ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর: পুনর্বাসন-বিচার কোনোটাই মেলেনি

আরিফুল ইসলাম সাব্বির, সাভার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ২৪ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ০৮:২৪, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর: পুনর্বাসন-বিচার কোনোটাই মেলেনি

ধসে পড়া সেই রানা প্লাজার সামনে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পুনর্বাসন বা বিচার কোনোটিই পাননি শ্রমিকরা। প্রায় এক যুগ পরে এসে ওই ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চাওয়া পুনর্বাসন এবং সুষ্ঠু বিচার।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ৮ তলা বিশিষ্ট রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এর ফলে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শ্রমিক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক ধসে পড়া ভবনটির নিচে চাপা পড়েছিলেন। কয়েকদিনের উদ্ধার তৎপরতায় ১,১৩৬ জনের লাশ উদ্ধার হয় ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে। জীবিত উদ্ধার করা হয় ২,৪৩৮ জনকে। এদের মধ্যে অনেক শ্রমিক আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন।

জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলার পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমইএ কর্মকর্তারা রানা প্লাজায় আসেন। তারা ওই ভবনের গার্মেন্টস মালিকদের পরামর্শ দেন বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম যেন বন্ধ রাখা হয়। তবে, গার্মেন্টসগুলোর মালিক এবং তাদের লোকজন পরদিন (২৪ এপ্রিল) শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। ওই দিনই ধসে পড়ে রানা প্লাজা।

ওই ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে শ্রমিকদের মৃত্যুতে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দায়ের করা এসব মামলার বিচার চলছে ধীরগতিতে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সেই ভবন নির্মাণে ত্রুটি থাকার অভিযোগে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনে দায়ের করা মামলাটির জট খোলেনি এখনো। দীর্ঘদিন হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে আছে এটি। হাইকোর্টে শুনানির কোনো উদ্যোগ নেই।

এদিকে, ১১ বছরে অতিবাহিত হলেও পঙ্গুত্ব নিয়ে বাঁচার লড়াই করছেন অনেকেই। অসুস্থতা আর দারিদ্রতা নিয়ে দীর্ঘ দিন বসবাস করে আসলেও আহতদের পুনর্বাসনে কেউ এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।

তাসলিমা বেগম

রানা প্লাজার আহত শ্রমিক তাসলিমা বেগম বলেন, ‘মেরুদণ্ড ও পায়ে আঘাত পাইছি আমি। এত বছর ধরে কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে আছি। রানা প্লাজা ধসের এতদিন হয়ে গেছে আমাদের কেউ খবর নেয় নাই। আমরা কারও কাছে ভিক্ষা চাই না। আমাদের ন্যায্য পাওনা বুঝায় দেওয়া হোক।’

রানা প্লাজার একটি কারখানার সুইং অপারেটর নীলুফা বেগম ধসে পড়ার ঘটনায় মারত্মক আহত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘রানাপ্লাজা ধসে পড়ার এত বছর হয়ে গেলেও আমাদের কোনো খোঁজ কেউ নেয় না। আমার একটা পা মারাত্মকভাবে আহত। অপারেশনের জন্য ৭ লাখ টাকা লাগবে। আজ পর্যন্ত বায়ার, মালিক কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের খোঁজখবর কেউ রাখেনি। বিনা চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন।’

বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছরে এসেও আমাদের দাবি যেগুলো ছিল তার কিছুই পূরণ হয়নি। চিকিৎসা আর পুণর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারগুলো মানবেতর দিন পার করছে। তাই সরকার ও বিজিএমইএ’র প্রতি দাবি দ্রুত শ্রমিকদের কিছু সহায়তা দেওয়া হোক।’

আলোকচিত্র প্রদর্শনী-আলোচনা সভা: রানা প্লাজায় হতাহতদের স্মরণে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) সকালে সাভার রানা প্লাজার সামনে ‘রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের ১১ বছর: হাজারো প্রাণ ও স্বপ্নের গল্প’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভা আয়োজন করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। প্রদর্শনীতে চার আলোকচিত্রীর তোলা ছবি ও পোশাক শ্রমিকদের সন্তানদের সাত জনের আঁকা ছবি, জীবিত থাকা অবস্থায় স্টুডিওতে তোলা ২০ শ্রমিকের ছবি প্রদর্শন করা হয়।

এরমধ্যে একটি ছবি নিহত শাহেদুলের। স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে স্টুডিওতে ছবি তুলে, ব্যাকড্রপে উড়োজাহাজের ছবি দেওয়া। হয়তো উড়োজাহাজে চড়ার স্বপ্ন ছিল তার।

আরেকটি ছবি ছিল নিহত আঁখির। হয়তো সমুদ্র ভালোবসতেন তিনি। কিন্তু, যাওয়া হয়নি কখনো। তাই স্টুডিও থেকে স্বপ্নের ছবি তৈরি করিয়ে নেন সেই সমুদ্রর পারে। আখি আক্তার (১৮) ও তার বন্ধুরা রানা প্লাজার সপ্তম তলার নিউ ওয়েব স্টাইল লিমিটেড কারখানায় কাজ করতেন। বন্ধুদের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ-১৪২০ (১৪ এপ্রিল, ২০১৩) এই ছবিটি তোলা। তার ঠিক ১০ দিন পর ২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর থেকে আঁখি নিখোঁজ। এই ছবির কেবল একজন বেঁচে আছেন। আঁখিসহ ছবির সবাই নিহত বা নিখোঁজ রয়েছেন।

আয়োজকরা জানান, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে এসব শ্রমিকের প্রাণ ও স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে যায়। রানা প্লাজার সামনে প্রদর্শনী করে আবারও সেই অতীতের স্মৃতিকে সামনে আনা হলো। এই ঘটনাকে ইতিহাসে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তরুণদের লড়াইয়ে প্রেরণা দিতেই এই প্রদর্শনী। রানা প্লাজার শ্রমিকদের মতো যাতে আর কাউকে অকালে মরতে না হয়. এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন তারা।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়