ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

একজন শিক্ষিত নারীর ঘরে বসে থাকা সমর্থনযোগ্য নয়: পুরবী

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১৯, ২ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ২১:৩২, ২ মার্চ ২০২৪
একজন শিক্ষিত নারীর ঘরে বসে থাকা সমর্থনযোগ্য নয়: পুরবী

‘মেয়েরা রোজগার না করলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না, এটা চরম বাস্তব কথা। আর দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে শুধু ঘরে বসে থাকবো, এটা কখানোই সমর্থনযোগ্য মনে হয়নি। এই চিন্তা থেকেই মূলত সবসময় কিছু করার চেষ্টা করেছি। যুক্ত হয়েছি নিজের পছন্দ মতো কাজের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় কথা, একজন নারীর আত্ম-নির্ভরশীলতা খুব বেশি প্রয়োজন।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সফল নারী উদ্যোক্তা পুরবী সরকার। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনার্সে থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালে প্রাইমারিতে শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। চাকরির পাশাপাশি ২০০৬ সালে একই বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। মাস্টার্স শেষ করার পর প্রাইমারির শিক্ষকতা ছেড়ে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন।

এরই মধ্যে ২০০৮ তার বিয়ে হয়ে যায়। তবে সংসার জীবনের প্রভাব চাকরিতে খুব একটা পড়েনি। এরপর নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে একাধিক কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে চাকরিও করেছেন। ২০১৪ সালের দিকে দুটি সন্তান হওয়ার পর তিন বছরের জন্য চাকরি থেকে ছুটি নেন তিনি। কিন্তু ছোট দুই ছেলে-মেয়েসহ চার সদস্যের সাংসারিক ব্যস্ততায় ছুটি শেষে চাকরিতে আর ফেরা হয়নি তার।

তার স্বামীও একটি স্বনামধন্য বহুজাতিক কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের প্রধান। আর্থিক টানাপোড়েন নয়, স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ও কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় বসে থাকতে চাননি তিনি। ২০১৯ সালের শেষ দিকে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করেন তার পথচলা।

পুরবী সরকার বলেন, ২০১৯ সালে শেষ দিকে শুরু করলেও এটা নিয়ে ভেবেছি আরও বছর দশেক আগেই। ২০০৯ সালে একটি বহুজাতিক কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতাম। বগুড়ায় পোস্টিং ছিল। সে সময়ে বগুড়ার মেয়েরা হাতে তৈরি করা নকশি কাঁথা ও পণ্য মাঝে মাঝে আমাকে দেখাতো। আমি তাদের নিয়মিত ক্রেতা ছিলাম। তাদের বিভিন্ন পণ্য নিয়ে রাজশাহী এবং বগুড়া জেলার বড় বড় শো-রুমগুলোতে ঘুরেছি। ইচ্ছা ছিল নিজের একটা উদ্যোগ শুরু করার। কিন্তু তখনও পেজের মাধ্যমে কাজ করা যায় এটা জানা ছিল না।

উদ্যোক্তা হওয়ার সেই সুপ্ত ইচ্ছে থেকে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন তিনি। প্রথমে তো পরিবার থেকে বড় বাধা ছিল। বিশেষ করে তার স্বামী চাকরি করাকে সমর্থন করলেও কখনোই চাননি তিনি ব্যবসা করেন। কিন্তু তিনি খুব গোপনে বিভিন্ন নকশি পণ্য এবং রাজশাহী সিল্কের শাড়ি ও সালোয়ার কামিজ ঘরে থেকে বিক্রি করতেন। প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবী এবং বাচ্চাদের স্কুলের তাদের বন্ধুদের মায়েরা ছিল তার ক্রেতা।

পুরবী বলেন, ব্যবসা শুরু করেছিলাম খুব গোপনে। কেউ জেনে ফেললে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির  লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা কেউ হয়তো ভালো চোখে দেখবে না। পরে জেনে ফেলার পর বাসা থেকে খুব আপত্তি করেছিল।

এখন অবশ্য আর কেউ আপত্তি করেন না। পুরবীর স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবল আগ্রহের কাছে পরিবারের সদস্যরা হয়তো হার মেনেছে। ২০২০ সালে করোনাকালে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পুরোদমে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তার ইচ্ছে ছিল খাবার এবং পোশাক নিয়ে কাজ করার। এজন্য ফেসবুকে Arshi Business Center নামে পেইজ খোলেন।

প্রথম দিকে পোশাক দিয়ে কাজ শুরু করেন পুরবী। রাজশাহী সিল্ক ও বিভিন্ন নকশী পণ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। রাজশাহী সিল্ক ও মসলিন পণ্যগুলো তিনি রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের তাঁতীদের কাছ থেকে নিজস্ব ডিজাইনে ও তত্ত্বাবধানে তৈরি করে আনতেন। গত ২০২৩ সালের আগস্ট মাস থেকে যুক্ত হয়েছে ঘরে তৈরি বিভিন্ন রকম খাবার।

পোশাকের পাশাপাশি আরশী বিজনেস সেন্টারে কেনো খাবার যুক্ত করলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পোশাক একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হয় বেশি। সারা বছর এর প্রয়োজনীয়তা ততটা থাকে না, যতটা খাবারের চাহিদা থাকে। আমার পরিবারে বাবা মারা যান ২০১২ সালে। সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন বাবা। পেনশনের টাকায় মা চলেন। মায়ের সঙ্গে আছে আমার ছোট ভাই। সে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। এদিকে ২০২২ সালে মায়ের পা ভেঙে যায়। চিকিৎসার জন্য বড় অংকের টাকা খরচ হয়। বাবার জমি ছিল প্রায় ২০ বিঘা। সেখানেও মানুষের প্রতারণায় সম্পদগুলো হারিয়ে যায়। গত বছর মাকে এনে ঢাকায় আমার পাশে আলাদা বাসা নিয়ে রেখেছি। এই পরিস্থিতিতে পরিবারের ব্যয়ভার বহন করার জন্য খাবারের উদ্যোগ নিয়েছি। এটাই খাবারের উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ।

তিনি আরও বলেন, খাবার আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ। ব্যবসা সর্বদা চালু রাখার জন্য খাবারের আইটেম যুক্ত করেছি। এছাড়াও রান্না করতে পছন্দ করতাম একদম ছোটবেলা থেকেই। আমার পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী সবাই রান্নার প্রশংসা করতেন এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলতেন। সবার অনুপ্রেরণায় শুরু করেছিলাম খাবার সরবরাহ। এজন্য দ্রুত সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছি। ক্রেতা পেয়েছি অনেক এবং ভালো ফিডব্যাক দিচ্ছেন সবাই।

শুরুতে রাজশাহী অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার কালাই রুটি ও বিভিন্ন রকম ভর্তার সঙ্গে হাঁসের মাংস বেশ জনপ্রিয়তা লাভ। পুরো শীতে চলেছে নানারকম পিঠার জমজমাট ব্যবসা। এর পাশাপাশি বাচ্চাদের টিফিনের জন্য বিভিন্ন রকম খাবারসহ প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় থাকা ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, বিরিয়ানি, রোস্ট, পোলাও সবকিছু নিয়মিতই অর্ডার অনুযায়ি সরবরাহ করেছেন তিনি। হাসপাতালে থাকা অসুস্থ রোগী ও তার স্বজনদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে পুরবীর আরশিতে।

বিয়ে, জন্মদিনসহ পারিবারিক বা কর্পোরেট অফিসের যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠানের খাবারের অর্ডার নেন তিনি। আসছে রমজান উপলক্ষে ইফতার ও সেহরির জন্য তিনি সরবরাহ করবেন বিশেষ খাবার আইটেম।

ঘরে তৈরি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পুরবীর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকে। সততা ও একনিষ্ঠতার জন্য গ্রাহকদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বাসযোগ্য। তালিকায় নতুন নতুন গ্রাহক যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকরা নিয়মিত পোশাক ও খাবার নিচ্ছেন তার কাছ থেকে। তবে খাবার সরবরাহ নিয়ে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশকিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। কুরিয়ার সেবাদাতা কোম্পানিগুলোর সরবরাহ পদ্ধতিটা আরও একটু উন্নত করা গেলে খাবারের উদ্যোক্তাদের জন্য খুব ভালো হতো বলে মনে করেন পুরবী।

আগামীতে একটি পোশাকের শো-রুম চালু করবেন। পাশাপাশি খাবার আইটেমও চালু রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন পুরবী।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়