বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হলেও এখনো উড়ছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা
সুদীপ্ত শামীম, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম
একই বাঁশের খুঁটিতে উড়ছে বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের পতাকা
কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা শেষ হওয়ার সাড়ে তিন মাস অতিবাহিত হলেও দেশের উত্তরের জনপদ গাইবান্ধায় এখনো উড়ছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ও শীতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে বাতাসে ছিঁড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে পতাকাগুলো। তাই ওই দুটি দেশসহ বিভিন্ন দেশের টাঙানো পতাকা যথাযথভাবে নামিয়ে সম্মানের সঙ্গে সংরক্ষণের দাবি সচেতন মহলের।
গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর, পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনো উড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেওয়া দেশগুলোর পতাকা। বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে অন্য দেশের পতাকা উড়ান এলাকাবাসী। কিন্তু অন্য দেশের পতাকার তুলনায় বাংলাদেশের পতাকা আকারে ছিলো অনেক ছোট।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাসা-বাড়ির ছাদ, গাছের ডাল, বাঁশের খুঁটিতে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ছাড়াও ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া, মরক্কো, স্পেনসহ বিভিন্ন দশের জাতীয় পতাকা টাঙিয়েছেন ওই দেশগুলোর ফুটবল সমর্থকরা। এই পতাকাগুলো এখনো পতপত করে উড়ছে৷
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে পতাকা উড়ানোর নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে ভিনদেশি পতাকা উড়ানোরও রয়েছে আলাদা বিধি। কেউ কেউ শুধু ভিনদেশি পতাকা একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ একই খুঁটিতে জাতীয় পতাকার সঙ্গে ভিনদেশি পতাকা উড়িয়েছেন। বাংলাদেশের পতাকা আইন ১৯৭২-এর বিধি অনুযায়ী বিদেশি পতাকা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে যে কোনো বিদেশি পতাকা উত্তোলন করতে হলে সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাও উড়াতে হবে। দুটি পৃথক স্তম্ভে উত্তোলন করতে হবে দুটি পতাকা। এক্ষেত্রে জাতীয় পতাকার নিচে থাকবে ভিনদেশি পতাকাটি। পতাকার সাইজটা একই সমান হতে হবে এবং বাংলাদেশের পতাকা ডানদিকে থাকবে। সূর্যাস্তের আগেই আবার পতাকা নামিয়ে ফেলতে হবে। এছাড়াও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন। জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নির্দেশ করে। সব সরকারি ভবন, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার নির্ধারিত ভবনে প্রতি কর্মদিবসে পতাকা উত্তোলনের বিধান রয়েছে।
গাইবান্ধার সচেতন মহল জানায়, জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতা, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন সময়ে ভিনদেশি পতাকা টাঙিয়ে সেই দলের সমর্থন করা হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হওয়ার সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সেই পতাকাগুলো নামানো হয়নি। যারা পতাকা টাঙিয়েছেন তাদের উচিত পতাকা নামিয়ে সম্মানের সঙ্গে সেটি সংরক্ষণ করা। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও পদক্ষেপ গ্রহণে স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তাহলেই পতাকার সম্মান ও মর্যাদা অটুট থাকবে।
আরিফুল ইসলাম নামের একজন আর্জেন্টিনার সমর্থক বলেন, ‘বাড়িতে প্রিয় দল আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙিয়েছি। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দেশ শিরোপা জিতেছে। আমার কয়েকজন বন্ধু ব্রাজিলের সমর্থক তাদেরকে ক্ষেপানোর জন্যই এখনো পতাকা নামাইনি। এতে আনন্দ পাই।’
ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থক লিমন মিয়া নামের এক তরুণ বলেন, ‘বিশ্বকাপ শুরুর অনেক আগেই প্রিয় দলের পতাকা টাঙিয়েছি। সেই পতাকা এখনো উড়ছে। তবে রোদে পুড়ে পতাকার রং চটে গেছে। এখন পতাকাটা নামাবো।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়ন চাচিয়া গ্রামের ফুটবল প্রেমিক বিপুল ইসলাম আকাশ বলেন, ‘একটি দলের খেলা আমার খুব ভালো লাগে। ভালোবেসে সেই দলের পতাকাও টাঙিয়েছিলাম। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরদিনই সেই পতাকা নামিয়ে সংরক্ষণ করেছি। সবার উচিত পতাকাগুলো নামানো এবং যত্মসহকারে সংরক্ষণ করে রাখা।’
লেখক ও সংগঠক কঙ্কন সরকার বলেন, ‘জাতীয় পতাকা একটি দেশের স্বাধীনতা, সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। প্রত্যেক দেশের জাতীয় পতাকাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো দরকার। আর এই পতাকা উঠানো এবং নামানোর ক্ষেত্রে যথাযথ সম্মান ও নিয়মের মাধ্যমে সম্পন্ন করা কর্তব্য। আমরা দেখি বিশ্বকাপ ফুটবল কিংবা বিশ্বকাপ ক্রিকেট কিংবা জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে আয়োজিত খেলার সময়ে কোনো দলের প্রতি সমর্থন বা ভালোবাসা জানাতে উক্ত দেশের জাতীয় পতাকার মাধ্যমে জানাই। আর তা জানাতে সে দেশের পতাকা টাঙানোর ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় নানা রকমের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময়ও এমন হয়েছে। কিন্ত, খেলা শেষ হওয়ার পর অনেক সময় পরেও টাঙানো পতাকা আর নামিয়ে রাখি না। ফলে আমাদের জাতীয় পতাকাসহ অন্য দেশের জাতীয় পতাকা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে স্যাঁতসেঁতে হয়ে বাতাসে ছিঁড়ে কিংবা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এটি এক ধরনের অসম্মান কিংবা মর্যাদা। তাই আমরা যারা পতাকা টাঙিয়েছি তাদের উচিত ওই দেশগুলোর পতাকা নামিয়ে রাখা। পাশাপাশি এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
সুন্দরগঞ্জের সাহিত্য সংগঠন ‘সুপ্রকাশ সাহিত্য সংসদ’র উপদেষ্টা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় সরকার বলেন, ‘দেশপ্রেম মানুষের একটি অনন্য গুণ। এই গুণটি মানুষকে অর্জন করতে হয় বোধ ও মেধার সমন্বয়ে। আধুনিক বিশ্বে যে কোনো প্রান্তের যে কোনো ঘটনা আমাদেরকে আন্দোলিত করে। বিশ্বকাপ ফুটবলও তেমনি। বর্তমানে খেলাধুলার সঙ্গে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদ পরস্পর জুড়ে গেছে। কিন্তু ফুটবলকে কেন্দ্র করে যে পতাকা প্রদর্শনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে সেটির নিয়ন্ত্রণ না করলে উৎসবের আনন্দে বিতর্ক তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখনো ভিনদেশি পতাকা উড়তে দেখা যায় বিভিন্নখানে অথচ বিশ্বকাপ শেষ বহু আগে। আমরা আনন্দ ভাগাভাগি করবো কিন্তু এও ভুললে চলবে না যে পতাকাটি কখন নামাতে হবে।’
বিধিবহির্ভূতভাবে ভিনদেশি পতাকা উড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় আমাদের জাতীয় পতাকার সঙ্গে একই খুঁটিতে বিধিবহির্ভূতভাবে ভিনদেশি পতাকা উড়ানো হয়েছে৷ খেলা শেষ হওয়ার সাড়ে তিনমাস পরেও এখনো কোথাও কোথাও এসব পতাকা দেখা যাচ্ছে। মূলত জাতীয় পতাকার অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। দ্রুত এসব পতাকা নামিয়ে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।’
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. অলিউর রহমান বলেন, ‘বিধি না মেনে জাতীয় পতাকা ও ভিনদেশি পতাকা উড়ানো ঠিক না। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শেষ হওয়ার পরপরই পতাকাগুলো নামানো উচিত ছিল। যারা পতাকা টাঙিয়েছেন তাদের উচিত দ্রুত পতাকা নামানো।’
মাসুদ
আরো পড়ুন