ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

মৃৎশিল্পের দুর্দিনেও টিকে আছেন তারা

শাহীন আনোয়ার, মাগুরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৪, ১৫ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১৮:২১, ১৫ এপ্রিল ২০২৪
মৃৎশিল্পের দুর্দিনেও টিকে আছেন তারা

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার রাজাপুর গ্রামের ২০টি পরিবারের মধ্যে ২-৩টি ছাড়া সকলে মাটির পাত্র তৈরি ও এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সময় কোনো উৎসব-পার্বণই মাটির পাত্র ছাড়া হয়নি। মৃৎশিল্পের রমরমা সময় গেছে। বিভিন্ন কারণে এখন আর সেই অবস্থা নেই। তাই এ ব্যবসার সঙ্গে এত পরিবারও জড়িত নেই।

তবে মাটির পণ্যের নানা রকম চাহিদা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। রাজাপুর গ্রামের পাল পাড়ার কিছু পরিবারের সদস্যরা পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে এ ধারা আঁকড়ে আছে। কিন্তু মাটি, জ্বালানির কাঠ ও পুঁজির সংকটে তাঁরা টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে।

মৃৎশিল্পী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিন দশক আগেও মাগুরা অঞ্চলে মাটির তৈরি পাত্রের অনেক চাহিদা ছিল। শিরনি, পূজা-পার্বণ, বিয়েতে প্রয়োজন পড়ত মাটির তৈরি রিপাইক (মাটির প্লেট), হাঁড়ি, দইয়ের পাতিলসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসের। যাদের প্রয়োজন, তাঁরা আগেভাগেই যোগাযোগ করে চাহিদা জানাতেন। নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে তা পৌঁছান হতো। এগুলো ছিল পরিবেশবান্ধব। ভেঙেচুরে তা আবারও মাটির সঙ্গে মিশে যেত। 

বৈশাখে বারুণী মেলাকে কেন্দ্র করেও মৌসুমী ব্যবসা ছিল। চৈত্র মাসে চাকা ঘুরেছে আর মাটির একেকটি দলা আকার নিয়েছে কলস, হাঁড়ি, সরাসহ নানারকম তৈজসপত্রের। হাতে হাতে তৈরি হয়েছে হাতি-ঘোড়া, নানা জাতের পাখি, মাটির ব্যাংক, ফলসহ অনেক রকম খেলনা। তাতে হাত লাগিয়েছেন ঘরের নারীরাও।

তুলির আঁচড়ে রঙিন, নজরকাড়া করে তোলা হতো প্রতিটি পণ্যকে। এরপর এ পণ্য বিক্রির জন্য বাড়ির পুরুষেরা নিয়ে যেত এলাকার বিভিন্ন বারুণী মেলায়, হাট-বাজারে।

পাইকাররা এসেও বাড়ি থেকে নিয়ে যেতেন পণ্যসামগ্রী। এখনও কিছু চাহিদা আছে। তবে তা আগের মতো নেই। অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক পণ্য মাটির তৈজসপত্রের স্থান দখলে নিয়েছে।

রাজাপুর মৃৎশিল্পীরা জানান, তাদের গ্রামে এ পেশার ২০টি ঘর ছিল। এর মধ্যে দু-তিনটি ঘর বাদে বাকি সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন মৃৎশিল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছে ১৪-১৫টি পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের পর কিছু পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।

প্রবীণ মৃৎশিল্পী কালিপদ পাল বলেন, এখন মাটির সংকট, জ্বালানি কাঠের সংকট, আগের মতো কারবারও নেই। এ কারণে অনেকে আর এসব করতে পারে না। পরবর্তী সময়ে এখানে এ ব্যবসা থাকবে কি-না, জানি না।

শ্যামল পালসহ অন্যরা জানান, মাটির সামগ্রী তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় আঠালো ধরনের মাটি। আগে মাটির স্থান চিহ্নিত করা হয়, তারপর গর্ত করে জমির ৮ থেকে ১০ হাত নিচ থেকে এ মাটি সংগ্রহ করতে হয়। আগে জমির মালিককে টাকা দিতে হতো না। এখন মাটি আগের মতো পাওয়া যায় না। গর্ত করতে হয় বলে অনেকে জমি থেকে মাটি দিতে চায় না। দিলেও ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। শুকনা মৌসুমে মাটি সংগ্রহ করা লাগে। তারপর সারা বছর কাজ চলে। এ ছাড়া জ্বালানি কাঠও আগে কিনতে হয়নি। এখন এক মণ জ্বালানি কাঠ কিনতে লাগে ১৫০ টাকা।

মৃৎশিল্পী দিপক পাল বলেন, ‘আগে সব কিছু ফ্রিতে মিলত। এখন মাটি, লাকড়ি—সবকিছু কেনা লাগে। টাকা দিয়ে পোষাতে পারি না। আর্থিক সহযোগিতা পেলে ব্যবসাকে বাড়ান যেত।’ 

তিনি জানান, তাদের তৈরি আকার অনুযায়ী একটি কলস ৫০ থেকে ১০০ টাকা, পাতিল ১২ থেকে ২০ টাকা, সরা ১০ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি করেন। এছাড়া পূজা-পার্বণের জন্য বিভিন্ন মাটির জিনিস ও রাবারের কষ সংগ্রহের জন্য বাটি তৈরি করেন তারা। সপ্তাহে দুদিন স্থানীয় বাজারে মাটির তৈরি জিনিস বিক্রির জন্য নিয়ে যান। বৈশাখে বারুণী মেলায়ও তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন খেলনা বিক্রি করেন। দু-এক মাস পরপর পাইকার এসেও নিয়ে যায়।

পাল পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বিক্রির জন্য কলস, হাঁড়ি-পাতিল, সরা, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি তৈরি করে রাখা হয়েছে। বাড়ির একটি স্থানের চুলা থেকে কাঁচা মাটির তৈরি নানা সামগ্রী পোড়ানোর গন্ধ তখনও ভেসে আসছে। 

নন্দ পাল বলেন, ‘মালের চাহিদা আছে। অনেকে আবারও মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করছে। প্লাস্টিকের জিনিসের মধ্যে খাইতে পারে না। কিন্তু মাটি, জ্বালানি সংকট ও আর্থিক কারণে বানান যাচ্ছে না। তারপরও পারিবারিক ব্যবসা ও ঐতিহ্য হিসেবে এখনও এটা ধরে রাখেছি। তবে আমাদের সন্তানেরা পড়ালেখা শিখে অন্য পেশায় যাচ্ছে। তারা এ পেশায় আসতে রাজি নয়।’ 

মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পলাশ মন্ডল বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েক দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। মৃৎশিল্পী কিছু পরিবার আছে জানি, কিন্তু তাদের তো চিনি না। এ শিল্প বিলুপ্তই প্রায়। তাদের আর্থিক সহযোগিতার কিছু সুযোগ আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখব, কীভাবে সহযোগিতা করা যায়।’ 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়