ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মনিরুল-মাসুরার অন্যরকম ভালোবাসা

শিরিন সুলতানা কেয়া, রাজশাহী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২   আপডেট: ২২:০৬, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
মনিরুল-মাসুরার অন্যরকম ভালোবাসা

মনিরুল ও মাসুরা

মনিরুলের উচ্চতা ৫ ফুট ১ ইঞ্চি। মাসুরার ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। ইটভাটায় কাজ করতে এসে মাসুরাকে দেখে অদ্ভুত মায়া জন্মে মনিরুলের। ভাটার জীবনে মাসুরার জন্য আসে ভালবাসার জোয়ার। তাই বিয়ের প্রস্তাব দেন পরিবারে। কিন্তু সবার ভয়, এই মেয়েকে বিয়ে করবে কেন? বিয়ের কিছুদিন পরই হয়ত মনিরুল পালাবে! বিয়েতে কেউই রাজি হলেন না। শেষমেশ পরিবারের অমতেই মাসুরাকে আদালতে নিয়ে বিয়ে করেন মনিরুল।

এরপর কেটে গেছে ১৯ বছর। মনিরুল (৪০) পালাননি। তার বাড়ি গাইবান্ধা। ২০০৩ সালের দিকে রাজশাহীর পবা উপজেলায় ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করতে এসে এভাবেই ক্ষুদ্রকৃতির মাসুরাকে (৩৩) বিয়ে করেন মনিরুল। বিয়ের পর মাসুরার পরিবারই প্রথমে মেনে নেয়নি। তখন স্ত্রীকে নিয়ে মনিরুল থাকতে শুরু করেন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। ইটভাটায় ছোট্ট অস্থায়ী ঘর করেও থেকেছেন। ধীরে ধীরে মাসুরার পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নেয়।

পবা উপজেলার বজরপুর গ্রামে মাসুরার ভাইয়ের জমিতে ছোট্ট একটা বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন মাসুরা-মনিরুল। এভাবে কেটে যায় ১১ বছর। এলো খুশির সংবাদ। মা হবেন মাসুরা। কিন্তু উৎকণ্ঠাও কম নেই। মাসুরার ওজন যে মাত্র মাত্র ১২ কেজি! ধীরে ধীরে মাসুরার পেটে বড় হতে থাকে সন্তান। মাসুরার ওজন বেড়ে হয় ২২ কেজি। ২০১৩ সালের জুনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সোয়া দুই কেজি ওজনের কন্যাসন্তানের জন্ম দেন মাসুরা। মনিরুল-মাসুরার জীবন আরও রঙিন হয়ে ওঠে। এখন মেয়েটা স্থানীয় স্কুলে যাচ্ছে।

মনিরুল এখন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান। বৃহস্পতিবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বের হওয়ার আগে ভ্যানের যত্ন নিচ্ছেন মনিরুল। বাড়িতে তার একটাই ঘর, একটাই উঠান। সামর্থ্য না থাকায় ঘরে জানালা লাগাতে পারেননি মনিরুল। ফাঁকা জানালায় টানিয়ে রাখা হয়েছে শুধু পর্দা। কিন্তু ওই ঘরে ভালবাসার কমতি নেই মনিরুল-মাসুরার। অনটন থাকলেও ৯ বছরের মেয়ে মরিয়ম খাতুনকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার।

মাসুরা বেগম বললেন, ‘‘সংসার জীবনে আমার স্বামী আমার কাছে অনেক অনেক ভালো। খুব ভালো। লাখেও মনে হয় এ রকম একটা ভালো মানুষ হয় না। আমার মতো মানুষকে সবাই টেনে নিয়ে বেড়াবে না। তা-ও আমার স্বামী আমাকে নিয়ে বেড়ায়। লোকে অনেক রকম কথা বলে। আমার স্বামী তখন বলেন— ‘মানুষের চোখে আমার বউ ছোট হতে পারে। আমার চোখে ছোট না’।’’

এখন সমস্যা বলতে অভাব-অনটন আর অসুস্থতা। মাসুরা বলেন, ‘খুব অভাব-অনটন। স্বামী দিন আনে দিন খাই। থাকি পরের জায়গাতে। ওরা ঘরবাড়ি ভাঙতে আসে। আমার তো থাকার জায়গা নেই। সব সময় অসুস্থ থাকি। হাঁটতে চলতে অসুবিধা হয়। এটাই সমস্যা।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গাইবান্ধা থেকে এখানে ইটভাটায় কাজে আসতাম। এসে আমি ভালোবাসা করি। তাকে বিয়ে করি। এই বিয়ে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের দিকে সমস্যা হয়নি। এদিক থেকে সমস্যা হয়েছিল। এখন সব ঠিকঠাক। আমি তো ভালোবেসে বিয়ে করেছি। সেভাবেই চলছি। মানুষের কথা শুনে তো লাভ নেই। ১৯ বছর ধরে এভাবেই চলছি।’

মনিরুল-মাসুরার দাম্পত্য জীবন দেখে খুশি আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা। মাসুরার চাচা জামরুল ইসলাম বলেন, ‘বিয়ের সময় আমরা সবাই অবাক হয়েছিলাম যে এই মেয়ে কীভাবে সংসার করবে? এখন সবই হয়েছে। জামাইটাও খুব ভালো। শারীরিক গঠনের কারণে মাসুরা এক কেজি চালের হাঁড়ি তুলে নিয়ে যাবে এ রকম ক্ষমতাও তার নেই। তাকে সবাই সহযোগিতা করে। বেশি সহযোগিতা করে তার স্বামী। তাদের দেখে আমরা খুশি।’

মাসুরার ফুফাত ভাই মাহবুব আলম বলেন, ‘মানুষ হিসেবে মাসুরার স্বামী খুব ভালো। মানুষ ভালো না হলে সংসারটা টিকত না। কিন্তু তারা ঠিকই একসঙ্গে থাকছে। একটা মেয়েও হয়েছে। এখন তাদের সমস্যা অভাব-অনটন। কারণ মাসুরা অসুস্থ। মেয়েটার পড়াশোনা আছে। সব মিলিয়ে একার পক্ষে মনিরুলের কষ্ট হয়ে যায়। তাদের সহযোগিতা দরকার।’

জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল জানালেন, মাসুরা এশিয়ার দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম মা। কয়েকদিন আগে তার ব্যাপারে জানতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তার কাছে ঘর হস্তান্তর করা হবে। আপাতত মাসুরা ও তার স্বামীকে ডেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি মাসুরাকে কথা দিয়েছি, তার স্বামীর কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আমাদের সহযোগিতা লাগলে সেটাও করব।’
 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়