ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

লক্ষ্মীপুর-৪

নির্বাচনী মাঠে আ.লীগ, আন্দোলনে বিএনপি

জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৬, ১৬ নভেম্বর ২০২৩  
নির্বাচনী মাঠে আ.লীগ, আন্দোলনে বিএনপি

এক সময় বিএনপির দুর্গ ছিল মেঘনা উপকূলীয় লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসন। কিন্তু টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও শরীক দলের দখলে আসনটি। এবার আসনটি আওয়ামী লীগ নিজেদের দখলে রাখতে দৌড়ঝাঁপ করছেন দলটির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনে গেলে আসনটি পুনরুদ্ধার করবেন তারা। ইতোমধ্যে নির্বাচনী মাঠে থাকার ঘোষণাও দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা।

এদিকে, জেলার চারটি সংসদীয় আসনের মধ্যে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাববিস্তারকারী নেতাদের দিক থেকে লক্ষ্মীপুর-৪ আসন বরাবরই থাকে সবার নজরে। কারণ, এ সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচন করেছেন স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলক জেএসডি সভাপতি ও ৯৬ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আ স ম আব্দুর রব, সাম্যবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা ভাষাসৈনিক কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আবদুর রব চৌধুরী, মুসলিমলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত জমির আলী, সাবেক মন্ত্রী ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মতো হেভিওয়েট নেতারা। 

বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে প্রথম ও দশম জাতীয় সংসদ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জয়ী হলেও এ আসনে বিএনপির প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ৫টি সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে। এ সংসদীয় আসনে নির্বাচনে জয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানকে ছেড়ে দিলে তিনি এ আসনে জয়ী হন। তিনি এ সংসদীয় আসনের বাসিন্দা না হওয়ায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমন জনপ্রিয়তা নেই বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েকজন উপজেলা পর্যায়ের নেতা। তথাপিও দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকেই বিজয়ী করতে তারা কাজ করবেন বলেও জানিয়েছে।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে এ আসনে রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে। দলগুলোর মধ্যে আওয়ামীলীগ থেকে মাঠ পর্যায়ে সম্ভাব্য নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখা গেলেও অন্য দলগুলো রয়েছে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির আন্দোলনে। দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও গোপনীয়ভাবে মাঠে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

অন্যদিকে আন্দোলনের ট্রেনে রয়েছে বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি। তবে, শেষ পর্যন্ত সব দল নির্বাচনে গেলে এ আসনে বিএনপি ও আওয়ামীলীগ প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।

বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ রাজনীতি করায় এ আসনে বড় দু’টি রাজনৈতিক দলের রয়েছে দু’জন হেভিওয়েট নেতা। বিএনপি জোট থেকে পরপর দুবারের নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম আশ্রাফ উদ্দিন নিজান ও আওয়ামী জোট থেকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব বর্তমান সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান। তবে স্থানীয় নেতাকর্মীরা জোটের প্রার্থী চাচ্ছেন না এ আসনে। তাদের দাবি, মেজর মান্নানের দল বিকল্প ধারার সাংগঠনিক ভিত্তি লক্ষ্মীপুর জেলায় নেই। আসন্ন নির্বাচনে যেন দলীয় কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে তারা জোট-মহাজোট প্রার্থীদের বিগত দিনের কর্মকাণ্ডকে দলের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে একাধিক নেতা জোর লবিং করে যাচ্ছেন। এরা হচ্ছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইস্কান্দার মির্জা শামীম। এদের মধ্যে ফরিদুন্নাহার লাইলী ও ইস্কান্দার মীর্জা শামিমের বাড়ি নোয়াখালী। ওই হিসেবে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এ আসন থেকে এমপি দেখতে চায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোঃ আব্দুল্যাহ দলীয় প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে মেঘনার ভাঙন রোধে আলেকজান্ডার এলাকায় ৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ সহ বেশ কিছু উন্নয়ণ কাজ করে জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হন। এ ছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর মেয়াদে এ উপজেলার নদীভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ, আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন, ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা, রাস্তাঘাটের উন্নয়নের কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অতীতের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। 

এ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর একটি শক্ত ভোট ব্যাংক রয়েছে। রামগতি উপজেলায় পর পর দুইবার এবং কমল নগর উপজেলায় এক বার জামায়াতের সমর্থিত প্রার্থীরা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয় লাভ করছে। এ আসন থেকে জামায়াতের নায়েবে আমীর এ আর হাফিজ উল্যা ভোট করবেন বলে জানা গেছে। আবার বিএনপি থেকে এখন পর্যন্ত এককভাবে দুই বারের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম আশ্রাফ উদ্দিন নিজানের নাম শোনা যাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে রয়েছে তার ব্যক্তি ইমেজের ভোট ব্যাংক। 

এ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে দলটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও চরকাদিরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ নির্বাচন করবেন বলে মাঠে প্রচার রয়েছে।

জানতে চাইলে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দল জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টি পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলে তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সব কিছু করা হবে।’

বিএনপির এবিএম আশ্রাফ উদ্দিন নিজান বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। এটি আমাদের কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার বলে আসছেন। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে এখানে বিএনপির প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয় হবে। দূর্গ উদ্ধারে নেতা-কর্মীরা ধানের শীষের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে বদ্ধপরিকর।’ 

তবে জেএসডি সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চ নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেন, ‘এ অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাবো না। জাতীয় সরকার ছাড়া কোনো ধরনের পাতানো নির্বাচনে জেএসডি অংশগ্রহণ করবে না। আগে সরকার পতন পরে নির্বাচন।’ 

এদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ইস্কান্দার মির্জা শামীম বলেন, ‘দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে আমি দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি দল আমাকে মূল্যায়ন করবে।’

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘এমপি না থাকলেও বিগত পাঁচ বছর আমি দলের বিভিন্ন কর্মসূচি পালনসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। নেত্রী আমাকে এলাকায় গিয়ে কাজ করতে বলেছেন। আমি এখন সংগঠন শক্তিশালী করতে মাঠে আছি। নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমি সে অনুযায়ী কাজ করব।’ 

বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব ও বর্তমান সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমার দল বিকল্পধারা এখনও মহাজোটের সঙ্গে আছে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমি তা মেনে নেব।’ 

মেঘনা নদীর পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত রামগতি ও কমলনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে রয়েছে একটি পৌরসভাসহ ১৭টি ইউনিয়ন। এখানে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৪৭৬ জন ভোটার রয়েছেন। এ মধ্যে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৫৫ জন পুরুষ ও ১ লাখ ৮১ হাজার ৯৯১ জন নারী ভোটার রয়েছেন। উপকূলীয় এ সংসদীয় আসনটির অন্যতম প্রধান সমস্যা নদী ভাঙ্গন। গত দুই যুগে এই আসনটির বিশাল একটি অংশ মেঘনা নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ হয়েছে ভিটেমাটি হারা। বিগত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মোঃ আব্দুল্যাহ এবং বর্তমান মহাজোট শরীক দল বিকল্পধারার সংসদ সদস্য মেজর (অবঃ) আব্দুল মন্নান জয়ী হয়ে নদী ভাঙনরোধে বাঁধ নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে মেঘনা নদীর পাড়ে ভাঙন রোধে ৩৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ চলমান রয়েছে। বিএনপি- জামায়াত নির্বাচনে অংশ গ্রহন করলে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের ত্রি-মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সচেতন মহল জানিয়েছে।
 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়