ঢাকা     শনিবার   ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২০ ১৪৩১

বইমেলার উল্লেখযোগ্য একটি বই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৫, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:০৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বইমেলার উল্লেখযোগ্য একটি বই

শিল্পীকে চেনা যায় তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই; তবে তাঁকে আরও বেশি করে জানা সম্ভব হয় তাঁর নিজের আত্মকথন পাওয়া গেলে। অসামান্য শিল্পী ছিলেন জহির রায়হান। শুরু করেছিলেন কথাসাহিত্যিক হিসেবে, পরে চলে যান চলচ্চিত্রে। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর সাফল্য ছিল অনন্যসাধারণ। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৭ বছর; তাঁর মধ্যেই চলচ্চিত্রে এবং সাহিত্যে, এমনকি পত্রিকা সম্পাদনাতেও যে কাজ রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। অসামান্য এই শিল্পীর জন্য আরও অনেক কাজ অপেক্ষা করছিল। এবং কাজগুলো তিনি করতেনও, যদি বেঁচে থাকতেন।

অকালপ্রয়াত (আসলে শহীদ) এই শিল্পীকে কিছুটা নিকট থেকে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছেন কাজী জাহিদুল হক ‘জহির রায়হানের আত্মকথা ও অন্যান্য রচনা’ নামের এই বইটির লেখাগুলো সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে। জহির রায়হান ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে বিশ্বাস করতেন না; আগাগোড়া ছিলেন তিনি সমাজতান্ত্রিক, সংরক্ষণ না করায় তাঁর অনেক লেখাই হারিয়ে গেছে। যে লেখাগুলো ছাপা হয়েছিল সেগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কাজী জাহিদুল হক সেগুলো খুঁজে বের করে তার এই বইতে উপস্থাপন করেছেন। সেই সঙ্গে সুলিখিত একটি ভূমিকা যুক্ত করে জহির রায়হান সম্পর্কে জরুরি তথ্যগুলো একত্র করে দিয়েছেন। এজন্য তিনি প্রশংসা পাবেন, যদিও প্রশংসার প্রত্যাশায় তিনি কাজটি করেননি; করেছেন অন্তর্গত তাগিদেই।

শিল্পী জহির রায়হানের ভেতর ছিল তীব্র আবেগ, যার কথা তিনি আত্মকথায় লিখে রেখে গেছেন। নিজেকে বলেছেন আবেগের দাস। এই আবেগের এক দিকে ছিল দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ও নষ্ট সমাজের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা; অপরদিকে মানুষের প্রতি প্রবল ভালোবাসা। ঘৃণা এবং ভালোবাসা আসলে এক সঙ্গেই যায়, ঘৃণাহীন ভালোবাসা বলে কোনো কিছু নেই। ভালোবাসবেন তিনি দেশকে, অর্থাৎ দেশের মানুষকে, আর সে জন্যই ভীষণভাবে ঘৃণা করতেন মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিপীড়নকে। বয়স যখন সাতাশ তখনই তিনি বুঝে ফেলেছেন, ‘মানুষের প্রতি করুণা প্রদর্শনের মতো বড় বোকামি আর বোধ হয় দ্বিতীয়টি নেই। আমার করুণাবোধ আমাকে নিঃশেষ করে দিল।’ একটু পরেই আবার লিখেছেন, ‘যদি পারতাম দু’হাতে এ সমাজকে নিশ্চিহ্ন করে দিতাম।’ তাঁর আবেগ তাঁকে বলেছে, ‘ওই হিংস্র দানবের মুখোশগুলো খুলে ফেলো। ভেঙে ফেলো ফেরাউনের দুরাশায় স্বর্গ। নইলে তোমার কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে।’

এই আবেগই তাঁকে সাহিত্য, চলচ্চিত্র এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করে দিয়েছিল। তাঁর কাজগুলোর মধ্যে কোনো পরস্পর-বিচ্ছিন্নতা ছিল না। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি একবার নয়, তিন তিন বার জেল খেটেছেন। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন তিনি অল্প বয়সেই। একাত্তরে চলে গেছেন যুদ্ধে। সঙ্গে ছিল ক্যামেরা, মেধা ও আবেগ। তিনি ছবি তুলেছেন গণহত্যার। আরও অনেক ছবি তুলেছিলেন কলকাতায় থাকা অবস্থায়, যেগুলোকে কাজে লাগিয়ে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন বলে আশা করেছিলেন। ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘অনেক বেদনা, যন্ত্রণা আর আত্মদহনের ভেতর দিয়ে যা শিখলাম- অভিজ্ঞতা তার নাম। যদি বেঁচে থাকি, ভাবিকালে কোনো একদিন চলমান জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো কালির আঁচড়ে তুলে ধরব তোমাদের কাছে।

আর যদি মরে যাই, তাহলে এ দেশের মানুষগুলোর এক অনাবিষ্কৃত মহাদেশের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত রেখে যাব।

শেষপর্যন্ত সেটাই তো করলেন। চলে গেলেন, এবং বঞ্চিত করে গেলেন তাঁর দেশের মানুষকে। না, তিনি মরে যান নি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। একাত্তরে বাঁচতে পেরেছিলেন, বাহাত্তরের শুরুতেই, সদ্যস্বাধীন দেশে শহীদ হলেন; দেশের ভেতরে থেকে শাহাদাৎত্বরণকারী জ্যেষ্ঠভ্রাতা শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে।

তাঁর এই লেখাগুলো পড়তে গিয়ে এই প্রশ্নটা জেগে ওঠে, ভাইয়ের খোঁজে তিনি যে অবাঙালী-অধ্যুষিত মিরপুরে গিয়েছিলেন সেটা কার বার্তার কারণে, এবং তারপর কি ঘটেছিল, কারা তাঁর প্রাণ হরণ করলো, কীভাবে? এ নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন ছিল। হয়নি। জিজ্ঞাসাটা কিন্তু থাকবেই; সেটা আরও বেশি করে জেগে উঠবে তাঁর লেখাগুলো পড়লে, দেখলে ও স্মরণ করে।

জহির রায়হানের আত্মকথা ও অন্যান্য রচনা
সংগ্রহ ও সম্পাদনা: কাজী জাহিদুল হক
প্রকাশক : ঐতিহ্য 
মূল্য : ১৪০ টাকা
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়