ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

জীবন চক্রে পরিবর্তন, এডিস মশা এখন আরও ‘শক্তিশালী ঘাতক’

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৫, ১৫ জুলাই ২০২৩   আপডেট: ১৮:৩২, ১৫ জুলাই ২০২৩
জীবন চক্রে পরিবর্তন, এডিস মশা এখন আরও ‘শক্তিশালী ঘাতক’

পরিবেশগত অবস্থার কারণে এডিস মশার জীবন চক্রে পরিবর্তন এসেছে। এতোদিন বিশেষজ্ঞরা দিনের শুরুতে ও সন্ধ্যার আগে এই মশা কামড়াতো বলে দাবি করলেও, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা এখন রাতেও কামড়াচ্ছে। এর ফলে ঘাতক হিসেবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মশাটি। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবীরুল বাশার রাইজিংবিডিকে এসব কথা জানিয়েছেন।

আরো পড়ুন:

২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলমান ‘আ্যাডাপশন অব এডিস এজিপ্টি মসকিউটো লার্ভা ইন সুয়ারেজ, সি, ব্র্যাকিশ আ্যান্ড ড্রেইন ওয়াটার: আ নিউ চ্যালেঞ্জ ফর ডেঙ্গু কন্ট্রোল’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণার তথ্য তুলে ধরে কবীরুল বাশার বলেন, এডিস মশা সুয়ারেজের পানি, ড্রেনের পানি, এমনকি সমুদ্রের নোনা পানিতেও ডিম পাড়ে ও জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। এক সেন্টিমিটার পরিমাণ জমে থাকা পানিতেও এডিস মশার বংশবৃদ্ধির প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া এডিস মশার ডিম ৬-৯ মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে ও একটু পানির সংস্পর্শে এলে সেটি ফুটে লার্ভা তৈরি হয়।

মশা আগে দিনের শুরু ও সন্ধ্যার আগে কামড়ালেও নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা এখন রাতেও কামড়াচ্ছে। যদিও রাতে কামড়ানোর হার কম।

কবীরুল বাশার বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার ১,৩৪,৯০৪টি মশার ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেখা যায়, মশাগুলো বিকেল ৪টায় যেমন সক্রিয়, তেমন রাত ৯টায়ও একইভাবে সক্রিয় ছিল।’

তিনি বলেন, ‘গবেষণার জন্য মশারির ভেতর মানুষকে রাখা হয়। এরপর মশা মশারির ওপর বসলে সেটিকে কাপে বন্দি করে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করা হতো। সেগুলো ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করে প্রজাতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তখনই বুঝতে পারি, এডিস মশা রাতেও কামড়াচ্ছে।”

প্রাণীবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বিশ্ব জুড়ে তিন হাজারের বেশি মশা রয়েছে। বাংলাদেশে ১২৩ প্রাজতির মশা পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র হলেও প্রাণীটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ফলে এটি যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায় ও নিজেকে সে অনুযায়ী পরিবর্তন করে নেয়। সাম্প্রতি পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে।’

এই গবেষক বলেন, ‘বিশ্ব জুড়ে নগরায়ণ হয়েছে। যার বেশিরভাগই অপরিকল্পিত। গবেষণাকালে ৫২ ধরনের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করে দেখা যায় এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে মশা নিধন কষ্টকর।’

উদাহরণ হিসেবে কবীরুল বাশার বলেন, ‘শহরগুলোতে অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। সেখানকার বেজমেন্টে গাড়ি রাখা ও গাড়ি ধোয়ার জায়গা আছে। পার্কিংয়ে জমে থাকা পানিতেও এডিস মশার বংশবৃদ্ধি হয়েছে, এমনটি দেখা গেছে। এছাড়া ভবনের মেইনগেটের ছোট্ট চ্যানেলেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এগুলো মশা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের চোখের আড়ালে থেকে যায়। এছাড়া মেগা কনস্ট্রাকশনের জায়গাগুলোও মশার প্রজননক্ষেত্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে ডেঙ্গু ছড়ানোর বিষয়টি একটি বড় উদাহরণ।”

এছাড়া আলোক দূষণের বিষয়টি তুলে ধরে কবীরুল বাশার বলেন, ‘আগে মানুষ এতো উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করতো না। এখন আধুনিক জীবনে বেশি আলো ব্যবহার করা হচ্ছে। এটিও মশার আচরণ বদলাতে সহায়তা করেছে।’ আচরণ বদলের মাধ্যমে মশা সুপার পতঙ্গ হিসেবে পরিণত হচ্ছে উল্লেখ করে মশার আচরণ ও মশা নিয়ন্ত্রণে বিস্তর গবেষণার ওপর জোর দেন তিনি।

কবীরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গু ফ্লাভিভিরিডি পরিবারের ভাইরাস। এর চারটি স্বতন্ত্র কিন্তু ঘনিষ্ঠ স্টেরোটাইপ (ডিইএনভি-১,২,৩,৪) আছে। এগুলো ডেঙ্গু সৃষ্টি করে। একটি স্টেরোটাইপে একবার ডেঙ্গু হলে একই স্টেরোটাইপের ডেঙ্গু আর হয় না। কিন্তু অন্য স্টেরোটাইপে যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন, তাতে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হয়। আর ভাইরাসজনিত হওয়ায় এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। আবার ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন তৈরিও চ্যালেঞ্জিং। কারণ, স্টেরোটাইপের যে-কোনো ভ্যারিয়েন্টেই আক্রান্ত হতে পারে। ফলে ডেঙ্গু থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় কলো এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা।’

তবে মশা নিয়ন্ত্রণের পুরনো ও চলমান পদ্ধতি থেকে সরে আসতে হবে বলেও পরামর্শ এই গবেষকের। তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে বছর জুড়েই গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন সবাইকেই সহযোগিতা করতে হবে। যেখানেই মশার প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে, সেখানে গবেষণা অনুযায়ী মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে। কার্যক্রমগুলো বাড়ি বাড়ি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকেই সচেতন হতে হবে। তারা সচেতন হলেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর সেই সচেতনতা দ্রুত ছড়াতে হবে। মশা আরও বিপদজনক হয়ে ওঠার আগেই।’

যা বলছেন বিশেষজ্ঞ: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এডিস ইজিপ্ট মশা, যেটি আবাসিকভাবে থাকে ঘরে বাড়িতে সেটিই ডেঙ্গু ছড়াতো। কিন্তু ২০১৯ সালের পরে দেখা গেলো, অন্য ধরনের এডিস মশাও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এটি এখন আর শহুরে মশা নয়। এটি এখন শহর, গ্রাম সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে। এটি উদ্বেগের বিষয়। দেশের ৬৩ জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা পরিষ্কার জমে থাকা পানিতে ডিম পাড়তো। কিন্তু এখন দেখছি পরিষ্কার পানির পাশাপাশি ময়লা পানিতেও এডিস মশা ডিম পাড়ছে ও বংশবিস্তার করছে। এজন্য মশার দ্রুত বিস্তার হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এডিসের আরেকটি প্রজাতি থাকে ঝোপঝাড়ে, বড় পাতায় জমা পানিতে। ফলে আবাসিক ধরনের মশা ছাড়াও বন্য ধরনের মশাও এখন ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। আগে মশা সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়াতো। কিন্তু এখন সবসময়ই কামড়াচ্ছে। ফলে এটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’

ডা. লেলিন চৌধুরী আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচার তিনটি পদ্ধতি। একটি হল এডিস মশা যেখানে বংশবিস্তার করে, সেগুলো ধ্বংস করা। দ্বিতীয়ত প্রাপ্তবয়স্ক মশার লার্ভা বা শুক্রকীট এগুলোকে মেরে ফেলা। আর তৃতীয়ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করা।’

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা টিকা নেই। আমাদের প্রধান চিকিৎসা হলো- সহায়তামূলক চিকিৎসা (সাপোর্টিভ ম্যানেজমেন্ট)। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরে মানুষের শরীর থেকে পানি ও তরল পদার্থ কমে যায়। সেই তরল পদার্থ ও পানি মুখে বা স্যালাইনের মাধ্যমে শরীরে দেওয়া। জ্বরকে নিয়ন্ত্রণ করা ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া। যদি দেখা যায়, রোগীর অবস্থা অবনতি হচ্ছে, প্লাটিলেট কমছে তাহলে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুর কার্যকর টিকা বা ওষুধ আবিষ্কার হয়নি।’

মশা মারার পদ্ধতি বদলাচ্ছে সিটি করপোরেশন: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘মশা যে ধরণ বদলাচ্ছে, প্রজননস্থল পাল্টাচ্ছে এগুলো দেখার জন্য আমাদের টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে, সেখানে আমিও আছি। আমরা এরইমধ্যে সে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমাদের ওখানে আইসিটি টি আর, আইসিটি জি আর, প্যান প্রটেকশন, উইং, বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ সবাই আছেন। আমরা নিয়মিত বিরতিতে বসি। উনারা যেভাবে আমাদেরকে পরামর্শ দেন, আমরা সেভাবে কীটনাশক নির্ধারণ করি, সেই মাত্রায় প্রয়োগ করি। কখন কি করতে হবে সেটা টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শ নিয়ে করি। আমাদের অবশ্যই এটা ধারণায় আছে। এখন বলা হচ্ছে এডিস মশা বাসার বাইরে পাওয়া যায়, আমরা দেখেছিও যে এডিস মশা বাসার বাইরে পাওয়া যায়। আগে বলা হতো এডিস মশা শুধু দিনে কামড়ায়, কিন্তু এটা এখন রাতেও কামড়ায়। আর্বানাইজেশনের জন্য চারিদিক এত আলোকিত হয়ে গেছে যে, এডিস মশার কাছে দিন রাত একই লাগে। এই যে ধরণগুলো চেঞ্জ হচ্ছে, আমরা জানছি বুঝছি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’

তিনি বলেন, ‘মশা দমনে আমরা সকালে নার্ভিসাইড ব্যবহার করি। বিকেলে এডাল্টিসাইড ব্যবহার করা হয় পূর্ণাঙ্গ মশাকে ধ্বংস করার জন্য। সকালে কীটনাশক ব্যবহার করি সেটার নাম টেমিফস। বিকালে ২ টা, ডেল্টামেথ্রিন, মেলাথিওন।’

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন একদম পিক আওয়ার। এই মৌসুমে আমরা যে রোগীর সংখ্যাটা দেখতে পাচ্ছি সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। তবে রোগীর সংখ্যাটা এশিয়া মহাদেশের অন্য দেশগুলোর তুলনায় (মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ব্যাংকক, ইন্দোনেশিয়া) অনেক কম আছে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। আমরা এই সংখ্যা (ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কখনোই পুরোপুরি শূন্য হবে না) শূন্যের কাছাকাছি আনার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি।’

আরিফুল ইসলাম/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়