ঢাকা     সোমবার   ১০ নভেম্বর ২০২৫ ||  কার্তিক ২৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

আমার গল্প-উপন্যাসে সরলরৈখিক বয়ান নেই : শাহীন আখতার

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:২৪, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আমার গল্প-উপন্যাসে সরলরৈখিক বয়ান নেই : শাহীন আখতার

কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতারের শিল্পবুনন এমন যে, কথার ঢেউয়ে পাকিয়ে ওঠে কাল, স্বর আর নারীর ভোগান্তি। এই কথাসাহিত্যিকের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি; কুমিল্লার চান্দিনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। লেখার বিষয় উপন্যাস ও গল্প। ‘তালাশ’, ‘সখী রঙ্গমালা’, ‘ময়ূর সিংহাসন’ তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসের ফর্ম, কাহিনি, পটভূমি এবং সময় ভিন্ন। নিরীক্ষাকারী এই সাহিত্যিক অর্জন করেছেন এশিয়ান লিটারারি অ্যাওয়ার্ড, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কারসহ বিবিধ সম্মাননা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি

আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে ভেবেই ভালো লাগছে! কাল পেরিয়ে সত্যকে তুলে আনার জন্য অক্ষরে অক্ষরে সত্যের যে সুষমা আপনি গেঁথে দেন- এই গাঁথুনি সম্পর্কে জানতে চাই। একইসঙ্গে ‘তালাশ’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে কেবল দূরে আরো বহু দূরে আবিষ্কার করি। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে স্পর্শ করে যাওয়া ঘটনাগুলো সেই ঘটনারই পরম্পরা। যেন পাকিয়ে ওঠা ঢেউয়ের বুনন। 

আরো পড়ুন:

ধন্যবাদ। ‘তালাশ’ সম্পর্কে তোমার এই বর্ণনা চমৎকার- ‘পাকিয়ে ওঠা ঢেউয়ের বুনন।’ এটা ঠিক বেলাভূমিতে ভেঙেচুড়ে লুটিয়ে পড়া সামুদ্রিক ঢেউয়ের আগমুহূর্ত- তাই না? অনেক ফোর্সফুল আর রিদমিক। যাক, আমি ‘তালাশ’র কাহিনী-বুনন সম্পর্কে বলি। আমার গল্প-উপন্যাসে সরলরৈখিক বয়ান নেই। ভাবনাটা ভেঙে-ভেঙে আসে। তাই কাহিনীটাও আসে অনেক ভেঙে-ভেঙে; সময়টাও। অর্থাৎ সময়ের ধারাবাহিকতা বা ঘটনার পরম্পরা থাকে না। যেমন ‘তালাশ’ শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৭১-এর মার্চ মাস। সময়ের এই আগুপিছুর কারণেই হয়তো কেন্দ্রীয় চরিত্রটিকে তুমি দূরে, আরও বহু দূরে আবিষ্কার করেছ। একটা বই পড়ে পাঠকও পারে লেখককে ধাঁধায় ফেলতে, বাধ্য করে পেছন ফিরে তাকাতে এবং নিজের লেখাকে পাঠকের চোখ দিয়ে আবিষ্কার করতে। 

তুমি আরেকটি কথা বলেছ- ‘কাল পেরোনো সত্যকে তুলে আনা।’ এটা হয়তো আমার ঐতিহাসিক উপন্যাসের পঠন থেকে বলেছ। মানে আমি তা ধরে নিচ্ছি। এখানে আমি এর উত্তরটা দেব ‘তালাশ’ লেখার অভিজ্ঞতা থেকে। আমি যখন বইটা লিখতে বসি, গবেষণার সূত্রে আমার ঝুড়িতে তখন বীরাঙ্গনাদের ৯ মাসের নির্যাতনের স্মৃতিই নয়, তার পরবর্তী ২৬, ২৭, ২৮ বছরের স্মৃতির সম্ভার। তখন আমার নিজের কাছে একটা সরল যুক্তি ছিল, আমি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখছি ঠিক আছে। কিন্তু লিখতে বসেছি তো ২০০০ সালে। যুদ্ধপরবর্তী এই ৩০ বছরের স্মৃতি কী করে বাতিল হবে, যেখানে আমার উপন্যাসের চরিত্ররা এখনো ভুক্তভোগী! বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লেখা উপন্যাসে যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থাকতেই হবে। কেননা চোরাবালির তলদেশের অদৃশ্য স্রোতের মতো তাদের উৎপীড়িত হওয়ার ক্ষরণ আমরা খালি চোখে দেখি বা না-দেখি, তা আমৃত্যু বইতেই থাকে। 

আমার মনে হয়, ‘তালাশ’ উপন্যাসের বিষয়ই দাবি করছিল যুদ্ধের ইতিহাসের বাঁধা-ধরা ছক ভেঙে এর বিস্তার ঘটানো। না হলে অনেক নিগৃহীতের কাহিনী খারিজ হয়ে যায়, বাদ পড়ে যায়। ইতিহাসের এ ফাঁকটুকু সাহিত্য পূরণ করতে পারে। ‘কাল পেরোনো সত্যকে তুলে আনা’র দাবি করব না, তবে ‘তালাশ’ উপন্যাসে ইতিহাসের ওই ফাঁকটুকু পূরণের চেষ্টা হয়েছে।

‘তালাশ’র চরিত্র সৃষ্টির গল্প জানতে চাই।

‘তালাশ’ উপন্যাসে তো অসংখ্য চরিত্র, অনেক কণ্ঠ, অনেক স্বর। কেন্দ্রে ধর্ষণের শিকার নারী বা বীরাঙ্গনা। উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে বলার আগে আমি ‘তালাশ’ লেখার পেছনের কথা আরও একটু বলি। আমি ৯৬-৯৭-এ মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণা প্রজেক্টে ছিলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। আমার কিছু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ছিল। প্রকল্পটিতে কাজ করতে গিয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু খুঁজে পাই যা অকল্পনীয়! আসলে তখন আমার মতো অনেকেরই হয়তো ধারণা ছিল না ৭১ সালে কী ঘটেছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে মেয়েরা কতটা নির্যাতিত হয়েছিল; যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, স্বাধীন দেশে হালফিল তাঁদের কী অবস্থা, কীভাবে বেঁচে আছে বা বাঁচার জন্য লড়াই করছে। জানাবোঝার এ প্রক্রিয়ায় ‘তালাশ’র চরিত্র সৃষ্টির প্রেরণা পাই। বইটা লেখার কথা ভাবি। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র রেইপ সারভাইভার মরিয়ম। পাশাপাশি বর্তমান সময়ের একটি চরিত্র মুক্তি। উপন্যাসে আমার একজন সূত্রধরের প্রয়োজন ছিল, যে সময় ও ঘটনাকে জুড়বে। সে প্রয়োজনটা অনুভূত হয় উপন্যাসের সেকেন্ড ড্রাফটে। তখন দেখতাম, যারা বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তারা নিজেদের ট্রমার কথা খুব লিখতেন, এমনকি রেইপ সারভাইভারের ট্রমার চেয়েও কখনো কখনো তাদের ট্রমাটা সাক্ষাৎকার পড়ে বেশি মনে হতো। আমি তখন ঠিক করলাম মুক্তিকে এতো প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সে বিনিদ্র রাত কাটালেও তার কষ্ট-দুঃখ কখনো ভুক্তভোগীর দুঃখ-কষ্ট ছাপিয়ে যেতে পারে না। সে গল্পের প্রয়োজনে আসবে, আবার চলে যাবে। আড়ালেই থাকবে বেশির ভাগ সময়। এভাবেই তার জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে উপন্যাসে।

সম্প্রতি আপনার ‘মানচিত্র’ গল্পটি পড়লাম। মানবিকতা যেন একটি দেশ কিন্তু সে পরাধীন- সব মানুষের বোধের ভূমিতে স্বাধীনতা চায়। আপনার গল্পগুলোতে বাস্তুচ্যুতরা অনেকখানি জায়গাজুড়ে রয়েছে। এর কারণ কী? 

গত প্রায় এক দশক ধরেই আমি লিখছি বাস্তুচ্যুতি নিয়ে। কয়েকটা গল্প লিখেছি। দুনিয়াজুড়ে বর্তমান সময়ের বড় সংকট এটি। এখন গাজায় যা হচ্ছে একে যুদ্ধ বা ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতকরণ বললে সঠিক বলা হবে না, এটি এথনিক ক্লিনজিং, জেনোসাইড। রোহিঙ্গাদের ওপর তাই চলেছে। ‘মানচিত্র’ গল্পের ছেলেটি রোহিঙ্গা, লোকের মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে ওর নাম হয়ে গেছে ছোট রোহিঙ্গা। সে দক্ষিণ সাগরের একটি অফশোর ডিটেনশান ক্যাম্পে বন্দী। এর আগে থেকেই ছোট রোহিঙ্গা তার কওমের লোকদের জন্য একটি জায়গা খুঁজছে। দ্বীপ আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখছে সে। গল্পে তার একটা জার্নি আছে। সেটা ডিস্টোপিয়ান সিচুয়েশন থেকে ইউটোপিয়ান জার্নি। 

আপনার সাহিত্য ইংরেজি, কোরিয়ান ও জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রকাশনীগুলোর ভূমিকা কতটুকু ছিল? 

২০২২-এ ‘সখী রঙ্গমালা’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ বেরিয়েছে ইন্ডিয়ার ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ থেকে। অনুবাদক শবনম নাদিয়া তাঁর এজেন্টের মাধ্যমে বই প্রকাশের কাজটি করেছেন। ‘তালাশ’ অনুবাদের ক্ষেত্রেও অনুবাদকেরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁদের আমি চিনতাম না। যেমন ‘তালাশ’র ইংরেজি অনুবাদক ইলা দত্ত। তিনি দিল্লির বাঙালি। জুবান বুক হাউজের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি ‘তালাশ’ পড়ে জুবানকে বইটি ইংরেজিতে করার পর্রামশ দেন। জুবান আমাকে লেখে। কনট্রাক্ট পেপারে সই করি। ২০১১ সালে ‘দ্যা সার্চ’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়। কোরিয়ান অনুবাদের ক্ষেত্রেও অনেকটা তাই। ২০১৬ সালে প্রফেসর সিং হি জন (কোরিয়ান অনুবাদক) ‘দ্যা সার্চ’ পড়ে আমাকে ইমেইল করেন। তারপর আমাদের স্বাধীনতা দিবসের সময়ে একবার ঘুরেও যান বাংলাদেশ থেকে। বইটা ২০১৮ সালে কোরিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হয়। আর জার্মান ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করার উদ্যোগ নেন স্বয়ং প্রকাশক। তিনি জার্মান; মূলত সাউথ-এশিয়ার সাহিত্য ছাপেন। 

ইংরেজি, কোরিয়ান বা জার্মান ভাষার পাঠকদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেলেন? 

বিদেশি বা ভিন্নভাষী পাঠকের মতামত জানার সুযোগ কম। বুক রিভিউ বা আলোচনা থেকে যতটুকু জানা যায়; সেটাও বোদ্ধামহলের। ‘সখী রঙ্গমালা’ উপন্যাস ‘বিলাভেট রঙ্গমালা’ নামে ২০২২ সালে বেরোনোর পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রিভিউ হয়েছে। ‘তালাশ’র ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রেও তাই। বইটির কোরিয়ান অনুবাদের বেলায় আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। প্রকাশের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে আমি এশিয়ান লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে আমন্ত্রিত হয়ে গোয়াংজু যাই। তখন বইটা জাস্ট প্রেস থেকে এসেছে। বিভিন্ন পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল বইটার ‘বিষয়’ সম্পর্কে শুনেছে। কয়েকটা ইন্টারভিউতে আমি তাদের আগ্রহের দিকটা বুঝতে পেরে অবাক হই! বাংলাদেশে এত মানুষকে ‘তালাশ’ নিয়ে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখিনি। তারপর বিভিন্ন সময়ে প্রফেসর সিং হি’র ইমেইলে জেনেছি বইটা নিয়ে কোরিয়ায় আলোচনা হচ্ছে, রিভিউ ছাপা হচ্ছে। সিং হি থাকে বোস্টনে। একবার ও লিখল, একজন সাহিত্য সমালোচক ‘তালাশ’কে তুলনা করেছেন সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের ‘দি আনওম্যানলি ফেইস অব দি ওয়ার’, রুথ ক্লাগারের ‘স্টিল অ্যালাইভ’ বা মার্থা হিলারের ‘আ ওম্যান ইন বার্লিন’র সঙ্গে। এভাবেই হয়তো এশিয়ান লিটারারি অ্যাওয়ার্ড কমিটির নজরে পড়ে বইটা।   
 
‘আনন্দবাজার’ গ্রুপের টিভি চ্যানেল ‘এবিপি আনন্দ’ আপনাকে সাহিত্যে সেরা বাঙালি সম্মানে ভূষিত করেছে- এই প্রাপ্তির অনুভূতি কেমন?

‘এবিপি আনন্দ’র সম্মাননা ২০১৪ সালের। প্রায় এক দশক আগের। সে বছরই আমার ‘ময়ূর সিংহাসন’ উপন্যাসটি দুটি পুরস্কার পায়। হ্যাঁ, পুরস্কারপ্রাপ্তি সবসময়ই আনন্দের। এটা লেখালেখির স্বীকৃতি। সবচেয়ে বড় কথা পুরস্কৃত বইটি পাঠকের নজর কাড়ে।   

দেশ-বিদেশ থেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কোন পুরস্কারটা আপনার জন্য বিশেষ? 

আমার প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্তি ২০০৪ সালে। ‘তালাশ’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছিলাম ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’। আমার উপন্যাস পুরস্কৃত হয়েছে- প্রথমবার শোনার অনুভূতিটাই ছিল অতুলনীয়। অন্যদিকে এশিয়া লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড-২০২০ ছিল সত্যিকারের চমক। এটা কল্পনাতীত ছিল! তার আগে ২০১৬ সালে ‘তালাশ’র ইংরেজি অনুবাদ পড়ে প্রফেসার সিং হি জন আমাকে ইমেল করলে খুব আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম। কেননা বার্তাটা এসেছে এমন একজনের কাছ থেকে, যাদেরও যুদ্ধের ভয়াল অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে তাঁদের আগের জেনারেশন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভুক্তভোগী ‘কমফোর্ট উইমেন’। যারা প্রথমত যুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত হয়, পরে যুদ্ধোত্তরকালে নিজের দেশে। যেমনটা আমাদের দেশে বীরাঙ্গনাদের বেলায় ঘটেছিল। ‘তালাশ’ কোরিয়দের আবেগ ছুঁতে পেরেছে ভেবে আমি তখন খুব মুভড হই। আর চোখের সামনে দেখতে পাই ‘তালাশ’র চরিত্রগুলো নির্দিষ্ট সময় বা স্থানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে, এশিয়ার আরেক প্রান্তে প্রায় আড়াই দশক আগে সংঘটিত আরেকটি যুদ্ধের ভুক্তভোগী নারীদের সাথে জায়গা বদল করছে বা একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেদিক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার এ পুরস্কারটি অবশ্যই বিশেষ। 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়