিলাটা লম্বা। বয়েস চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। লাল চুল। কালো চোখ। লালচে উজ্জ্বল মুখ। দু’জনে সামনের কামরায় ঢুকলাম --- ঠাণ্ডা, কুৎসিত একটা ঘর। আসবাবপত্র সস্তা আর দেখতেও বাজে। কোণের একটা আলমারির ওপর অনেকগুলি ছোট ছোট কাচের বোতল চোখে পড়ল। তারপর দেখলাম পুতুলগুলি। কিছু দেয়ালে ঝুলছে, বাকিগুলি বিছানা জুড়ে এলোমেলো ছড়ানো। প্রতিটি পুতুল আলাদা, কিন্তু প্রতিটিই আমার কেনা সেই পুতুলের মতো সুন্দর। এই রুক্ষ্ম কর্কশ রসকষহীন মহিলাটি এগুলি বানাতে পারে, এটি আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হলো। রোজ ক্যালামিট আমার দিকে দৃষ্টি হেনে বলল, ‘একজন ডাক্তার হিসাবে আপনার বয়েসটা খুব কম।’ 

‘আমাকে দেখতে আমার বয়সের তুলনায় ছোট মনে হয়,’ আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম। ‘আপনি ভাবছেন, আমার বয়স খুব কম। আমি কি চলে যাব তাহলে?’ 

মহিলাটি বেশ জোরে হেসে ওঠল। ‘রাগ করার প্রয়োজন নেই, ডাক্তার। আপনি খুব সুদর্শন। সচরাচর একজন ডাক্তার এত সুদর্শন হয় না।’ 
‘এবং আমি একজন ব্যস্ত ডাক্তার,’ আমি বললাম। ‘রোগী কে, আপনি?’
 ‘না। আমার ভাতিজি। ও পেছনের কামরায় আছে। চলুন, যাওয়া যাক।’ 
অন্য কামরায় প্রবেশের আগেই আমি জানতে চাইলাম, ‘পুতুলগুলি বানায় কে, আপনি?’
 ‘হ্যাঁ। কেন?’

এই জবাব শুনে আমি মর্মাহত হলাম। আমি এটা প্রত্যাশা করি নি। ‘এরকম একটা পুতুল আমি কিনেছিলাম। জন্মদিনে একজনকে উপহার দেব বলে,’ শান্ত গলায় বললাম আমি। মহিলাটি আবার বিদঘুটে হাসি হাসল- ‘এবং নিশ্চয়ই বেশ চড়া দামে কিনেছেন?’
 পেছনের কামরার দরজাটি খুলতে খুলতে সে বলল, ‘ম্যারি, ডাক্তার এসেছে। আর হ্যাঁ, ডাক্তার, আপনি ওকে দেখে অবাক হবেন না। ওর বাম পা কিন্তু বাঁকা।’ 

ম্যারি নামের মেয়েটি বসে আছে চেয়ারে। জানালার পাশে। শেষ দু’টি বাক্য যদিও আমার উদ্দেশে বলা, তবু তা ওই মেয়েটিও শুনতে পেয়েছে, সন্দেহ নেই। দেখলাম ওর পাণ্ডুর মুখটায় একটা বেদনার ছায়া ফুটে উঠল; গাঢ় ডাগর চোখ দু’টিতে বিষাদ ঘনতর। 
কথাগুলি বলার কোনও দরকার ছিল না। খুব রাগ হলো আমার। সন্দেহ হলো, ওকে কষ্ট দেবার জন্যই মহিলাটি ওসব বলেছে। 

ম্যারির বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। কিন্তু ওকে দেখেই আমি বুঝলাম, ও অসুস্থ। ওর চোখ দুটির দিকে নজর ফেরালাম আমি। ‘কিছু একটা মরে যাচ্ছে ওর ভেতরে,’ আমি ভাবলাম। ম্যারিকে প্রথম দেখার পর থেকেই ওর সেই মিষ্টি কোমল বিষণ্ণ মুখ, ওর ক্ষীণ পলকা শরীর আর রোগাটে শুষ্ক চুলের কথা আমার সবসময় মনে পড়ত। আবার একটা কিছু আমাকে আনন্দও দিত। ওর তিনদিকে তিনটি টেবিল। এবং সেগুলির ওপর পুতুল বানানোর সব দরকারী জিনিস: উজ্জ্বলবর্ণ সব রঙ, নানা বর্ণ ও আকারের কাপড়ের টুকরা; আমি দ্রুত বুঝে নিলাম, ওর বাঁকা পা ওর অসুস্থতার কারণ নয়।  
আমি ওর বসার ভঙ্গি লক্ষ্য করলাম। ভাবলাম, আমি তো ওর পা সোজা করে দিতে পারি; আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে আমি সেটি পারব। 

কিছুক্ষণ পর আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ম্যারি, তুমি কি হাঁটতে পার?’
প্রশ্ন শুনে ও আমার দিকে একপলক তাকাল। তারপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলো মৃদু গলায়। 
‘প্লীজ, একটু হেঁটে আসো তো আমার দিকে,’ নিচুস্বরে আমি বললাম। 
‘ওহ্! নাহ্, আমাকে এটা করতে বলবেন না,’ ওর কণ্ঠে দ্বিধা। ‘আমি চাই না আন্টি কষ্ট পাক।’ 
কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে আমার ভাবনা ঠিক। তাই বললাম, ‘প্লীজ, একটু চেষ্টা করো হাঁটতে।’

খুব সাবধানে ও চেয়ার ছেড়ে ওঠল। ধীরপায়ে একটু একটু করে এগোতে লাগল। ওর বাম পায়ের দিকে মনোযোগ ফেললাম আমি। হ্যাঁ, আমার ভাবনাই ঠিক! ‘বেশ,’ মৃদু হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে; ওকে বোঝাতে চাইলাম যে এই পরীক্ষায় আমি সন্তুষ্ট। এবং হাত বাড়ালাম ওকে সাহায্য করার জন্য। ও আমার দিকে তাকাল। ফের ওর মুখটায় আমি সেই হতাশা ও বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখলাম। 
মনে হলো, আমার সাহায্যের জন্য ও নীরবে চিৎকার করছে। একবার দু’হাত ওঠাল আমার হাত ধরার জন্য, পরক্ষণেই আবার সেগুলি ওর দেহের দু’পাশে ফিরে গিয়ে স্থির হলো। 
‘কতদিন ধরে এরকম অবস্থা তোমার?’ আমি জানতে চাইলাম। 
রোজ ক্যালামিট ওর হয়ে জবাব দিলো, ‘ওর পা বাঁকা তো আজ দশ বছর ধরে। কিন্তু আমি আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে। ও অসুস্থ। আমি জানতে চাই, কী ওর অসুখ।’ 
মনে মনে বললাম, ‘হ্যাঁ, ও অসুস্থ। সম্ভবত মারা যাচ্ছে। ওকে দেখেই তো একথা মনে হয়েছে আমার।’

চাইছিলাম, রোজ ক্যালামিট কক্ষ ছেড়ে যাক। একা শুধু ম্যারির সাথেই কথা বলব আমি। কিন্তু মহিলাটি দাঁড়িয়ে রইল। উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, ‘আমি এখানেই থাকছি, ড অ্যামোনি। আপনি ম্যারিকে দেখুন। তারপর আমাকে বলুন, কী ওর সমস্যা।’ 
ম্যারির দেহ পরীক্ষা ক’রে আমি রোজের সাথে সামনের কক্ষে চলে এলাম। ‘ওর পা আমি সোজা করে দিতে পারি। এবং ও স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মতোই হাঁটতে পারবে,’ আমি বললাম। 
‘থামুন,’ চিৎকার করে উঠল মহিলা। ‘যথেষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি ওকে আর কিছুই বলবেন না। সবচে’ ভালো অভিজ্ঞ ডাক্তাররাও কিছু করতে পারেনি। কোনও তরুণ অর্বাচীন যেন ওকে আশার বাণী না শোনায়। যদি আপনি আবার একথা বলেন তো এখানে আপনাকে আর আসতে দেব না। আমি জানতে চেয়েছি, ওর সমস্যাটা কী। ও কিছু খাচ্ছে না। ঘুমাতে পারছে না। কোনও কাজও করছে না। এখন বলুন, ওকে পরীক্ষা করে কী পেলেন?’ 
‘দৈহিক কোনও সমস্যা ওর নেই মনে হচ্ছে। কিন্তু জানি, কিছু একটা ওকে ক্ষয় করে দিচ্ছে নীরবে। কিছু ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি আপাতত। ওর শরীরে বল ফিরে আসবে। কিছুদিনের মধ্যে আমি আবার আসব ওকে দেখতে।’ 
‘ওর পা সোজা করার বিষয়ে কিছু বলবেন না কিন্তু। বুঝেছেন? যদি তা করেন, আমি অন্য ডাক্তার ডাকব।’
‘বেশ,’ আমি বললাম। 
ম্যারিকে আবার দেখতে আসার জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। ভাবলাম, ওর শরীরে শক্তি ফিরে আসার পর ওর পায়ের ব্যাপারে কথা বলব। 

ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় নেবার জন্য তৈরি হলাম। ‘মনে করেছিলাম, পুতুলগুলি বুঝি আপনি তৈরি করেন,’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রোজ তার স্বভাবসুলভ রুক্ষ্ম ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘আমিই তৈরি করি। আমি ছবিগুলি এঁকে দিই। ম্যারি কাপড় দিয়ে বানায়। আর এই কাজ ওর পায়ের ব্যাপারে বেশী চিন্তা করা থেকে ওকে বিরত রাখে। ওর যে বিয়ে হবে না, বাচ্চাকাচ্চা হবে না, এই কঠিন সত্যটা ও যেন ভুলে থাকে, সেটাই আমি চাই।’ 
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। অক্টোবর মাসের ঝলমলে সূর্যালোকের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমার প্রতীতি হলো, রোজ মিথ্যা বলছে। আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলো না যে বিশেষ ধরনের ওইসব পুতুল তৈরির সমগ্র প্রক্রিয়াটিতে সুন্দর মনের একজন ব্যক্তিই কেবল জড়িত। রোজ ক্যালামিট ম্যারিকে ব্যবহার করছে টাকা কামানোর কলের মতো। 

এই আবিষ্কারে আমি যেমন আনন্দ পেলাম, তেমনই ম্যারির জন্য সমান দুশ্চিন্তাবোধও হলো। আমাকে জানতে হবে ওর সমস্যা কী। এবং জানতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। ওর মৃত্যু হবার আগেভাগেই।

পরবর্তী কয়েকটি ভিজিটে আমি ম্যারি সম্পর্কে আরও কিছু জানলাম। পুরো নাম ম্যারি নোলান। ওর বয়েস যখন পনেরো বছর, এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ওর বাবা-মা দু’জনেই মারা যায়; ম্যারি মারাত্মক আহত হয়। রোজ ক্যালামিট ম্যারিকে দেখাশোনা করবে বলে প্রস্তাব দিলে আইন রায় দেয় তার পক্ষে, কারণ অল্পবয়েসী অনাথ মেয়েটির ভার নেবার জন্য অধিক গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যক্তি তখন আর পাওয়া যায়নি। 

রোজ ভেবেছিল, ম্যারির বাবা ধনী। তারপর যখন সে জানতে পারল, সামান্য কিছু অর্থ ছাড়া আর কোনও সম্পদ-সম্পত্তি তাঁর নেই, তখন থেকে সে ম্যারির সাথে খারাপ আচরণ করতে শুরু করল। পীড়ন চালাতে লাগল ওর মনের ওপর। এবং ম্যারি ওর পায়ের কথা কখনও ভুলতে পারল না। ওর আন্টি তার আচরণে ম্যারিকে যেন সারাক্ষণ একথা মনে করিয়ে দিতে লাগল- ‘কোনও পুরুষ তোমাকে ভালবাসবে না। তোমার কখনও বিয়ে হবে না, বাচ্চা-কাচ্চা হবে না। কোনও পুরুষ বাঁকা পায়ের কোনও মেয়েকে বিয়ে করে না।’ 

বছরগুলি গড়াতে লাগল আর ম্যারিও ওর আন্টির কথা বিশ্বাস করতে শুরু করল। থেকে গেল তার সঙ্গে। সে যা বলত, ম্যারি তাই করত। আন্টিকে ছেড়ে যাবার কোনও কারণ সে খুঁজে পেল না। এভাবেই আশাহীন অসুখী এক জীবনে বন্দী হয়ে গেল ও। তারপর পুতুল বানাতে শুরু করল একদিন। 

রোজ ক্যালামিট দেখল পুতুলগুলি কী অদ্ভুত সুন্দর। শীঘ্রই বুঝে নিল, পুতুলগুলি অনেক টাকায় বিক্রি হবে। এবং তার ধারণা সঠিক প্রমাণিতও হল। কিছু পুতুল বিক্রি হবার পরে সে সিদ্ধান্ত নিল, ম্যারিকে সপ্তাহের প্রতিটি দিনই পুতুল বানাতে হবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। রোজের মনে ম্যারির প্রতি কোনও ভালবাসা ছিল না। 

কয়েক বছরে ম্যারি শত শত পুতুল বানিয়েছে। রোজ সেই পুতুল বিক্রির টাকা পেয়ে খুশী। এখন ম্যারি অসুস্থ। রোজ দেখল, ম্যারি মরে গেলে পুতুল বিক্রির ব্যবসাটা তার থেমে যাবে। টাকাও আসবে না। কিন্তু ম্যারি কেন ক্রমশ মরে যাচ্ছে? আমি এখনও জানি না। ওর আন্টিকে ও ভয় পায়, আমি দেখেছি। কিন্তু সেটাই কি কারণ হতে পারে? একটা সুস্পষ্ট জবাব আমার চাই।

ম্যারিকে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি আমার। কারণ, আমি যতক্ষণ ওর সঙ্গে থাকতাম, ওর আন্টিও থাকত আমাদের সঙ্গে। রোজ ক্যালামিট ওই ঘরে থাকলে ম্যারি কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করত। 
ম্যারিকে এখনও বলা হয়নি যে খুব সম্ভবত আমি ওর পায়ের সমস্যাটি সমাধান করে দিতে পারি। কেন ও জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, তা জানাই আমার জন্য এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ম্যারিকে পুতুল বানাতে নিষেধ করলাম। ওর জন্য কিছু বই আর চকোলেট কিনে আনলাম। 

পরবর্তী দশদিনে ওর অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে বলে মনে হলো। এরপর যখন আবার ওকে দেখতে এলাম, এই প্রথম মৃদু হাসল ও আমাকে দেখে।
‘হ্যাঁ, আগের চেয়ে একটু ভালো দেখাচ্ছে তোমাকে,’ আমি বললাম। ওর খুশিভরা মুখটা দেখে আমার ভালো লাগল। ‘আরও দশদিন পুতুল নিয়ে কোনও কাজ নয়, ঠিক আছে? আমি চাই না, তুমি কাজ কর। এই কয়দিন শুধু বিশ্রাম নাও, ঘুমাও আর বই পড়। তারপর দেখব কী করা যায়।’

আমি লক্ষ্য করলাম, রোজ ক্যালামিট আমার কথায় নাখোশ। 
কিছুদিন পর যখন আমি আবার ম্যারিকে দেখতে গেলাম, রোজ আমার জন্য সামনের ঘরটায় অপেক্ষা করছিল। ‘আপনাকে আর আসতে হবে না, ড অ্যামোনি,’ ঠাণ্ডা গলায় আমার উদ্দেশে বলল।
 ‘কিন্তু ম্যারিকে অবশ্যই...’ কথাটা শেষ করা গেল না। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে ত্বরিৎ বলে ওঠল রোজ, ‘ম্যারি এখন যথেষ্ট ভাল। বিদায়, ডক্টর।’ 
ঘরের কোণে বাক্সটার দিকে চোখ ঘুরে গেল আমার। দেখলাম ওটার ওপর সদ্য-বানানো তিনটি আনকোরা পুতুল। দেখতে সেগুলি বরাবরের মতোই সুন্দর। কিন্তু এবার ওদের চোখে ফুটে উঠেছে মৃত্যুভয়। হঠাৎ ম্যারিকে ঘিরে একটা শঙ্কা জেগে ওঠল আমার মনে। রোজ ক্যালামিট মিথ্যা বলছে, আমি বুঝলাম। মহিলাটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা ঠেলে আমি ম্যারির ঘরে ঢুকতে চাইলাম। কিন্তু আমি একজন ডাক্তার। এবং ডাক্তারকে যখন ঘর ছেড়ে যেতে বলা হয়, তখন তাই করতে হয় তাঁকে। আমি তখনও জানি না, ম্যারির সমস্যা কী, কিন্তু আন্দাজ করলাম, রোজ আরেকজন ডাক্তার ডেকেছে। তাই বিষণ্ণ মনে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। কেবল ভুলতে পারলাম না ম্যারির কথা। 

কয়েকটি দিন ম্যারির জন্য উদ্বেগে কাটল। কিছুদিন বাদে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রথম দিকে সামান্য মাত্রায়, কিন্তু দিন যতই গড়াতে লাগল, আমার অবস্থা ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছিল। এক বন্ধু ডাক্তারের পরামর্শ নেবার জন্য গেলাম। সে বলল, ‘কোনও সমস্যাই নেই তোমার শরীরে। হয়তো ইদানীং বেশী পরিশ্রম করছ।’ 
কিন্তু আমি জানতাম, এটা কোনও কারণ নয়। ক্রমে আরও খারাপ হল আমার অবস্থা। খাবারে অরুচি এলো। ওজন কমে যেতে লাগল। শরীর শুকিয়ে যেতে শুরু করল। ক্লান্তিবোধ আর অনিদ্রা চেপে বসল আমাকে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, সাহায্যের জন্য ম্যারি আমার কাছে আসতে চাইছে আর রোজ ক্যালামিট তার নোংরা দু’টি শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছে। ম্যারির কথা সারাক্ষণ ভাবতাম। আমি ওকে সাহায্য করতে পারি নি। অথচ আমার সাহায্য ওর দরকার ছিল। 

একরাতে আমার ঘুম আসছিল না। নিজের অসুস্থতার কথা ভাবতে ভাবতে শোবার ঘরে এদিক-ওদিক পায়চারি করছিলাম। মনে হলো, ম্যারির মতো একই অসুখে ভুগছি আমি। হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমার অসুখটা কী- আমি ম্যারি নোলানকে ভালবাসি। এবং যেহেতু ওর দেখাশোনা করতে পারছি না, তাই আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। 
সঙ্গে সঙ্গে আমি এও বুঝলাম কেন ম্যারি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ কেউ ওকে ভালবাসে না। পৃথিবীতে ওর এমন কেউ নেই যে ওর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওকে আশাবাদী করে তুলবে। ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। ওর আন্টি ওকে নিজের কাছে রেখেছে ওর পুতুল বেচে টাকা কামাবে বলে। ম্যারির কোনও বন্ধু নেই। আর নিজেকে ও কুৎসিত ভাবছে ওর পায়ের কারণে। ওই পুতুলগুলি ছাড়া ওর জীবন অর্থহীন।

নাহ্! ম্যারির সাথে আমার দেখা করতেই হবে। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ আমার কথা বলতে হবে, একা। নয়তো ও আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। সারারাত নিজের মনে কথাগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম আমি। রাতভর ভাবলাম ওকে নিয়ে। এবং পরদিন দোকানে জিম কার্টারকে ফোন দিলাম।

‘ড অ্যামোনি বলছি। জিম, আপনি কি আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’ 
‘যথাসাধ্য করব,’ জিম বলল। ‘গত বছর আপনি আমার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। আমি তা কখনও ভুলব না। বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?’ 
‘ধন্যবাদ, জিম,’ আমি বললাম। ‘রোজ ক্যালামিটের কথা মনে আছে আপনার? সেই পুতুল-বেচা মহিলা?’ 
‘হ্যাঁ, অবশ্যই!’ জবাব দিল জিম। 
‘সে যখন আপনার দোকানে আসবে, আমাকে ফোনে জানিয়ে দেবেন। তারপর তার সাথে দীর্ঘ সময় কথা বলবেন। আমি কুড়ি মিনিট সময় চাই। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে।’
‘ধন্যবাদ, জিম। আপনার এই সাহায্যের কথা আমি মনে রাখব।’ 

এরপর থেকে যখনই ঘরের বাইরে যেতাম, মনে হতো, জিমের কল এই এলো বুঝি! এবং প্রতি বিকালে ঘরে ফেরার সময় ওর দোকানের দরজায় নজর বুলিয়ে আসতাম। জিম মাথা নাড়ত। মানে, কোনও খবর নেই। 

একদিন বিকাল পাঁচটায় টেলিফোন বাজল। ‘সে এসেছে!’ জিম বলল অনুচ্চকণ্ঠে।। আর দ্রুত আমি দৌড়ে গেলাম সেই বাড়িটিতে, যেখানে ম্যারি থাকত। আবার একদৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম দোতলায়। সৌভাগ্যক্রমে দরজা খোলাই ছিল। ব্যস্ত পায়ে ম্যারির কক্ষটিতে ঢুকে দেখলাম, শরীর আরও শুকিয়ে গেছে ওর। আরও বেশী রুগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। ওর চারপাশে তখনও সেই রঙের কৌটাগুলি আর বেশকিছু টুকরা কাপড়। ভাবলাম, ‘মৃত্যুর আগে ও অন্তত আরও একটি পুতুল বানাতে চায়!’

মুখ তুলে চাইল ম্যারি। হয়তো ভেবেছিল রোজ এসেছে। কিন্তু আমাকে দেখে বিস্ময়ে ওর চোখ ছানাবড়া। 
আমার নাম ধরে ডাকল ও। ‘ড অ্যামোনি’ নয়। বলল ‘স্টিফেন’। 
‘ম্যারি!’ আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। আমি জানি, তোমার অসুখটা কী।’
‘এখন কিছু আর কী হবে!’ ম্যারির কণ্ঠ শান্ত নৈরাশ্যে ভরা। 
‘এখনও সময় আছে, ম্যারি। আমি বুঝেছি সব। আমি জানি কিভাবে তোমাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আমার কথা শোন মনোযোগ দিয়ে...’ 
‘না,’ চোখ বন্ধ করে শান্ত গলায় ও বলল। ‘কিছু বলো না, স্টিফেন, প্লীজ। আমি শুনতে চাই না। আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।’ 

আমি বসে পড়লাম এবং ওর হাত দুটি ধরলাম। ‘ম্যারি, প্লীজ শোন। বেড়ে ওঠার সময় শিশুরা পরিবার থেকে ভালবাসা পায়। যখন ওরা বড় হয়, তখন নিজেরাও অন্যদেরকে সেই ভালবাসা দিতে পারে। একইসাথে অন্যদের কাছ থেকেও ওরা ভালবাসা, সহানুভূতি, সুখ ও ভরসা পায়। তুমি শুধু একতরফা ভালবাসা দিয়েই গেছ, ম্যারি, কিন্তু কিছুই পাওনি। এখন তোমার ভেতরে ভালবাসার উৎসমুখ শুকিয়ে গেছে। দেবার শক্তি আর তোমার নেই।’

আমি বুঝতে পারছিলাম না, ও আমার সব কথা শুনতে পাচ্ছে কিনা। কিন্তু আমি প্রাণপণ চাইছিলাম ও বাঁচুক। আমাকে আমার কথা শেষ করতেই হবে। ‘তোমার আন্টি তোমার কাছ থেকে সমস্ত সুখ ও ভালবাসা কেড়ে নিয়েছে। এরপর আরও খারাপ কিছু করেছে সে। তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে তোমার সন্তানদের...’

কথা থামিয়ে আমি ম্যারির মুখের দিকে চাইলাম। ওর চোখ দুটি বন্ধ। দেহে কোনও নড়াচড়া নেই। ‘আমি কি ওকে মেরে ফেলেছি? এই আমি যে ওকে ভালবাসি?’ পরক্ষণেই টের পেলাম আমার হাতে ওর হাতের আঙুলের নড়াচড়া। ধীরে ও চোখ মেলে তাকাল। মনে হলো, আমার কথায় ও আনন্দ পেয়েছে। আমি আশান্বিত হলাম। আরও নিচুতে নামিয়ে আনলাম আমার কণ্ঠস্বর ‘ওই পুতুলগুলি ছিল তোমার সন্তান, ম্যারি। ভেবেছিলে তুমি মা হতে পারবে না। তাই ওইসব পুতুল বানিয়েছ। আর প্রতিটি পুতুলের ভেতর একটু একটু করে ঢেলে দিয়েছ তোমার হৃদয়ের ভালবাসা। খুব যত্ন দিয়ে, মমতা দিয়ে, নম্র কোমল হাতে গড়েছ ওদের আর ভালোবেসেছ নিজের সন্তানের মতো। তারপর তোমার আন্টি ওদের কেড়ে নিল তোমার কাছ থেকে। তোমাকে দেয়নি সে কিছুই। তুমি তোমার ভালবাসার সবটুকু দিতে লাগলে, উজাড় ক’রে, তিলে তিলে তোমার সবটুকু সঞ্চয় নিঃশেষ করে। মানুষ কখন মারা যায়? যখন তার ভেতরে আর কোনও ভালবাসা অবশিষ্ট থাকে না। ম্যারি!’ 

আমি আমার কথা শেষ করলাম। ম্যারির শরীরে মৃদু আন্দোলন দেখা দিলো। মনে হলো, ও আমার প্রতিটি কথাই শুনেছে, বুঝতে পেরেছে। ‘কিন্তু তুমি মরবে না, ম্যারি। কারণ, আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি শুনতে পাচ্ছ? আমি তোমাকে ভালবাসি এবং আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।’

শান্ত গলায় এবার কথা বলল ম্যারি, ‘আমাকে ভালোবাসো? কিন্তু আমার পা যে বাঁকা। কী করে ভালবাসবে আমাকে?’ 

‘কোনও ব্যাপার না, ম্যারি। তবুও আমি তোমাকে ভালবাসি,’ ধীর শান্ত কণ্ঠে আমি জবাব দিলাম। ‘তোমার আন্টি মিথ্যা বলেছে তোমাকে। আমি তোমার পা সোজা করে দিতে পারব। এক বছরের মধ্যেই অন্য মেয়েদের মতো একদম স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারবে তুমি।’ 

ম্যারির চোখে টলমল করে উঠল আনন্দাশ্রু। হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। হাত বাড়িয়ে দিলো আমার উদ্দেশে। আমি ওকে আমার দু’বাহুতে জড়িয়ে নিলাম। ও আমাকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল। 
ঠাণ্ডা থেকে বাঁচাতে এবার আমার কোটটা ওর দেহের চারপাশে জড়ালাম। ওকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ঘরের দরজার দিকে। হঠাৎ খুব জোরে সামনের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ শোনা গেল। কেউ একজন দৌড়ে এদিকেই আসছে। 

ম্যারির ঘরের দরজা সশব্দে খুলে গেল আর ভিতরে ঢুকল ক্রুদ্ধ রোজ ক্যালামিট। ভয়ে কাঁপতে শুরু করল ম্যারি। আমার কাঁধে মুখ লুকাল। কিন্তু রোজ ততক্ষণে দেরি করে ফেলেছে। এখন কিছুই করার নেই তার। সে জানে, এখন আমার বাহুবন্ধন থেকে কেউই আর ম্যারিকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।

যখন ম্যারিকে নিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, একটি শব্দও তার মুখ দিয়ে বেরোল না। ম্যারি আমার বাহুর মজবুত বন্ধনে বাঁধা। সামনের দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম রাস্তায়। বাইরে ঝকমক করছে সূর্যের আলো। মাথার ওপরে প্রশস্ত আকাশটা নীল। ম্যারিকে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম, রাস্তায় তখন শিশুদের কলকণ্ঠ, ওরা খেলছে আনন্দে। 

সেদিনের পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে এই কাহিনি আমি যখন লিখতে বসেছি, আমার স্ত্রী ম্যারি বাগানে খেলছে আমাদের তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে। জানালা দিয়ে আমি মা ও ছেলের খুনসুটি দেখছি। ঝোপের আড়ালে হঠাৎ লুকিয়ে গিয়ে ছেলে মাকে বোকা বানাতে চাইছে। বিকালের সূর্যের আলো এসে পড়েছে ম্যারির রাঙা হাস্যোজ্জ্বল গালে। ওর ইচ্ছেতেই আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ঘরে আসছে আর তিন মাস পর।

ম্যারি এখন আর পুতুল বানায় না। ওর দরকার হয় না। কিন্তু আমি নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানাই সেই দিনটিকে যখন আমি জিম কার্টারের দোকানের জানালায় সেই অদ্ভুত সুন্দর পুতুলটির প্রেমে পড়েছিলাম।

লেখক পরিচিতি:
মার্কিন ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প রচয়িতা পল উইলিয়াম গ্যালিকোর জন্ম ১৮৯৭ সালের ২৬ জুলাই, নিউ ইয়র্ক শহরে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ‘নিউ ইয়র্ক ডেইলি নিউজ’ পত্রিকায় গ্যালিকো কিছুদিন চলচ্চিত্র সমালোচক হিসাবে কাজ করেন। ১৯২৩ সালে তিনি ওই পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ক্রীড়া বিষয়ে নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি তিনি ছোটগল্পও লিখতে থাকেন। ১৯৪১ সালে তাঁর লেখা উপন্যাসিকা ‘দ্য স্নো গুজ’ প্রকাশিত হলে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বহুপ্রজ লেখক গ্যালিকো ৪১টি উপন্যাস এবং বহু ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসের কাহিনি ভিত্তি করে অনেক মঞ্চনাটক, মুভি ও টিভি সিরিজ নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ১৫ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। অনূদিত লেখাটি তাঁর ‘দ্য ডল’ নামক ছোটগল্পের ভাষান্তর।   

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়