ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

অফিস পিয়ন আখতার একাধারে বিজ্ঞানী ও গবেষক!

মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ২০:০৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
অফিস পিয়ন আখতার একাধারে বিজ্ঞানী ও গবেষক!

বৈজ্ঞানিকের কাজ করছেন অফিস পিয়ন আখতার হোসেন

পাঁচ জেলার লাখ লাখ খামারির পশু-পাখির রোগ নির্ণয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান গাইবান্ধার আঞ্চলিক প্রাণীরোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রাণীর সমস্যা ও প্রাণীর মৃত্যুর কারণ জানতে এখানে আসেন অসংখ্য খামারি ও কৃষক পর্যায়ের মানুষ। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি পশু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি জনবল শূন্য হয়ে আছে প্রায় চার বছর ধরে। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ১১ জন জনবল থাকার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির অফিস পিয়ন (এমএলএস) আখতার হোসেন ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া আখতার দীর্ঘদিন থেকে এখানে কাজ করছেন। প্রতিদিন আসা খামারিদের পশু-পাখির রোগ নির্ণয় ও রিপোর্ট দেওয়ার কাজ একাই করেন তিনি। এ কারণে স্থানীয়রা তাকে একাধারে বিজ্ঞানী এবং গবেষক বলে সম্মোধন করেন। 

সরেজমিন বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টার দিকে শহরের ভিএইড রোডের পুলিশ লাইন এলাকায় অবস্থিত গাইবান্ধার আঞ্চলিক প্রাণী রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার কেন্দ্র গিয়ে দেখা যায়, প্রাণীর সমস্যা নিয়ে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী খামারি ছাড়া আর কোনো মানুষ নেই। চারদিকে সুনসান নীরবতা। ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার কক্ষ খোলা থাকলেও চেয়ারটি ছিল শূন্য। অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কক্ষগুলো ছিল তালা দেওয়া। দেখে বোঝা যায়, অনেকদিন কক্ষগুলো খোলা হয়নি। সম্প্রতি ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে একজন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে এখানে পদায়ন করা হয়েছে। কিন্তু, তিনি এখনো অফিসে যোগ দেননি। কর্মকর্তাদের নামের তালিকায় সর্বশেষ ২০১৭ সালে নিয়োজিত কর্মকর্তার নাম রয়েছে। পাশের দুটি কক্ষের একটিতে ল্যাবরেটরি, অন্যটিতে ল্যাবের বিভিন্ন উপকরণ ছিল। ব্যবহারের অভাবে ধুলা আর ময়লার আস্তরণে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল সেগুলো।

গরুর সমস্যা নিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার তালুকজামিরা গ্রাম থেকে এসেছিলেন খামারি আয়েশা বেগম। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেছি। অফিসে কেউ নেই। কক্ষগুলো তালা দেওয়া। আমার দুইটি বাছুর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। বাছুর দুটোর গোবর নিয়ে এসেছি। এখানে পরীক্ষার পর সেই রিপোর্ট জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে জমা দিয়ে ডাক্তারের কাছে থেকে ওষুধ নিয়ে বাড়ি যাবো। কিন্তু, এখন পর্যন্ত কারো দেখা পায়নি।

গাইবান্ধার আঞ্চলিক প্রাণীরোগ অনুসন্ধান ও গবেষণাগার

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত চর এলাকা উড়িয়া ইউনিয়ন থেকে আব্দুস সামাদ এসেছিলেন গরুর সমস্যা নিয়ে। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, বাড়িতে ১০টি গরু আছে। ফ্রিজিয়ান জাতের একটি গাভীর রুচির সমস্যা নিয়ে এসেছি। ওষুধ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। খাবার না খাওয়ায় গরুর ওজন দিন দিন কমে যাচ্ছে। গোবর এনেছি পরীক্ষার জন্য। দুপুর ১২টায় এসেছি। কিন্তু, কারও দেখা পাইনি। শুনলাম এখানে অনেক দিন থেকে কোনো কর্মকর্তা নেই। অফিসের একজন পিয়ন নাকি সব পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেন। এখন আল্লাহ ভরসা। উনি এলে গোবর পরীক্ষা করতে দেব।

গাইবান্ধা শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরের সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে গরুর রোগ নির্ণয় করতে এসেছিলেন আমজাদ হোসেন। গরুর পেটে কী কারণে সমস্যা দেখা দিয়েছে সেটি জানতে এসেছিলেন তিনি। তাকেও অপেক্ষা করতে দেখা যায় অফিস পিয়ন আখতার হোসেনের জন্য। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা না থাকার বিষয়টি তিনি আগে থেকেই জানেন। উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে এখানেই গরু নিয়ে পরীক্ষা করাতে এসেছেন। তিনি বলেন, 'এখান থেকে জয়পুরহাট জেলা অনেক দূর। গাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বেশি হবে।

ব্যবহারের অভাবে ধুলা আর ময়লার আস্তরণ পড়ে আছে ল্যাবের বিভিন্ন উপকরণে

দুপুর ১টায় অফিসে আসেন আখতার হোসেন। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এখানে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। স্যারদের সঙ্গে আগে কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দেই।’ 

আপনি কী রিপোর্ট দিতে পারেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কি করবো। অনেক দূর থেকে মানুষ পশুর সমস্যা নিয়ে আসেন। ঘুরে গেলে হয়রানি হয়। তাই অভিজ্ঞতায় যতটুকু পারি সঠিক রিপোর্ট এবং পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করি। আপনাদের মাধ্যমে এখানে জরুরি ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ দেওয়ার অনুরোধ করছি সরকারের কাছে।’

পলাশবাড়ি উপজেলার পবনাপুর ইউনিয়নের পূর্ব ফরিদপুর গ্রাম থেকে মুরগির মৃত্যুর কারণ জানতে এসেছিলেন আব্দুল হান্নান নামের এক খামারি। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন খামারের ১৫/২০টি মুরগি মারা যাচ্ছে। এখন তো গরম নেই। খালি হাঁ করে, আর মারা যায়। এখানে এসে জানতে পারলামে কোনো বিজ্ঞানী নেই। চাচা মিয়ার (আখতার হোসেন) পরীক্ষায় রিপোর্টে কতটা সঠিক হবে, সেটা নিয়েও চিন্তায় আছি। এখান থেকে জয়পুরহাট গেলে কাজ করে একদিনে আসা-যাওয়া হয় না। সঠিক রোগ নির্ণয় না হলে সঠিক চিকিৎসা হবে না। ভুল হলেই খামারের বাকি ৩০০ মুরগিও মারা যাবে। তখন সব শেষ হয়ে যাবে আমার।’

জানা যায়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারীসহ পাঁচ জেলার প্রাণীর রোগ অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য ১৯৮১ সালে গাইবান্ধায় এই আঞ্চলিক কার্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কার্যালয়ে একজন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, একজন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ৫ জন টেকনিশিয়ান, একজন হিসাবরক্ষক, সুইপার, এমএলএসএসসহ ১১ জনের পদ রয়েছে। ২০২১ সালে নানা জটিলতায় জনবল শূন্য হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে একজন এমএলএসএস ও সদ্য যোগদান করা একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (যদিও এখনো কর্মস্থলে যোগদান করেননি) ছাড়া কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক এন্ড টেকনোলজি'র অধ্যক্ষ ড. প্রদীপ কুমার হাওলাদার বলেন, প্রাণী রোগ অনুসন্ধান গবেষণাগার কেন্দ্রে দীর্ঘদিন ধরে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নেই। আমাদের একই রকম ডিপার্টমেন্ট হলেও কাজের বিষয়বস্তু আলাদা। তারপরও তাদের মাসিক রিপোর্টিংয়ের কাজগুলো আমরা করে দেই।

তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর রংপুরসহ উত্তরের পাঁচ জেলার গরু, ছাগল, হাঁস মুরগিসহ বিভিন্ন পশু পাখির খামার বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন এই প্রাণী রোগ অনুসন্ধান ও গবেষণাগার কেন্দ্রটির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তাছাড়া, পশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া একজন অফিস পিয়ন প্রাণীর রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট দেবেন, এটা যুক্তিযুক্ত নয়। স্থানীয়ভাবে রোগ নির্ণয় না করতে পেরে অনেককেই বাধ্য হয়ে জয়পুরহাট জেলা থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এতে ব্যয় এবং ভোগান্তি দুটোই বাড়ছে। আশাকরি, দ্রুতই সরকার এই আঞ্চলিক কেন্দ্রে পুরোপুরি জনবল নিয়োগ দেবে।

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ