ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আমরা এখনো পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত : মুর্তজা বশীর

অলাত এহসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ৮ জুলাই ২০২৩   আপডেট: ১৮:১৬, ৫ মার্চ ২০২৪
আমরা এখনো পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত : মুর্তজা বশীর

ছয় দশকের অধিক সময় চিত্রকলায় সক্রিয় ছিলেন মুর্তজা বশীর। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় তার আঁকা সিরিজ— ওয়াল, উইংস, এপিটাফ ফর দ্যা মার্ডারস, কালেমা তৈয়বা, কোলাজ ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু তিনি জনপ্রিয়তায় আটকে থাকেননি। ক্রমাগত বদলেছেন বিষয় ও প্রকরণ। চিত্রকলায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন। ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট বর্ষিয়ান এই চিত্রশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার অলাত এহ্‌সান 

অলাত এহ্‌সান : শিল্প রূপের অনুসন্ধান গুরুত্বপূর্ণ। তো আমাদের দেশের চিত্রকলার নিজস্ব রূপ কী অবস্থায় আছে? আপনি কিন্তু এই জায়গায় ফিরে আসতে চেষ্টা করেছেন। যে কারণে আপনি পালযুগের কাজ নিয়েও গবেষণা করছেন।

আরো পড়ুন:

মুর্তজা বশীর : পালযুগের কাজ; কালীঘাট নিয়ে। এগুলোকে আমি নিয়েছি বাংলার জলবায়ুতে সৃষ্টি হয়েছে বলে। পরে আমি পালযুগটাকে বাদ দিলাম এ কারণে যে, পালযুগের ছবিগুলোর যে করণ কৌশল এবং ভিসুয়্যাল ইফেকশন তা অনেকটা অজন্তার দেয়াল চিত্রের অনুচিত্রণ। কিন্তু কালীঘাট একেবারে বাংলার জলবায়ু থেকে গড়ে ওঠা, ফোক। তখন এটার ওপর বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়। আর মন্দিরের ওপর করলাম কারণ, এই মন্দিরের যে ফিগারগুলো কীভাবে এসেছে, এর কম্পোজিসন কীভাবে এসেছে। কারণ পেইন্টিং তো টু ডাবলস নো সারফেস। ত্রি-মাত্রিক না। এর মধ্যে কম্পোজিশনটা করেছে তা দেখার জন্য। এভাবে আমার অনুসন্ধান চালিয়েছি।

অলাত এহ্‌সান : আমাদের এখানে ডেভলপমেন্টটা কোথায় তাহলে? এখন বাংলাদেশের অবস্থান, উপ-মহাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে। আমরা কি নিজস্ব ফর্ম তৈরি করতে পেরেছি?

মুর্তজা বশীর : বাংলাদেশের শিল্পীরা তো আন্তর্জাতিক মানের— এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা এখনো পাশ্চাত্য দ্বারা প্রভাবিত।

অলাত এহ্‌সান : এটাও তো সত্য যে, জাপানের ছাপাই ছবি, আফ্রিকা ও অন্যান্য প্রাচ্য ভূখণ্ডের আদিম শিল্পীদের শিল্পকর্মের সান্নিধ্যে এসেই ইউরোপের আধুনিক চিত্রকলা প্রভাবিত হয়েছে এবং উন্নতি হয়েছে।

মুর্তজা বশীর : আজকে তো ইন্টারনেটের যুগ। ফলে এরা তো দেখছে পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব যে লোকশিল্প, এটা সম্পর্কে আমাদের ইন্টারেস্ট আর নাই। ফলে পাশ্চাত্য শিল্প এবং ইন্টারনেটের যে পাশ্চাত্য শিল্প এগুলোর দ্বারা আমরা অনেক বেশি প্রভাবিত। 

অলাত এহ্‌সান : আপনি যখন আর্ট শুরু করলেন তখন পৃথিবীতে বিখ্যাত হচ্ছেন পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি। আপনি যখন ইতালি গেলেন সেখানে এদের কাজ দেখার সুযোগ পেলেন। সেখানে তো এদের চর্চা হচ্ছে। 

মুর্তজা বশীর : এরা আমাকে কখনো ইনফ্লুয়েন্স করেনি। এমন কি মাইলে এঞ্জেলো, রাফায়েল আমাকে খুব প্রভাবিত করেনি। আমাকে বরং প্রাক-রেঁনেসা চতুর্দশ শতাব্দীর শিল্পীরা আন্দোলিত করে, এখনো। যেমন প্লোক্ট, সীমাভু, ফ্রায়েঞ্জেলেকো, মার্টিনি— এদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পাই। মানে আমার যে চিন্তাধারা, আমার যে আঁকার ধরন তাতে করে ওদের থেকে আমি যতটা অনুপ্রাণিত হই, মাইকেল এঞ্জেলো, টিসার, রাফায়েল— এদের থেকে হই না।

অলাত এহ্‌সান : তবে পাবলো পিকাসো নিয়ে পড়তে গিয়ে আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে মিল পেয়ে যাচ্ছি। আপনি যখন পার্টিতে যুক্ত হলেন তখন অনেকে আপনার এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছিল। এই যে একটা রাজনৈতিক দর্শনে যুক্ত হলেন এবং আপনার কাজের ভেতর তা প্রকাশ করলেন- এটা অনেক শিল্পী আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে নিয়ে আসলো। পিকাসোও কিন্তু বলেছিল, এটা ছাড়া উপায় কি? তিনি রাজনৈতিক দর্শনে, সরাসরি পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন। আপনিও হলেন।

মুর্তজা বশীর : ওভাবে অত ভাবিনি কিছু।

অলাত এহ্‌সান : আরো একটা জয়গা আমাকে বলতে হয় যে, আপনার সমসাময়িক ও পরবর্তীতে যারা খ্যাতি পেয়েছেন তাদের দেখি একটা ফর্ম একটা সিরিজ নিয়ে অনেক কাজ করছেন এবং ওই নামেরই তারা পরিচিতি পাচ্ছেন। আপনি কিন্তু অনেক সিরিজ ও আঙ্গিক জনপ্রিয় হওয়ার পরও আপনি বদলে ফেললেন।

মুর্তজা বশীর : এর কারণ হলো, আমি মনে করি কোনো একজন শিল্পী যখন কোনো একটা স্টাইল নির্মাণ করে এবং সেই স্টাইল যদি সমাজে গৃহীত হয়, তখন ওইটা ত্যাগ করে নতুন কিছুতে যাওয়াটা অনেকটা চ্যালেঞ্জের মতো। কারণ নতুন যেটা করবেন সেটা সমাজে সমাদৃত নাও হতে পারে। আমি যেটা মনে করি, একজন শিল্পী সে জীবন্ত। অতএব প্রতিদিন তার নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সে মিশরের মমি না যে, ফসিল হয়ে গেছে। অতএব আর্ট পরিবর্তন করতে সে বাধ্য। যার জন্য পিকাসো আমার ভালো লেগেছে। পিকাসো ধারাবাহিক কাজ করেছে। 

অলাত এহ্‌সান : আপনার অন্য ছবিগুলো যেমন ক্ষয়িষ্ণুতার ভেতরেও পথ নির্দেশ থাকে। এখানেও কি তাই?

মুর্তজা বশীর : কালেমার ব্যাপারটা অন্য। যদি চিত্রটা আমি দেখি, এটা হলো ফর্ম, অক্ষরগুলো তো ফর্ম। কতগুলো শেফ কতগুলো ফর্ম। আমরা তো চিত্রে ফর্মকেই সন্নিবেশিত করি। যেমন আপেল একটা সেপ। তো এগুলোই আমরা ক্যানভাসে আঁকছি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ— এর অক্ষরগুলো আমার কাছে কতগুলো শেফের মতো, কতগুলো ফর্মের মতো। এগুলো আমি চিত্রিত করেছি, কীভাবে এরেঞ্জ করা হয়, করেছি। তারপর রঙের গ্রামারের উপর ভিত্তি করেছি। যেমন প্রাইমারি কালার, সেকেন্ডারি কালার। প্রাইমেরি কালার বলতে যেমন বুঝায়— লাল, নীল, সবুজ। আর সেকেন্ডারি হলো: লাল আর কমলা, নীল দিয়ে বেগুনি হচ্ছে। আবার হলুদ আর নীল দিয়ে সবুজ হচ্ছে। আমি সেইগুলোর ভিত্তিতে করলাম। কথাটা হলো যে, আমি কখনো নাস্তিক ছিলাম না। আমি এখনো ধর্মে বিশ্বাস করি। আমাকে একটা কথা তুমি বল, তুমি মার্কসিস্ট হলে তোমাকে ধর্মহীন হতে হবে এটা কে বলেছে?

অলাত এহ্‌সান : ধর্মহীনতা আর মার্কসবাদিতা এক নয়। ধর্মহীনতা যদি মার্কসবাদই হতো, তাহলে ইউরোপ-আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি ধর্মহীন মানুষের বাস, সেখানে কমিউনিস্ট সরকার থাকতো। অথচ সেখানে কমিউনিস্ট একটা অভিযোগের নাম। আমাদের দেশে কমিউনিস্টদের ধর্মহীন আখ্যা দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন, বিরুপ মনোভাবে ফেলা ছিল ব্রিটিশ আর পাকিস্তানিদের প্রচারের অংশ।

মুর্তজা বশীর : মার্কসের একটা কথা আছে, ধর্ম আফিমের মতো, মানুষকে বশিভূত করে ফেলে। 

অলাত এহ্‌সান : এটুকু বললেই শেষ হয়ে যায় না। এর পরের লাইনটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘ধর্ম হচ্ছে প্রাণহীন পৃথিবীর প্রাণ, নির্দয় পৃথিবীর হৃদয়।’ সুতরাং ওইটুকু বলার মধ্য দিয়ে ভুল বোঝার সুযোগ হয়েছে।

মুর্তজা বশীর : আমি যখন বিলেতে গিয়েছি ’৯৯ সালে। এর আগেও আমি বিলেতে পড়তে গেছি, মিউজিয়ামে ঘুরতে গেছি। ’৯৯ সালে আমি অসুস্থ ছিলাম। তখন তো আমার হাতে সময় ছিল। সেই সময় কাজ ছিল নামি-দামী মানুষ কোন বাড়িতে থাকতেন খুঁজে দেখাযে, এই বাড়িতে মার্কস ছিল। আমি মার্কসের ওপর পড়তে শুরু করলাম। দেখলাম যখন তিনি ‘দাস ক্যাপিটাল’ লিখছেন, তখন তার সন্তানরা মারা যাচ্ছে। তাদের হাই গেটে কবর দিচ্ছেন। সবচেয়ে মজার হলো, হাই গেটে মার্কসের কবর আছে। তাঁর কবরের পাশে আমার ছবিও আছে। মার্কস যখন মারা গেল তখন এঙ্গেলস বেঁচে ছিল। এঙ্গেলসকে নিশ্চয় তিনি বলেছেন যে, আমাকে কবর দেবে। কিন্তু এঙ্গেলসের কোনো কবর নাই। কারণ এঙ্গেলস বলেছে- মারা যাওয়ার পরে তার দেহ পুড়িয়ে সমুদ্রের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। আমার কথা হচ্ছে, মার্কস যদি ধর্মে বিশ্বাস না করতেন, তাহলে তিনি সমাধিস্থ হলেন কেন?

অলাত এহ্‌সান : এটা তো সাংস্কৃতিক চর্চাও হতে পারে।

মুর্তজা বশীর :  তাহলে এসেঙ্গলস করলো না কেন? একটা জিনিস কিন্তু তোমাকে মনে রাখতে হবে। ধর্মের উৎপত্তি কিন্তু মানুষের মঙ্গলের জন্য। যখন গোরামি ছিল, কুসংস্কার ছিল সেই সময়ই কিন্তু ধর্মের উৎপত্তি। ইসলাম ধর্ম যখন হয়েছে, তখন জাহিলিয়াত যুগ। সমাজে কোনো বাছ-বিচার ছিল না। মাকে-মেয়েকে বিয়ে করে ফেলছে। ধর্মের উৎপত্তি কিন্তু মানুষের কল্যাণের জন্য, কিন্তু পরবর্তীতে এটাকে ব্যবহার করেছে মানুষকে শোষণ করার জন্য।

অলাত এহ্‌সান : অনেকে এবস্ট্রাক্ট আঁকেন। তো এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, রাষ্ট্র ও ধর্মতন্ত্রীদের পক্ষ থেকে বিতর্ক উঠতে পারে এই ভয়ে তিনি এবস্ট্রাক্ট আঁকেন। ফিগারেটিভ থেকে তিনি এবস্ট্রাক্টের দিকে চলে গেলেন। 

মুর্তজা বশীর : শোন, যে কথাগুলি বলা হচ্ছে যে পাকিস্তান আমলে তর্ক হতে পারে, ওই রকম কোনো অনুশাসন কিন্তু ছিল না। এইগুলি সব ফেব্রিকেটেড। আমি কোনো দিন দেখিনি যে, তোমাকে এই ধরনের ছবি আঁকতে হবে, তুমি মানুষ আঁকতে পারবে না, এই রকম কোনো বাছবিচার ছিল না।

অলাত এহ্‌সান : আজকের দিনে যে আমরা ভয় পাই— এটা আঁকা যাবে না।

মুর্তজা বশীর : ফিগারেটিভ কাজ কেউ করছে না? করছে তো। এবস্ট্রাক্ট করার কারণ হলো, তখন আন্তর্জাতিকভাবেই এই চর্চা শুরু হয়েছে। ওটাকেই আমরা কপি করছি। এবং বিক্রির জন্য করছি। বিশেষ করে বাংলাদেশে যে জন্য হয়েছে, বাংলাদেশে যারা বিত্তবান, গুলশান-বনানী-বারিধারা-নিকেতনে থাকে। সে এখন না হয় বিত্তবান। কিন্তু তার পরিবার তো গ্রাম থেকে এসেছে। তারা মা-বাবা তো ধর্ম ভীরু। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। সেখানে দেখেছে, মানুষের ছবি থাকলে হয়তো একটু দ্বিধা থাকছে। সেখানে এবস্ট্রাক্ট লাগাতে দিচ্ছে। কিন্তু আমার বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ধর্মে মানুষ আঁকা নিষেধ নাকি? উনি তো ধর্ম অনেক চর্চা করেছেন। উনি আমাকে বললেন, না। বললেন, তুমি আমার পোট্রেইট করতে পারো। এবং মৃত্যুর দশদিন আগে তিনি আমাকে সিটিং দিয়েছিলেন যে, তুমি আমার পোট্রেইট কর, কোনো সমস্যা নাই। আমি ওটা করেছিলাম। তিনি মারা যাওয়ার পর অবজারভারে প্রকাশ হয়েছে। 

’৬০ সালে, আমি তো কাগজের স্ট্যাম্প, নোট জমাই। সেই সময় আরবের নোটে, স্ট্যাম্পে কোনো ছবি ছিল না। এখন তো বাদশার ছবি থাকে। আমার বাবা বললনে, ইসলাম ধর্মে ভাস্কর্যটা নিষেধ। কারণ তা হুবাহু মানুষ। এবস্ট্রাক্ট ভাস্কর্য কিন্তু করা যায়। হুবাহু মানুষ আঁকলে সেটা তো বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। তুমি তো তাকে প্রাণ দিতে পারছো না। সেই সম্পর্কেই তিনি বলছেন, তুমি আমার পোট্রেইট করতে পারো কিন্তু পোট্রেইট দেখে যদি তোমার মধ্যে কোনো ভাব জাগ্রত হয়, সেটা কিন্তু শেরেক। তুমি যদি আমার পোট্রেইটে ফুলের মালা দাও, সেটা কিন্তু শেরেক। এই যে আমরা শহিদমিনার, কবর, মৃত নেতা-নেত্রীর ছবিতে ফুল দেই এটা কিন্তু শেরেক হয়ে যাচ্ছে। এটা ধর্ম না।
তুমি আঁকো, আমার পোট্রেইট আঁকো, বন্ধবন্ধু-জিয়াউর রাহমানে ছবি আঁকো। কিন্তু তাতে ফুল দেয়া হবে শেরেক। শহিদমিনারে ফুল দেয়াও শেরেক। 

অলাত এহ্‌সান : আপনি লেখালেখিতেও সক্রীয়। আপনি কবিতা লিখছেন, গল্প লিখছেন, প্রবন্ধ লিখছেন। আপনি এক লেখায় বলছেন, আমার চিত্র-পদ্য-গদ্য এই সূত্রে বাঁধা। এটা কিন্তু বিশ্বে বিরল। 

মুর্তজা বশীর : আমার গল্পে এই সমাজের যে কুসংস্কার-লিপ্সা-লোভ-ঘৃণা-কদর্যতা একজন সার্জনের মতো, শল্য চিকিৎসকের মতো আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করেছি। এটা আমার গদ্য। আবার আমার কবিতা কিন্তু উল্টো। সেখানে কিন্তু একটা রোমান্টিসিজম— একটা প্রেম,  ভালোবাসা আছে। উপন্যাস তিনটা আছে, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’, ‘অমিত্রাক্ষর’ আর ‘আলতামেরি’। এর মধ্যে ‘আলতমেরি’ বহুল প্রচলিত, থার্ড এডিশন। এটার মধ্যেও রোমান্টিসিজম। কিন্তু তার ভেতর দিয়েও সমাজের কথা আছে যে, সেই সময় কলকাতায় সমাজ ব্যবস্থা কি ছিল, পার্টিশনের পরপর রিফিউজি প্রবলেম— এগুলো আছে। আর আঙ্গিকগত ভাবে আমি ‘আলতামেরি’তে করতে চেয়েছি, আমার ল্যাঙ্গুয়েজটা চেঞ্জ করিনি। মানে অতীতেও আমি বললাম, বর্তমানেও আমি বললাম রেখেছি, চেঞ্জ করি নি। দুই জায়গাই বললাম রেখেছি। জীবন তো আর উপন্যাস না। কিন্তু আমরা যখন উপন্যাস পড়ি, দেখি একটা ধারা কিভাবে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ‘আলতামেরি’তে নানা রকম ঘটনা আছে। এক-একটা চরিত্র আসছে আবার চলে যাচ্ছে। নাই, আগা-গোড়া নাই। এটা হলো, মানুষের জীবন তো তাই। 

অলাত এহ্‌সান : আপনার কবিতার তো অনুবাদ হয়েছে।

মুর্তজা বশীর : আমার কবিতার বই লাস্ট বেরিয়েছে ২০১০-এ। আমার কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। 

অলাত এহ্‌সান :  এর একটা গুরুত্ব আছে যে, নিজের কবিতা নিজেই অনুবাদ করা। 

মুর্তজা বশীর : নিজেই করেছি। আর এটা দেখিয়ে নিয়েছি কাইসুল হক আর হাসনাত আবদুল হাইকে। আমি কেন অনুবাদ করলাম, তার একটা কারণ আছে। আমি যখন মাইকেল এঞ্জেলো বা ভ্যান গগের একটা ছবি কপি করবো, তখন মাইকেল এঞ্জেলো কি ভ্যান গগ যে-রকম এঁকেছিল সে-রকমই আঁকবো। কিন্তু মাইকেল এঞ্জেলোর ছবি যদি ভ্যান গগের মতো আঁকি কিংবা ভ্যান গগের ছবি যদি মাইকেল এঞ্জেলোর মতো করে আঁকি এটা ‘আফটার ভ্যান গগ’ বা ‘আফটার মাইকেল এঞ্জেলো’ হবে। যেমন পিকাসো করেছে ভেলাকুয়েজের কাজ তার মতো করে এঁকেছে, কিন্তু বলেছেন ‘আফটার ভেলাকুয়েজ’। ওটাকে ভিত্তি করে তবে আফটার বেলাকোজ।

আমরা যে কবিতা অনুবাদ করি, কবিতা পড়ি তার একটা নিজস্ব স্টাইল আছে। তার শব্দ চয়ন, তার পাঞ্চুয়েশন, তার লাইন বিন্যাস। আমি দেখলাম, এই যে ‘চল্ চল্ চল্/উর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ কবিতাটি অনুবাদ করেছে। কিন্তু চল্ চল্ চল্ তো চল্ বলে একটু ফাঁক দিয়ে তারপরে লিখেছে। কিন্তু অনুবাদের নজরুলের স্টাইলটা আর নাই। আমার কথা হলো অনুবাদককে তার স্টাইলটাও তো জানতে হবে। তার রিদমটাও আনতে হবে আমাকে। তারপর আমার কবিতা আমিই অনুবাদ করতে শুরু করে দিলাম। আমার যদি সাড়ে এগারো লাইন কবিতা হইছে, আমি সাড়ে এগারো লাইনই ইংরেজিতে করেছি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও যখন নিজের কবিতা অনুবাদ করেছেন, মূল সে অনুসরণ করেনি। আমি আক্ষারিক অনুবাদ করেছি। এবং পাঞ্চুয়েশনে যদি কমা, দাঁড়ি, সেমিকোলন আছে আমি তাও দেয়ার চেষ্টা করেছি। খুব কঠিন ওটা। 

আমি তো কবি না। কিন্তু আমার মধ্যে একটা কাব্যিক মন আছে। আমি শামসুর রাহমানকে বলেছিলাম যে, ছবি আঁকার একটা লিমিটেশন আছে। একটা মেয়ের চুল হঠাৎ বাতাসে উড়ে গেল— এটা যদি ছবিতে আঁকি তাহলে ইলাস্ট্রেশনের মতো মনে হবে। কিন্তু এটা কবিতায় আসে যে, রাস্তায় পাতা সরসর করে উড়ে গেল। যেমন আমার একটা কবিতায় আছে, ‘পাতাগুলো উড়ছে যেন চড়ুই পাখির ঝাক’। আমি যদি আঁকি এটা ইলাস্ট্রেশন হয়ে যাবে। পাতাগুলি চড়ুই পাখির ঝাকের মতো আঁকা যাবে না। হয় পাতা আঁকতে হবে, নয় চড়ুই পাখি করতে হবে। 

অলাত এহ্‌সান : আপনি যখন আত্ম-অনুসন্ধানের কথা বলেন, তখন এসএম সুলতাদের কথা চলে আসে। তার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কী রকম ছিল? 

মুর্তজা বশীর : তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হয়েছে। তিনি আমাকে ব্রাদার বলতেন। ’৯১ সালে যখন শিল্পাঙ্গণে আমিনুল ইসলাম দেবদাসকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে গ্যালারি উদ্বোধন করছে, সেখানে আমি একটা কাজ করেছিলাম। সুলতান পরে দেখে বললেন, ব্রাদার তুমি তো ইস্ট এন্ড ওয়েস্টকে মিলিয়ে ফেলেছ। এটা আমার ভাবনা ছিল যে, আমার ওয়েস্টার্ন টেকনিকটা থাকবে, কিন্তু ইস্টার্ন ভাব-ধারাটা থাকবে।  যেমন আমার এবস্ট্রাক্ট, যেমন ওইগুলো (দেয়ালে টাঙানো ‘পোট্রেইট অব দ্য মার্টার’ ছবির প্রতি ইঙ্গিত করে), আমি বলছি ইউথ দ্য আই অফ রেঁনার। রেঁনেসার দৃষ্টিতে, রেঁনেসার কী? রেঁনেসা হচ্ছে নিখুঁত। হান্ড্রেড পার্সেন্ট বাস্তবানুগ। কিন্তু ইমপ্রেশনিস্টদের মানসিকতা, যেমন ওই কমলাটা একই কমলাটা মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি অনেকগুলো কমলা লাগিয়েছি। কমলার মধ্যে অনেকগুলো কমলা আছে। এটা হচ্ছে রেঁনেসার নিখুঁত দেখার দৃষ্টি এবং ইমপ্রেশনিস্টদের মানসিকতা এই দুটোকে আমি একীভূত করেছি।

অলাত এহ্‌সান : ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ যে ভয় পাচ্ছেন, তার ছেলে আর্টিস্ট হবে, না-খেয়ে মরে যাবে। আপনাদের সময় একটা মাত্র ইন্সটিটিউশন ছিল, এখন অনেক।  তো এখনকার চারুকলার অবস্থাটা কী?

মুর্তজা বশীর : কথা হলো, এখন শিল্পীরা কেউ না খেয়ে মরে না। কারণ এখন টেকনলজি বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কম্পিউটারে গ্রাফিক্স করছে ইনকাম করে ভালো আছে। আর আমরা যখন ভর্তি হয়েছিলাম এখানে, তখন এটা ডিগ্রি, সাবজেক্ট না কি এটা ডিপ্লোমা— এটা কিন্তু আমরা জানতাম না।

অলাত এহ্‌সান : এর আগে আপনি কিন্তু বলছিলেন সাধনার জায়গা।

মুর্তজা বশীর : তো তখন ছবি বিক্রিও হতো না, তখন কেউ করতো কি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতো, বিড়ির প্যাকেটের লেভেল আঁকতো। কিন্তু এখন তো সে যুগটা নাই। এখন কেউ তো আর না খেয়ে নাই, ভালো আছে। কিন্তু আর্টিস্ট হচ্ছে না। আমাদের পরে হয়েছে দুইটা-তিনটা কিন্তু ওইভাবে হয়নি।  
 

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়