ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

কেউ একুশের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চায়নি : মুর্তজা বশীর

অলাত এহ্‌সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৩, ৭ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ১৬:৩৯, ৭ মার্চ ২০২৪
কেউ একুশের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চায়নি : মুর্তজা বশীর

ছয় দশকের অধিক সময় চিত্রকলায় সক্রীয় ছিলেন মুর্তজা বশীর (১৯৩২—২০২০)। দেশভাগ-উত্তর সময় যে ক’জন তরুণ দেশের চিত্রকলার হাল ধরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে রাজনীতিতে সক্রীয় ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তার চিত্রকর্মে উঠে এসেছে সেই সময়। বিভিন্ন সময় তার আঁকা সিরিজ— ওয়াল, রেক, উইংস, এপিটাফ ফর দ্যা মার্ডারস, কালেমা তৈয়বা, কোলাজ ইত্যাদি জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু তিনি  জনপ্রিয়তায় আটকে থাকেননি। ক্রমাগত বদলেছেন আঁকার বিষয়বস্তু ও প্রকরণ। ছাপচিত্র, জলরং, তেলরং, মিশ্রমাধ্যমে কাজ করেছেন মুর্তজা বশীর। চিত্রকলায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন। ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট বর্ষিয়ান এই চিত্রশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার অলাত এহ্‌সান 

অলাত এহ্‌সান : আপনার প্রতিটি সিরিজে এক বা একাধিক ইনার মিনিং থাকে। আপনার আর্টের প্রতি আগ্রহ থেকেই আমি দেখেছি- অন্যান্যদের থেকে আপনার আর্টের বেসিক পার্থক্য হচ্ছে, তারা সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতাকে তুলে ধরছেন কিন্তু আপনি ক্ষয়িষ্ণুতার ভেতর দিয়ে মুক্তির পথ দেখাচ্ছেন। 

মুর্তজা বশীর : সমাজের অবক্ষয় দেখে; আমার মার্ক্সবাদী চিন্তাধারা থেকে আমি এক সময় প্রজাপতি আঁকা শুরু করলাম। প্রজাপতি খুব ভাইব্রেন্ট, এক জায়গায় স্থির থাকে না, খুব চঞ্চল আর ডানা খুব রঙ্গীন। আমি দেখলাম, মানুষকে যদি এটা দেই যে, আগামী জীবন সুন্দর! একটা কথা হলো, যেটা অনেকেই বলবে- যেমন ধরো, ওইগুলো (দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে ইঙ্গিত করে) এপিটাফ ফর দ্যা মার্ডারস। যারা শহীদ হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে। এটা অবশ্য প্রিন্ট। এটা তো বুঝবে না, সাধারণ মানুষ বুঝবে শহীদের সাথে কী সম্পর্ক? এটা আমি কেন আঁকলাম? আমি আঁকলাম প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন যোদ্ধারা মারা যেত, তারা মাথার সামনে একটা পাথর রাখতো। যে মুহূর্তে পাথরটা রাখা হতো সেই মুহূর্তে পাথরটা কিন্তু আর পাথর থাকতো না, ওটা প্রতীক হয়ে উঠত উন্মুক্ত আত্মার। মুক্তিযুদ্ধে এই যে এতগুলো মানুষ শহীদ হলো; এরা (রাজনীতিকরা) দেখবে তার পার্টির কিনা? তার পার্টির মানে ছাত্র ইউনিয়নের কিনা, ছাত্রলীগের কিনা? এই যে বলে- ত্রিশ লাখ মারা গেল; এরা সবাই কি ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন করতো? ফলে এদের কথা কেউ বলবে না। তুমি দেখবে আজ পর্যন্ত ঢাকা শহরের কোনো মেজর রাস্তা এই শহীদের নামে নাই। কথাটা হলো এই যে, একুশে ফেব্রুয়ারি চত্ত্বরটা, এটা যে কী সেটাই তো লোক জানে না। আমি দিল্লিতে দেখেছি পার্লামেন্ট ভবনের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা ওটা ‘ত্রিশে জানুয়ারি সরণী’। অর্থাৎ গান্ধীকে সেদিন গুলি করা হয়েছিল। আমার শহীদ মিনারের সামনের রাস্তাটার নাম যদি একুশের সরণী হতো, তাহলে লোকে জানার চেষ্টা করতো একুশটা কী? তাহলে তো একুশের চেতনা তোমার মধ্যে থাকতো। তুমি এখন একুশে ফেব্রুয়ারি এলে একুশের চেতনার কথা বলো, ১৬ ডিসেম্বর কি ২৬ মার্চ এলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলো।  

আমি যখন ফ্রান্সে তখন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং পরে রংপুর থেকে আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছিল আশেকুর রহমান— উনি তখন মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান, তো তাদের আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত মানুষ শহীদ হয়েছে এদের জন্য কী করছেন? বলল, আমরা বই লিখছি। আমি বলি, বই পড়বে কে? বরং আসেন বলে তাদের রাস্তায় নিয়ে গেলাম। একটা জায়গা দেখালাম যেখানে লেখা— এখানে অমুক, ১৬ বছর কিংবা ৯০ বছর, ফরাসি দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমি বললাম, ঢাকা শহরে এটা মেরে দেন। 

অলাত এহ্‌সান : এই প্রশ্নটা আপনার জন্য আমার ছিলই যে, আপনি যখন ইতালি গেলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংগ্রহে থাকা ভিউ কার্ড থেকে আপনি যে রাস্তাগুলো দেখেছেন, দেখে খুব আগ্রহী হলেন, তাতে অনেক ভাস্কর্য আছে শহীদদের, দেখে আমাদের দেশ নিয়ে আপনার কী কিছু মনে হয়েছিল?

মুর্তজা বশীর : না, আমি যেটা বলছি এটা ফ্রান্সের কথা, ১৭৭৩ সালের কথা। আমি বললাম, যে বাড়িতে জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সার ছিল ওখানে এমন একটা কিছু লাগিয়ে দেন যে, এখানে জহির রায়হান ও শহীদুল্লাহ কায়সার বসবাস করেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। যে বাচ্চাটা পাঁচ বছর-ছয় বছর, ওখান দিয়ে হেঁটে যাবে সে বানান করে পড়ে বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করবে— বাংলাদেশের জন্য জীবন কেন দিয়েছে? আমাকে আশেকুর রহমান তখন বলল যে, এত পাথর পাব কোথায়? আমি বললাম, পাথর কেন আপনি টিনের মধ্যে লিখে লাগিয়ে দেন। আসল কথা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আমরা বড় বড় কথা বলি, একুশের চেতনার কথা বলি, তার ফসল পলিটিশিয়ানরা নিয়েছে। কেউ একুশের চেতনা বাস্তবায়ন করতে চায়নি। তাহলে তো চার শহীদের নামে মেজর রাস্তার নাম হতে পারতো। এমন কি যুক্তফ্রন্ট সরকার যে ’৫৫ সালে হলো, এই যুক্তফ্রন্টও তো একুশের নামে রাস্তা করেনি। এ কে ফজলুল হক পারতো না, সোহরাওয়ার্দী পারতো না চার শহীদের নামে রাস্তার নাম করতে, করেনি। কারণ রাজনীতিবিদেরা তো বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ। এরা কখনোই চায় না এই চেতনাগুলো মানুষের মধ্যে থাকুক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চায় না এ জন্য যে, তাহলে তুমি তো কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নেবে, যে জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল— আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বিলীন করার জন্য, তা তুমি আদায় করে নেবে না? অতএব এইসব চেতনা, একুশে চেতনা যেন না থাকে এ জন্যই তাদের আপ্রাণ চেষ্টা।

অলাত এহ্‌সান :  ওয়াল, উইঙ্গার-এর মতো আপনার ছবির আরো কতগুলো সিরিজ ছিল, যেমন রেক নামে সিরিজ ছিল।

মুর্তজা বশীর : হ্যাঁ। এগুলো কতগুলো ছিল। রেক মানে ধ্বংস, বিস্ফোরণ, এটা যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন; আমি যেগুলো তথাকথিক অ্যাবস্ট্রাক্ট করেছি, সেগুলো নেচার থেকে নিয়েছি। যেমন গাড়ির কারখানা। যেখানে গাড়ি মেরামত করে সেখান থেকে আমি ফটোগ্রাফ করেছি। তারপর ইরাপশন— ওগুলো সব ওখান থেকে নিয়েছি। আমি প্রকৃতি থেকে নিয়েছি। যারা বিমূর্ত ছবি আঁকে, তারা সবাই কল্পনার জগৎ থেকে নেয়। আমি কোনোটাই কল্পনার জগৎ থেকে নেইনি। কারণ আমি বেসিক্যালি বিশ্বাস করি আমি রিয়ালিস্টিক আর্টিস্ট। আমার আর্টে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। প্রশ্ন উঠবে...

অলাত এহ্‌সান :  হ্যাঁ, এই অ্যাবস্ট্রাক্টের মধ্য দিয়ে আসলে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, তাদের জীবন সংগ্রাম প্রকাশ করা যায় কিনা?

মুর্তজা বশীর : এখন প্রশ্ন উঠবে, আপনার আর্ট তো সাধারণ মানুষ বুঝবে না। আপনি যে ‘এপিটাফ’ এঁকেছেন, এই শহীদ শিরোনাম, এটা সাধারণ মানুষ বুঝবে? অনেকে প্রশ্ন করতে পারে—আপনার ‘দেয়াল’ কি সাধারণ মানুষ বুঝবে? এখানে মাও সে তুং-এর একটা কথা আমি খুব মূল্য দেই। মাও সে তুং-এর দু’টো কথা খুব ইম্পর্টেন্ট। একটা হলো, শুধু ফর্ম হলে যেমন শিল্প হয় না, তেমনি শুধু কন্টেইন হলেও শিল্পী হয় না। ফর্ম এবং কন্টেইনের সমন্বয় করতে হবে। আরেকটা কথা মাও বলেছেন যে, তোমার সৃষ্টি তো সমাজের মানুষকে আপ-গ্রেড করার জন্য। আমি যদি শুধু সমাজের নীচু স্তরের মানুষের ছবি আঁকি তাহলে কিন্তু ওদের লেভেল ওখানেই থাকছে। আমাকে তার চেয়েও উন্নত করতে হবে। তাই না? তবে আমি যে ছবি আঁকছি তা তোমাদের মতো মানুষকে উন্নত করছে, কিন্তু কৃষক হয়তো তা বুঝবে না। তার জন্য অন্য আর্ট তো আছে। মূল কথাটা হলো তোমার স্তরটাকে উন্নত করা। 

অলাত এহ্‌সান :  আপনি যখন নন-ফিগার থেকে ফিগারে ফিরে এলেন, তাকে আপনি বলছেন আত্ম-অনুসন্ধানে ফেরা। আপনি পাল যুগের মোটিভগুলোকে আর্টে নিয়ে এসেছেন। এই রিয়ালিস্টিক হচ্ছে আপনার আত্ম-অনুসন্ধান?

মুর্তজা বশীর : ব্যাপারটা হলো মনেপ্রাণে ইউরোপে ছিলাম তো, ওয়েস্টার্ন আর্ট আমাদের খুব পড়ায়, ওরিয়েন্টাল আর্ট তেমন পড়ায় না। এই যে জাপানে কী হচ্ছে, চায়নায় কী হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশ বার্মায় (বর্তমানে মিয়ানমার) কী হচ্ছে আমাদের শেখায় না। এখন ব্যাপারটা হলো ইস্ট এবং ওয়েস্টের একটা সংমিশ্রণ করার চেষ্টা করেছি।

[আমি একটু বিশ্রাম নেই। আমার অক্সিজেন কম হয়ে যাচ্ছে। বলে তিনি অক্সিজিনের মেশিনটা টেনে সোফার কাছে আনলেন। তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চল বসে রইলেন। আঙুলে লাগানো মিটারটায় যখন অক্সিজেনের মাত্রা ৮৮ প্লাস দেখাল, তখন তিনি আলাপে ফিরে এলেন]

অলাত এহ্‌সান :  আমার একটা ব্যক্তিগত উৎসাহ আছে কার্টুন নিয়ে। শিল্পের যে সমাজমুখীতা আমার কাছে মনে হয়েছে কার্টুনের মধ্য আরো বেশি ভাবে করা সম্ভব। তো আর্টের উপর বই খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে, আমাদের দেশে আর্ট নিয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়নি। ফলে কার্টুন নিয়েও হয়নি। আমার মনে হয় কৌতুক খুব উঁচু সংস্কৃতির অঙ্গ।

মুর্তজা বশীর : কার্টুনের উদ্দেশ্য তো হাসি না। কার্টুনের উদ্দেশ্য হলো, যারা সত্যিকারের কার্টুন করেছেন তারা সমাজ সচেতন এবং সমাজকে তীব্র কষাঘাত করেছেন তার কৌতুক দিয়ে।

অলাত এহ্‌সান :  আমি যখন ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার আঁকা ছবির দিকে তাকাই, সেগুলো কার্টুন ছিল না, ছিল স্কেচ। কিন্তু ওগুলো কার্টুন হিসেবে পরিচিত আমাদের কাছে।

মুর্তজা বশীর : আসলে কার্টুনের মূল বিষয় হচ্ছে হাস্যরস থাকবে, কিন্তু সমাজের যে অবক্ষয়, সমাজের যে খারাপ দিক, তাকে চাবুক দিয়ে কষাঘাত করে জাগিয়ে তোলা। এটা হচ্ছে কার্টুনের মূল উদ্দেশ্য। 

অলাত এহ্‌সান : তো আপনার ছাত্রদের মধ্যে কার নাম আপনি স্মরণ করছেন, এই মুহূর্তে?

মুর্তজা বশীর : আমি তো ঢাকায় পড়াইনি। আমি পড়িয়েছি চিটাগং ভার্সিটিতে। ওখানে ছিল মশরুল করিম— আমার ছাত্র, তারপর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। খালিদ আমি যে বছর জয়েন করি সে-বছর পরীক্ষা দেবে, অতএব ক্লাস আমি পাইনি। আর চন্দ্রশেখর দে আমার ডাইরেক্ট ছাত্র। তারপর হাসি চক্রবর্তী, মারা গেছে। তারপর ফজলুল হক। চিটাগাংয়ে যারা আছে এমএ কাইয়ুম, দীপক। এরা আমার ডাইরেক্ট ছাত্র।

অলাত এহ্‌সান : আপনি রাজনীতিতে সক্রীয় ছিলেন। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কনভেনর ছিলেন।

মুর্তজা বশীর : পার্টি না ওটা, নাগরিক কমিটি। ওসমানীর ইলেকশনে। তবে আমি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলাম ’৫৮ সালে। 

অলাত এহ্‌সান : এটা কী করে সম্ভব হলো?

মুর্তজা বশীর : আমাকে ফজলে লোহানী নিয়ে গিয়েছিল। শোনো, আমার সাথে সেলিমের (সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে ইঙ্গিত করে) কোনো যোগাযোগ নাই এমনিতে। 

অলাত এহ্সান : কিন্তু আপনারা তো সমসাময়িক, মানে আপনারা ইউনিভার্সিটিতে সক্রীয়, তখন তিনি ছাত্র। 

মুর্তজা বশীর : না, সে তো আমার অনেক জুনিয়র, আমি তত দিনে ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়ে গেছি। 

অলাত এহ্সান : হ্যাঁ, আপনি অগ্রজ কমরেড। তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকাটা স্বাভাবিক ছিল না?

মুর্তজা বশীর : তবে এখানে এদের প্রতি আমার কোনো ভরসা নাই। লেজুড়বৃত্তি করছে। যেমন, আমি বলি তোমাকে, ’৭০ সালে ইলেকশনের সময় আমি মানিককে (সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক?)। হ্যাঁ, তখন তো ও বোধ হয় পার্টির সেক্রেটারিতে, তখন আমি বললাম— মানিক, এখন যুগটা হলো ন্যাশনালিজমের যুগ। এখন আমাদের শেখ মুজিবকে সাপোর্ট করতে হবে। সঙ্গে এটাও বলতে হবে, ন্যাশনাল বুর্জোয়া আমাদের সার্বিক মুক্তি দিতে পারে না। যেমন মাও সে তুং করেছিল মেন এনিমি হলো জাপান, মেন এনিমিকে প্রতিরোধ করার জন্য কুয়েমেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল। আবার সাইমনটনের সঙ্গে কুয়েমেনের বিরোধ ছিল। মানে চিয়াং কাইসাকের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সে সময় চিয়াং কাইসাকের সঙ্গেই তো সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। কিন্তু যখন জাপান আক্রমণ করলো তখন মূল শত্রু কে? জাপান। জাপান চিয়াং কাইসাকের শত্রু, মাও সে তুংয়েরও শত্রু। ওখানে চিয়াং কাইসাকের সাথে হাত মিলিয়ে জাপান প্রতিরোধ করবে, সেই সঙ্গে চিয়াং কাইসাকেও করবে। তখন আমাকে বলে যে, আরে আপনি কী বলেন! আমাদের আতোয়ার আছে, আমাদের অমুক আছে। ইলেকশনে তো দেখা গেল। তখন আমার বাড়ির যে মেট সার্ভেন্ট সে কাজ বন্ধ করে বলে— আমি যাচ্ছি। কেন? বলে যে, আমি ভোট দিতে যাচ্ছি। কিন্তু আমি ভোট দেইনি। কারণ ভোট দিয়ে কে ক্ষমতায় আসবে? যে আসবে সে তো ন্যাশনাল বুর্জোয়া। আমি এ জন্য ভোট দেইনি। 

অলাত এহ্‌সান : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ হয়েছিল?

মুর্তজা বশীর : না, কখনোই না। 

অলাত এহ্‌সান : কিন্তু আপনার বাবার সঙ্গে তো ভালো সম্পর্ক ছিল। তাঁকে সম্মান করতেন।

মুর্তজা বশীর : হ্যাঁ, সম্মান করতেন। তবে অবাক হয়েছি আমি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে কোনো জায়গায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা নেই! যে শহীদুল্লাহ ১৯১৭ সালে, মাইন্ড ইট, যখন তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে বক্তৃতা দিচ্ছেন— দাঁড়াও আমি পুরো বক্তৃতা পড়ে শোনাই, যা তোমার ইন্টারভিউতে থাকা উচিত হবে। শহীদুল্লাহ যেটা বলছিলেন, ১৯১৭ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ : 

‘হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাঙালি জাতি গড়িয়া তুলিতে বহু অন্তরায় আছে। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে হোক না কেন তাহা তো করিতেই হইবে। বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ব্যাতীত চলিতে পারিবে না, বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দু ব্যাতীত চলিতে পারিবে না। চিরকাল কি একভাবে যাইবে। জগতের ইতিহাস পৃষ্ঠে কি হিন্দু-মুসলমান মিলিত বাঙালি জাতি ফরাসি, ইংরেজ, ইটালিয়ান, জার্মান, জাপানি প্রমুখ জাতির ন্যায় দাম রাখিতে পারিবে না। আশা কানাকানি করিয়া বলে পারিবে।’

এই যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান মিলিত জাতি— এটা বিরাট কথা। এটা তো রবীন্দ্রনাথের বলার কথা। এটা তো আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বলার কথা। এরা তো কেউ বললো না। তারপর ধরো, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে, কার্জন হলে পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর (শহীদুল্লাহ) বক্তৃতা। সেখানে তিনি কী বলছেন : ‘বাঙালি হিন্দু বাঙালি মুসলমান ব্যাতীত চলিতে পারিবে না’। তিনি বলছেন— ‘মা প্রকৃতি আমাদের চেহারায় এমন একটি ছাপ মারিয়া দিয়াছে যে, টিকি-দাড়ি-টুপি-কাপড়ে তা পরিবর্তিত হইবার নয়।’ এত বিশাল, বাঙালি জাতির কথা তিনি বলেছেন। ১৯৪৮ সালে, সদ্য পাকিস্তানে, শহীদুল্লাহ বলেছেন বাঙালি জাতির কথা।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়