ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কুমিল্লায় শ্রম বিক্রির বাজার  

রুবেল মজুমদার  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ১ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৯:০৫, ১ ডিসেম্বর ২০২২
কুমিল্লায় শ্রম বিক্রির বাজার  

মঙ্গলবার। আকাশে সূর্য ওঠেনি। হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। সেই কাক ডাকা ভোরে কুমিল্লার টাউন হল মাঠে পূর্বালী চত্বরে শ’তিনেক মানুষের জটলা। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটি কোনো হাট বা বাজার। প্রচলিত অর্থে এর কোনোটিই নয়। যদিও ‘হাট’ বলেন অনেকে। কারণ এখানে দিন চুক্তিতে শ্রমের বেচাকেনা হয়। আরো সরল করে বললে এটি আসলে দিনমজুরদের শ্রম বিক্রির বাজার।   

মাত্র ছয়শ থেকে সাতশ টাকায় সারাদিনের চুক্তিতে এই বাজারে বিক্রি হয় মানুষ! অবাস্তব মনে হলেও প্রতিদিন ভোর ৫ থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত বাজার জমজমাট। একেবারে পণ্য কেনাবেচার মতো চলে দর কষাকষি। দামে মিললে তাদের নিয়ে যাওয়া যাবে জেলার যে কোনো জায়গায়। যে কাজে তিনি অভিজ্ঞ করানো যাবে সেই কাজ।

তাদেরই একজন রামচন্দ্র দাস। অভাবের সংসার। বাধ্য হয়ে নিজের শ্রম বিক্রি করতে নিজেকেই টেনে নিয়ে এসেছেন বাজারে; সেই সাতসকালে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা রামচন্দ্র থাকেন কুমিল্লা নগরীর  শাসনগাছায়। 

কথা হয় তিতাস মিয়ার সাথে। চার সন্তানের জনক তিতাস এসেছেন দিনাজপুর জেলা থেকে। তিনি বলেন, আমাগো আর জীবন ভাই! ভোর ৫টায় এখানে আইছি, এখন আটটা বাজে। কোনো সাহেব আইলো না। একটু দেখি না হয় চইলা যামু। আইজকা মনে হয় কপাল খারাপ! তার মতো অভাবী অনেকে উত্তরাঞ্চল থেকে এসেছেন এই শহরে। অনেকেই স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে এই জীবন যুদ্ধে নেমেছেন। ফলে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে পারবেন না। 

কুমিল্লা নগরীর ঝাউতলার বাসিন্দা প্রভাষক তাসলিমা আক্তার বলেন, বাসার ছাদে মাটি দিয়ে ফুল বাগান করবো। শ্রমিক দরকার। তাই ভোরেই চলে এসেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে এখানে শ্রমিক পাওয়া যায়, তারা কাজেও বেশ আন্তরিক।

প্রতিদিনের এই বাজারে পণ্য বিক্রি হয় না। তাই বলে ক্রেতা-বিক্রেতার অভাব নেই। কেনাবেচা চলে ভোর থেকে। যদিও কবে থেকে বসছে এই হাট তার সঠিক দিন-তারিখ নেই। নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী মৃত্যুঞ্জয় হালদার ও স্থানীয় বাসিন্দা সুরেশ বোস জানান, প্রায় ১২বছর ধরে প্রতিদিন কামলার হাট বসছে।  স্থানীয়দের ভাষায় দিনমজুর-শ্রম বিক্রেতাদের বলা হয় ‘কামলা’। তাই বাজার হলেও এর নাম ‘কামলার হাট’।

সরেজমিনে দিয়ে দেখা যায়, হাটে প্রায় ৩০০ শ্রমিক পৃথক জটলা পাকিয়ে গল্পগুজবে ব্যস্ত। সবার কাছেই কাস্তে, হাতে ছোট ব্যাগে লুঙ্গি-গামছা আছে। এদের শ্রমের ক্রেতা মূলত অবস্থাসম্পন্ন কৃষক কিংবা যাদের শ্রমিক প্রয়োজন, তারা হাটে এসে দরদাম ঠিক করে নিয়ে যাচ্ছেন।

রুনি মিয়া (৪৫) বলেন, আগে রিকশা চালাতাম। গ্রামে রিকশা চালিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর৷ তাই এই হাটে শ্রম বেচতে আসেছি। যে টাকা পাবো, তাতে সংসার চলে যাবে। ফকির মিয়ারও একই কথা। রবীন দাসের (৫২) সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একসময় তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। বর্তমানে খুব খারাপ। তাই রোজ হাটে আসেন। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৫০০টাকা অথবা ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত শ্রম বিক্রি করে ৭০০ টাকা পান। সাহেবদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের কাজ করতে হয়।

তবে সবাই যে প্রতিদিন কাজ পান তা নয়। চানপুর গ্রামের শাহ আলম (৪৮) বলেন, ৫ থেকে ৭ বছর ধরে এ হাটে আসি। কোনো দিন আসামাত্র কাজ পাই। কোনো দিন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। যেদিন দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, সেদিন খুব কষ্ট হয়। অনেক সময় কারও ভাগ্যে কাজ জোটে, আবার কেউ শূন্য হাতে শুকনা মুখে বাড়ি ফিরে যায়।

কাজের জন্য লোক নিতে আসা সদর দক্ষিণ উপজেলা থেকে আসা আশ্বাব আলী  বলেন, সবিজ ক্ষেত তৈরির জন্য কামলা প্রয়োজন হয়। তাই যখনই কামলার দরকার হয়, খুব ভোরে চলে আসি এই হাটে। দামদরে মিললে কাজে নিয়ে যাই। 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়