সার্টিফিকেটে ‘বৃষ্টি খাতুন’, বায়োডাটায় ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
বৃষ্টি খাতুন নাকি অভিশ্রুতি শাস্ত্রী— নামের জটিলতায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের মর্গে পড়ে আছে মরদেহ। মরদেহ হস্তান্তর নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। মরদেহ নিতে এসে বিপাকে পড়েছেন তার বাবা। শনিবার (২ মার্চ) বিকেল পর্যন্ত তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে যে ৪৫ জন মারা গেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন এক নারী সাংবাদিক। প্রাথমিকভাবে যাকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে শনাক্ত করেন সহকর্মীরা। তিনি কাজ করতেন অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘দ্য রিপোর্ট ডট লাইভে’।
ওই নারী সাংবাদিকের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বনগ্রামে। তার বাবার নাম শাবলুল আলম সবুজ। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। এ তথ্য জানিয়েছেন তার পরিবার, স্বজন ও বেতবাড়ীয়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ। বাবা শাবলুল আলম সবুজ এবং মা বিউটি বেগম ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
গ্রামের বাড়িতে শোকাহত মা বিউটি বেগম
তবে ওই তরুণীর বায়োডাটায় দেখা গেছে, তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী। সন্তান হারিয়ে শোকাহত বৃষ্টির মা বিউটি বেগম। তিনি ও ওই তরুণীর খালা সাবানা খাতুন বলেন, ‘বৃষ্টি মুসলিম পরিবারের মেয়ে। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। তার মরদেহ আমরা গ্রামের বাড়িতে দাফন করব। বৃষ্টি যতই ভুল করুক না কেন, আমাদের সন্তান আমরা দাফন করব।’ তামিম নামে বৃষ্টির কাজিন বলেন, ‘বৃষ্টি ধর্মান্তরিত হয়েছিল বলে শুনেছি। বিষয়টি বাড়ির লোকজনও জানতো।’
৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ বলেন, ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। তিনি মুসলিম। বৃষ্টি ইডেন কলেজে পড়াশোনা করতেন। সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম বৃষ্টি। বাবা শাবলুল আলম সবুজ রাজধানী ঢাকায় বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার তিনটিই কন্যা সন্তান। বৃষ্টি খাতুন সবার বড়। মেজো মেয়ে শারমিনা সুলতানা ঝর্ণা রাজবাড়ী সরকারি কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছোট মেয়ে বর্ষা পড়ে দশম শ্রেণিতে। বৃষ্টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়েছেন গ্রামের বিদ্যালয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার ইডেন কলেজে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়েছেন। উচ্চশিক্ষা শেষ করার আগে বিসিএস কোচিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।’
নিহতের ছোট বোন শারমিনা সুলতানা ঝর্না বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরে মার সঙ্গে বৃষ্টির শেষ বার মোবাইল ফোনে কথা হয়। বৃষ্টি সাংবাদিকতা করলেও বাড়ি থেকে মা টাকা পাঠাতেন। বড় বোনের মৃত্যুতে তাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। দুই মাস আগে বড় বোন সর্বশেষ গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন।’
তার বোন হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন কি-না— এমন প্রশ্নে ঝর্ণা বলেন, ‘এটা হতেই পারে না। আমার বোন মনে প্রাণে মুসলিম। কখনই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেনি। তবে সম্প্রতি অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামে ফেসবুক আইডি খুলেছিলেন এবং ওই নামেই সাংবাদিকতা করতেন।’
বেতবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, তার বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করে বৃষ্টি। স্বাধীনচেতা ছিল। ছোট বেলা থেকে সরকারি বড় চাকরির স্বপ্ন দেখত।
ক্রেস্টে লেখা আছে- অভিশ্রুতি বৃষ্টি
মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠলেও ওই তরুণীর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো চলাফেরা করতেন। নিজেই নিজের নাম বদলে ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’ রাখেন। সহকর্মীরাও তাকে অভিশ্রুতি হিসেবে চিনতেন। হিন্দিতে কথা বলায় পটু ছিলেন। তার যাতায়াত ছিল রমনা কালী মন্দিরেও। তবে পারিবারিক পরিচয় গোপন করতেন। কর্মক্ষেত্রে জমা দেয়া বায়োডাটায়ও নিজেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আনুমানিক ৪/৫ মাস পূর্বে বৃষ্টি খাতুন ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’ নাম ধারণ করে ফেসবুক আইডি খোলেন। সেখানে তার ওয়াল পোস্টের ছবিগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মালম্বী বন্ধুদের আধিক্য এবং ওই বন্ধুদের সঙ্গে হিন্দুধর্মীয় বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যায়।
ঢাকার রমনা কালীমন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা আজ শনিবার একটি দৈনিক পত্রিকাকে বলেন, মন্দিরের পক্ষ থেকে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং জেলা প্রশাসক বরাবর অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর পরিচয় নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার সমাধানে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করা হয়েছে।
উৎপল সাহা বলেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ৮ থেকে ৯ মাস ধরে মন্দিরে যাতায়াত করতেন, পূজা করতেন। সে সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। অভিশ্রুতি শাস্ত্রী তাকে জানিয়েছিলেন, তাঁর মা–বাবা বেনারসে থাকতেন। তাঁরা মারা যাওয়ায় দাদুর হাত ধরে ঘটনাচক্রে তিনি কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন ছোটবেলায়। অভিশ্রুতির দাদু মারা গেলে একটি পরিবার তাঁকে দত্তক নিয়েছিল। তবে এ পরিবার মুসলিম না হিন্দু ছিল, তা তিনি বলেননি। অভিশ্রুতি মারা যাওয়ার পর তাঁর মুসলিম বাবা লাশ নিতে ঢাকায় এসেছেন। তাই অধিকতর তদন্ত করে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল পরিচয় সামনে আনা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর অভিশ্রুতি শাস্ত্রী যদি মুসলমান হন, তাহলে সেই ধর্মীয় রীতিতে, আর যদি হিন্দু হন, তাহলে সেই ধর্মীয় রীতিতে সৎকার করতে হবে।
এ সব কারণে মেয়ের মরদেহ বুঝে পাননি শাবলুল আলম সবুজ। শুরুতে তাকে একবার প্রতারক সন্দেহ করে আটকও করা হয়। তবে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ মরদেহ হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।
বেইলি রোর্ডে অগ্নিকাণ্ডের আগে এক বন্ধুর সঙ্গে গ্রিন কোজি কটেজের একটি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন বৃষ্টি ওরফে অভিশ্রুতি।
কাঞ্চন/বকুল