ঢাকা     শুক্রবার   ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২৮ ১৪৩১

ছোটগল্প

অন্ধকারের বাজি

মাহবুব আলী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩১, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩  
অন্ধকারের বাজি

আবু সালেক প্রশিক্ষণের প্রথম দিনেই পোস্ট লাঞ্চ সেশনে চমকে উঠল! রিসোর্স পারসন হিসেবে ইনি কে? চেনা চেনা লাগে! সেইসঙ্গে পুরনো ট্রাঙ্ক খোলার মতো ভেসে উঠল হারানো দিন- এ কি সেই আবদুল জব্বার? 

মনিটরিং চেকলিস্ট প্রিপারেশন ট্রেনিং। মেয়াদ তিনদিন। এনজিওতে জয়েন করার পর বিগত কুড়ি-একুশ মাসে পাঁচ-ছয়টি প্রশিক্ষণ হয়ে গেছে। দিনরাত খাটাখাটুনির চাকরির মধ্যে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কখনো বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়। নিজের মধ্যে ডুব দেওয়া যায়। একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়ার মতো হয়তো অবসরও। তিনটি দিন তেমন কিছু নয়, তারপরও অনেক কিছু।

আবু সালেক ভেবেছিল এই ফাঁকে আধপড়া উপন্যাসটা শেষ করে ফেলবে। সেই কোন্ সময়ে শুরু করেছিল, এক-দেড় মাস; উপন্যাসের চরিত্রগুলো মানস দৃশ্যে ভেসে ওঠে বটে কিন্তু কোথায় ছেড়েছিল মনে করে উঠতে পারে না। পরিচিতি সম্পর্কগুলো জটিল মনে হয়। তবু পুনরায় খুঁজে দেখতে ক্লান্তি আসে না। এমন হাজার ভাবনার মধ্যে আকস্মিক চমক সব এলোমেলো করে দিলো সেদিন দুপুরে। 

উনিশশ বিরাশি সাল। আবু সালেক ইউনিভার্সিটি ভর্তি হয়েছে অনেকটা বাধ্য হয়েই। একদিন বিকেলে বাবাকে মনের কথা জানিয়েছিল সে- ‘আমি আর পড়তে চাই না। ব্যাংকে লোক নেবে। অ্যাপ্লাই করি। সহজে চাকরি পাওয়া যাবে মনে হয়।’
‘শেষে ক্যাশিয়ার নয়, পিওনের চাকরি!’ বাবা স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, ‘ওসব চিন্তা বাদ দাও। মাস্টার্স শেষ করে আসো। চাকরির ভাবনা পরে করা যাবে। যত্তোসব ন্যারো অ্যাটিচ্যুড। জীবনের কোনো ভিশন নাই।’

আবু সালেক আর কথা বাড়ায়নি। বাবা মুডি মানুষ। কখন রেগে থাকে বোঝা মুশকিল। কে জানে নিজের স্বপ্নসাধ ছেলের মধ্যে দেখতে বা পূরণ করতে চায় কি না। সুতরাং আবু সালেক একদিন সুটকেসে বইপত্তর ঠেসে উত্তরা এক্সপ্রেসে উঠে বসে। একান্তই যদি পড়তে হয়, সাধ ছিল সমাজবিজ্ঞান বা নৃতত্ত্ব পড়বে, কিন্তু ভালো পরীক্ষা দিয়েও অপেক্ষমান তালিকায়; অবশেষে অপেক্ষায় বসে না থেকে যা পড়তে চায়নি, সেই বাংলায় প্রিভিয়াস ভর্তি হয়ে গেল। আবেগপ্রবণ মানুষ। তার উপর কৈশোরকাল থেকে সাহিত্যের ভূত আছর করে রেখেছে। এমন সময় বাসায় লজিং টিচার হয়ে আসে আবদুল জব্বার। ঠাকুরগাঁর বালিয়াডাঙি থানার কোনো এক গ্রামের ছেলে। ছেলে না বলে ‘দামড়া’ বলাই ভালো। গালের উপর ছোট ছোট খোঁচা দাড়ি, কিছু পাকও ধরেছে; বোঝা যায় অনেক বেলা করে স্কুলে সংযুক্তি। স্বাস্থ্য আর চেহারা-সুরত দেখে এমন কিছু আন্দাজ করা সহজ। কৃষিক্ষেতে পরিশ্রমী কাজ করার কারণে পেটানো শরীর আর চেহারায় লেপটে আছে অবিমিশ্র কাঠিন্য। সে যা হোক, আবদুল জব্বার ইন্টার শেষ করেছে। এখন দিনাজপুর শহরে এসে সরকারি কলেজে পড়তে চায়। আবু সালেক তখন একুশ-বাইশ। তারপরও লজিং টিচার সমীহ করে সালাম দেয়। বাড়ির বড় ছেলে বলে ‘বড় ভাই’ ডাকে। 

আবু সালেক চকিতে স্মৃতি থেকে ফিরে আসে। রিসোর্স পারসন কি তবে সেই আবদুল জব্বার? চেহারা-সুরতে আবদুল জব্বারের মতো মনে হলেও ইনি আধুনিক। ক্লিন শেভড্, পোশাক-আশাকে যথেষ্ট মার্জিত ও আভিজাত্যের ছাপ। কিন্তু সেশনে রিসোর্স পারসন নিজেকে ইনট্রোডিউস করেন এভাবে: ‘আমি এম. এ. জাবির খান। কনসালট্যান্ট। আমরা এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ফিল্ড অরিয়েন্টেড কিছু টুলস, কিছু কী পয়েন্টস্ ফর চেকলিস্টস্ তৈরির কাজ শেখার চেষ্টা করব।’

বিকেলের আবছায়া আলো এসে পড়েছে রুমের মধ্যে। কুড়িজন প্রশিক্ষণার্থী। তার মধ্যে জেন্ডার ব্যালেন্স হিসেবে আটজন নারীকর্মী। এনজিও-র কঠিন কাজে ইতোমধ্যে চেহারার লাবণ্য প্রায় মুছে গেছে। একসময় চারজন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে পাঁচটি গ্রুপ করে দেওয়া হলো। অনুসন্ধান করে উপায় আনতে হবে, মাইক্রো-ক্রেডিট কার্যক্রমের অন্তত পঁচানব্বই শতাংশ রিকভারি কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব? গ্রুপ কাজের আগে টি-ব্রেক। আবু সালেক এই ফাঁকে জাবির খানের কাছে এগিয়ে যায়। কণ্ঠে বিনয় গিয়ে জানতে চায়, ‘স্যার একটি কথা বলতে চাই।’
‘কী কথা?’
‘আপনাকে মনে হয় কোথাও দেখেছি। আপনার বাড়ি কি ঠাকুরগাঁর বালিয়াডাঙি থানা?’
‘নাহ্...আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জ।’
‘সরি স্যার, আমার খুব পরিচিত একজনের সাথে আপনার মিল খুঁজে পেলাম। তাই...।’
‘পৃথিবীরও টুইন আছে। হা হা হা! অকে।’

আবু সালেক কথা না বাড়িয়ে গ্রুপের দিকে এগোয়। তার অ্যানালেটিকাল পাওয়ার সন্তোষজনক। একটু ভেবেই দু-চারটি সূত্র বের করে দিতে পারে। যার কারণে কেউ কেউ তাকে নিজের গ্রুপে টেনে নিতে চেয়েছে, কিন্তু সংখ্যা গণনার নিয়মে তার গ্রুপ নম্বর তিন। এই গ্রুপে চারজনের মধ্যে একজন সেলিনা আকতার। উজ্জ্বল ফরসা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা অনেকেরই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। পীরগঞ্জ এলাকা অফিসের ক্রেডিট সহযোগী কর্মকর্তা। আবু সালেককে সরাসরি বলে ওঠে, ‘সালেক ভাই, প্লেনারি কিন্তু আপনাকে করতে হবে। আমি পোস্টারে লিখছি।’
‘আচ্ছা।’

আবু সালেকের মাথায় তখন স্ট্রাটেজি ফর সাকসেস্ফুল মাইক্রো-ক্রেডিট ইমপ্লিমেন্টেশনের বদলে ‘হা হা হা’ হাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে। আবদুল জব্বারের হাসিও এমন প্রাণখোলা ছিল। সে প্রত্যেকবার দাবাখেলা শেষে এভাবে হাসত; বিজয়ীর হাসি। আবু সালেক বারবার হেরে যায়। একদিনও জিততে পারে না। গ্রাম্য একজনের কাছে কেন বারবার হেরে যায়? তার বুকে খেলা শেষে মাৎসর্যের সঙ্গে সঙ্গে মর্মপীড়ার জ্বলন ওঠে। কখনো আবার দৃঢ় প্রত্যয় অনুরণন তুলে যায়। যেভাবেই হোক আবদুল জব্বারের কাছে খেলার এইসব কৌশল শিখে নিতে হবে। গুরু মারা বিদ্যায় জয় হবেই। এক-দুদিন কথা হয়। চেসবোর্ড টেবিলে মেলে দিয়ে বিবিধ মারপ্যাঁচ শোনা আর দেখা হয় কয়েকদিন, কিন্তু সে-সব আর স্মরণে থাকে না; মস্তিষ্কে ভাবনার বহুমাত্রিক বর্ণিল খেলা। প্রিভিয়াস পড়তে রাজশাহী যাওয়ার জোর প্রস্তুতি চলছে। মাস্টার্স শেষ করে একটি ভালো চাকরি জোটাতে হবে। পরিবারে আনতে হবে সচ্ছলতা। এ সবের মধ্যে আকাশে নীল ঘুড়ির মতো নিজের একান্ত ভাবনা গোত্তা খেয়ে উঁচুতে ওঠে। ফুরফুরে বাতাসে পাখনা মেলে দেয়। সেখানে কায়নার মুখ বারবার ভেসে ওঠে।

ছোট দুটি ভাইবোন ক্লাস এইট আর সিক্সে পড়ে। তাদের নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বসে আবদুল জব্বার। রাত সাড়ে নয় কিংবা দশে রাতের খাবার। আবু সালেক পাশের রুমে পাঠ্যবইয়ের আড়ালে গল্প-উপন্যাস পড়ে। রবীন্দ্রসংগীত মৃদু সুরের মায়জাল ছড়িয়ে দেয়। ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে...সখী যাতনা কাহারে বলে।’ মন বড়ই আকুল-ব্যাকুল। কোনোদিন বিকেলে গলি দিয়ে পিচকালো রাস্তায় দাঁড়াতে দাঁড়াতে দেখা হয়ে যায়। কায়না কাঁধের দু-পাশে বেণি ফেলে আশপাশ তাকিয়ে একেবারে কাছে এসে ফিসফিস করে, ‘সামনের শুক্রবার মডার্নে ছবি দেখব। নিয়ে যাবে?’
‘কী ছবি?’
‘মনের মতো বউ।’
‘আচ্ছা। ছবিটা দেখতে হবে। আমার মনের মতো বউ দরকার।’
‘আহা রে!’

এ সব গল্প-কাহিনি আর ফিসফিসে পড়ালেখা এগোয় না। আবু সালেক এইচএসসি আর বিএ পাসে কোনোরকমে উতরে যায়। এই দুর্বল সার্টিফিকেট নিয়ে কি সরকারি চাকরি হয়? তাই মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করার অদম্য স্বপ্ন-প্রচেষ্টা। বাংলা বিভাগে ভর্তি হতে না হতেই হলের সিনিয়র ভাই রিজভি আহমেদ সরাসরি বলে দেয়- এবার নিজের ব্যবস্থা নিজেকে করতে হবে। গেস্ট হয়ে আর কত? সে তো বটে! চক্ষুলজ্জা বলে কথা আছে। অগত্যা একে-ওকে ধরে কাজলার মোড়ে মোটর গ্যারেজের মতো এক মেসে ঠাঁই পাওয়া সম্ভব হলো। মাস শেষে তিরিশ টাকা ভাড়া। সুরম্য কোনো হলে সিট পাওয়া গেল না। তখন কোথায় গেল গল্প-উপন্যাস আর গানের ঝরনাধারা, সহজ অঙ্কের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ, মন আকস্মিক বেভুল পথে হেঁটে যাওয়ার মতো গভীর বিষাদে ভরে যায়। 

প্রশিক্ষণের গোধূলিবেলায় উদাস মনের রেটিনায় কায়নার মুখছবি ভেসে ওঠে। কেন এমন হলো? আবু সালেক নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পুনরায় আরও একবার কাতর হয়ে ওঠে। সে প্লেনারিতে যেতে পারে না। সেলিনা এগিয়ে কি চমৎকার ব্যাখ্যা করে চলে! আবু সালেকের মনে হয়, চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কায়না। আবু সালেকের গল্পের বই পড়ার অসম্ভব নেশা। বাবার কাছে থেকে পেয়েছিল আলমারি ভর্তি বই। সেই বই দিয়ে পাঠ শুরু। কায়না বই নিয়ে যায়। কোনোদিন বিকেলে এসে বই খুঁজে খুঁজে দেখে। এভাবেই একদিন চোখের উপর চোখ পড়ে। তারপর... সেই গল্প আর কেন? আচ্ছা দীর্ঘ এই আট-দশ বছর কি একযুগ কিংবা তারও বেশি সময় পর কেমন দেখতে হয়েছে কায়না? কয়টি বাচ্চাকাচ্চার মা? আবু সালেকের কিছু হলো না। বোনটির বিয়ে দিতে পারেনি। নিজের আর কি... সে কথা থাক। বাবা দেখে যেতে পারল না চাকরি। চাকরি বটে! এখানে-ওখানে স্বেচ্ছাসেবী বেগার খাটার পর লোকাল এনজিও। হাজারও রকমের কাজ। গালভর্তি কথা আর ভাষণ, কাগুজে প্রতিবেদন; আসলে ঋণ দেওয়া আর সুদ সমেত ফেরত আদায়। সুদের শালীন পরিভাষা সার্ভিস চার্জ। চুয়াল্লিশ সপ্তাহের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এসবই সারাদিন আর রাতের কর্মসূচি। কাজ আর কাজ। আবু সালেক নিজের জন্য একটু অবসর খুঁজে পায় না যে, স্বস্তিতে একবার নিশ্বাস নেয়। ছোটভাইটি এখনো এখানে-ওখানে চাকরির সন্ধানে ভেসে বেড়ায়। কবে আসবে একটু সুস্থির স্বস্তি? 

তিনদিনের প্রশিক্ষণ শেষ হয়ে গেল। মূলত তৃতীয়দিন লাঞ্চের পরপরই সমাপ্তি। আবু সালেক মাসের বাকি চার-পাঁচদিন মাঠপর্যায়ে মনিটরিং আর ডকুমেন্টেশন করবে ভেবে রেখেছে। সন্ধ্যায় তারই প্রস্তুতি নিতে নিতে মুভমেন্ট রেজিস্টারে ডিপারচার লিখে রেখে বের হবে এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ায় ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম- ‘সালেক সাহেব ক্লোজিং সেশনের পর আপনাকে দেখলাম না। কোন্ ফাঁকে বের হয়ে গেছেন?’
‘মোড়ে গিয়েছিলাম ভাই। কোনো সমস্যা?’
‘সমস্যা! না ঠিক তা নয়, জাবিরভাই আপনাকে খুঁজছিলেন। শেষে এটা দিয়ে গেছেন।’

আবু সালেক সন্ধ্যার আলোছায়ায় এনভেলাপ হাতে নিয়ে আরও একবার শিহরিত হয়। হাতের লেখা চেনা চেনা লাগে। অনেকদিন আগে হয়তো এমনই লেখা দেখেছিল। সে হস্তলিপি আবদুল জব্বারের। আবু সালেক অফহোয়াইট খাম ওয়ার্ক প্ল্যান ডায়রির মধ্যে রেখে রাস্তায় নেমে যায়। বেশ ভিড়। আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে প্যাডেলে চাপ দেয়। বাড়ি গিয়ে পড়ে দেখেবে কী আছে ওই খামে। 

চেনা সন্বোধন। আবু সালেকের মনে হয়, পুবের জানালা দিয়ে অতীতের চেনা বাতাস এসে ভাসতে ভাসতে পশ্চিমে হারিয়ে গেল। চার দেয়ালের মধ্যে থমকে রইল কিছু কথা কিছু অকথিত বিষাদ। তার চোখ ঝাপসা হলো প্রায়।

বড় ভাই
সালাম জানবেন। পরশুদিন আপনাকে দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আপনি এখানে কেন? একটি স্থানীয় পর্যায়ের ছোট এনজিও। এখানে আপনার থাকার কথা নয়। আপনি অনেক মেধাবী আর সৎ মানুষ। সচ্ছল পরিবারের দুধেভাতে বড় হয়েছেন। আমি দেখেছি আপনি কত পরিচ্ছন্ন আর শৌখিন! আপনার কেন একটি সরকারি বা ভালো চাকরি হলো না? এই প্রশ্নের জবাব হয়তো জানি অথবা জানি না, কিংবা কে জানে, জেনেও না জানার ভান করি। আমি আপনাদের ওখানে থেকে ডিগ্রি শেষ করে ঢাকায় ফকিরাপুলের এক মেসে ছিলাম। অনেকের কাছে ধর্ণা দিয়েছি। সরকারি চাকরিও পেয়েছিলাম, কিন্তু বেতন কম বলে ছেড়ে দিয়ে কনসালটেন্সি ফার্মে যোগ দিয়েছি। এখন আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আপনি জানেন, আমার বাবা অতি সাধারণ মানুষ। ঠাকুরগাঁ, পীরগঞ্জ, নেকমরদ কত না জায়গায় গেঞ্জি আর গামছা বিক্রি করতেন। অনেক কষ্ট করেছেন। আমাদের দিন খেয়ে-না-খেয়ে গেছে। আমি নিজেও মানুষের জমিতে পাইট-জোন বা মজুর হয়ে খেটেছি। প্রতিদিন ভালো দিনের স্বপ্ন দেখতাম। সেই তুলনায় আপনার বাবা বুদ্ধিজীবী মানুষ। পরিবারে কোনো অভাব-অভিযোগ নেই। তাঁর একটাই স্বপ্ন ছিল, আপনাদের পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করা। জীবনে প্রতিষ্ঠা এনে দেওয়া। আপনারা কেন পারলেন না? এই না পারার অক্ষমতা বা দোষ সমাজের যতটুকু, আপনাদের নিজেদের দায়ও কম নয়। চতুর আর কৌশলী সমাজে সহজ-সরলতার কোনো দাম নেই ভাই। এরা বোকা মানুষ। 

আপনি দাবা খেলতেন। ভালো খেলতেন। খেলার নিয়ম জানতেন, কিন্তু এড়িয়ে গেছেন খেলায় জেতার কৌশল। অনেক চাল আছে খেলায়। সময় আর সুযোগমতো চাল দিতে হয়। আপনি সেই চালের প্রয়োগ করতে পারলেন না। জীবন তো দাবা খেলা। যা হোক, এসব বলে আপনার মন খারাপ করে দিতে চাই না। আপনাকে দেখে কষ্ট পেয়েছি...তাই বললাম। সময় অনেক কিছু শেখায়। আপনি পরীক্ষায় খাতায় প্রশ্নের উত্তর নিজে থেকে বানিয়ে বানিয়ে মনের মতো করে লিখতেন। আমি শুনে বলতাম, বইয়ে উত্তর যা লেখা আছে সেটাই হুবহু উগড়ে দিলেই হলো। আপনি স্বীকার করতেন না। আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। এটাকে হার বলে না। তারপরও যুদ্ধ জয়ের জন্য কখনো কখনো নিজেকে হেরে যেতে দিতে হয়। দাবা খেলায় ঘোড়াকে সময়ে পেছনে যেতে হয়, সামনে সুযোগ বুঝে আড়াই ধাপে চেক দেবে বলে। আমি ক্লাসের শেষ বেঞ্চের ছাত্র। কেউ বলে, ডার্ক হর্স অর্থাৎ অন্ধকারের বাজি। আমার একটি বই দুটি ভালো কাপড় ছিল না, নতুন বই পাইনি, মনের মধ্যে লক্ষ্য ছিল; আমাকে অর্জন করতে হবে। কেউ দিয়ে যাবে না। প্রকৃতির পুরস্কারের অপেক্ষায় থাকিনি। জেনেছি কৌশলে পেতে হবে। এটাই জীবন। আপনার জন্য কষ্ট পেলাম। যদি কখনো সুযোগ আসে, আপনাকে ডাক দেব; আসবেন। আর কি, ভালো থাকুন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন। খোদা হাফেজ।
এম. এ. জাবির খান

আবু সালেকের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। জীবন আসলে জুয়া, কেউ হারে কেউ জেতে; সে জুয়ায় বাজী হেরে গেছে। কেউ না জানুক, কেউ তো জানে, সেই জানার পটভূমিতে পুনরায় কি সব কিছু নতুনভাবে সাজানো যায়? যায় না। সেই সময় হারিয়ে গেছে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে সেটা আর হয় না। আগামী দিন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে। সামনে শুধুই অন্ধকার।

আবু সালেকের বুকের গহীনে নিশ্চুপ কান্নার ঢেউ জাগে।  

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়