ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

শুঁটকিতে স্বাবলম্বী লিজা

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:১৭, ৫ মার্চ ২০২৪   আপডেট: ২১:৪৫, ৫ মার্চ ২০২৪
শুঁটকিতে স্বাবলম্বী লিজা

নিজে কিছু একটা করে স্বামী-সন্তান নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন নির্বাহ করার ইচ্ছে সব সময়ই ছিল। সে ইচ্ছে থেকেই শুরু করেন অনলাইনে শুটকি ব্যবসা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবেুকে ‘দেশি শুটকি’ নামে একটি পেজ খোলেন। পরবর্তীতে এই নামে তৈরি করেন ওয়েবসাইটও। ‘দেশি শুটকি’ নামের পেজ ও ওয়েবসাইট থেকে দেশ-বিদেশে সরবরাহ করছেন নানা ধরনের সামদ্রিক শুঁটকি।

বলছিলাম চট্টগ্রামের গৃহবধু লিজা রহমানের কথা। কুমিল্লার এ মেয়ে স্বামী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার সামলানোর পাশাপাশি সফলতার সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত একজন উদ্যোক্তা।

তবে শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না লিজার। কুমিল্লার সব স্বনামধন্য স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এ মেধাবিনীর। লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রী ছিলেন তিনি। ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবেন। কিন্তু পারিবারিকভাবে বড় একটা যৌথ পরিবারে বিয়ে হয়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিকেই। বিয়ের পরও পড়ালেখা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। গর্ভে সন্তান নিয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন অদম্য লিজা, করেন ভালো রেজাল্টও।

পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু এরই মধ্যে শাশুড়ি মারা যান। স্বামীর অল্প আয়ে পড়ালেখা করতে খুব সমস্যা হচ্ছিল। প্রথম বর্ষ কোনো রকমে পাশ করলেও আর্থিক সমস্যায় তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা থেকে তৈরি হয় বিশাল ব্যবধান।

শুরু হয় আরেক সংগ্রামী জীবন। সংসারে কিছুটা হাল ধরতে একটা স্কুলে চাকরি নেন লিজা। পাশাপাশি টিউশনিও করছিলেন। এভাবেই কোনো হালে দিন যাচ্ছিল। এরই মধ্যে তিনি দ্বিতীয় সন্তানের মা হন। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ কোনো অংশেই কমেনি। বিশাল গ্যাপ থাকার পরও তিনি ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই সন্তান, বিশাল সংসার, চাকরি, টিউশন- সবকিছু সামলিয়ে মাস্টার্স শেষ করেন এ সংগ্রামী নারী।

একটা সময় এসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন লিজা রহমান। বাধ্য হয়ে চাকরি এবং টিউশনি দুটোই ছাড়েন। কিন্তু কিছু করার তাগিদ সব সময় ছিল ভিতরে। কিন্তু অসুস্থতাসহ নানা রকম সমস্যার কারণে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে শুরু করবেন।

লিজা বলেন, ২০১৯ সাল থেকে পরিকল্পনা শুরু করি ব্যবসা করার। কিন্তু কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে খোঁজ পাই ফেসবুক ভিত্তিক উই গ্রুপের। সেখান থেকে ডিজিটাল স্কিলস গ্রুপের। সেখানে শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ স্যারের গাইড লাইন ফলো করি। নিজের একটা পরিচয় গড়তে উদ্যোক্তা হবার সিদ্ধান্ত নেই।

তার ইচ্ছে ছিল, এমন একটি পণ্য নিয়ে কাজ করবেন, যেটি হবে তার এলাকার ঐতিহ্যবাহী পণ্য। অনেক খোঁজখবর নিয়ে লিজা প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি সামুদ্রিক শুঁটকি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি বলেন, বাজারের শুঁটকিতে রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা শারীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এজন্য রাসায়নিক মুক্ত শুঁটকি নিয়ে কাজ করার চিন্তা করি। এ চিন্তা থেকে ২০২০ সালের জুন থেকে যাত্রা শুরু করে আমার স্বপ্ন ‘দেশী শুঁটকি’।

এ সফল নারী উদ্যোক্তার কাছ থেকে কোনো গ্রাহক একবার পণ্য নিলে দ্বিতীয় কারও কাছে যাওয়ার চিন্তা করেননি। ব্যবসায় সততার কারণে দেশের ৩৪টি জেলায় তার পণ্য নিয়মিত যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত দেশের গণ্ডি বিশ্বের ১২টি দেশে গেছে এ উদ্যোক্তার শুঁটকি।

কর্ণফুলির তীরবর্তী ইছাপুরে জেলেদের থেকে সরাসরি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি শুঁটকি তিনি সংগ্রহ করেন। মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় সাশ্রয়ী দামে প্রতি মাসে প্রায় ৪০/৫০ কেজি শুঁটকি বিক্রি করেন তিনি। ছুরি, লইট্টা, মলা, কাচকি, সুরমা, রূপচাঁদা, লাক্ষা, চিংড়ি, পোয়াসহ প্রায় সব ধরনের সামদ্রিক শুঁটকি রয়েছে তার কাছে।

অবশ্য লিজা রহমানের ব্যবসা শুঁটকিতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ঘরে বসে করছেন নারীদের দেশি পোশাকের ব্যবসাও। তিনি এটাতেও বেশ ভালো সাড়া পেয়েছেন। এখন এ ব্যবসাকে অনলাইনেও নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। তার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও আশেপাশের দুই-তিন এলাকার মানুষ তার নিয়মিত ক্রেতা।  তবে তার এই ক্রেতা সমাগম কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। এদের দ্বারাই এক সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

এ সফল নারী উদ্যোক্তা বলেন, শুঁটকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ অনেকের কটুক্তি শুনেছি। এসব পুরুষদের কাজ, দুনিয়ায় এতো কিছু থাকতে কেনো শুঁটকি নিয়ে কাজ করছি, বেশিদিন টিকতে পারব না ইত্যাদি কথা শুনতে হয়েছে। একদিন যারা আমাকে ঠাট্টা উপহাস করতেন, আজ তারাই প্রশংসা করেন। তাদের সবাই আমার নিয়মিত ক্রেতাও।

লিজার ব্যবসায় তার পরিবারের সদস্যরা সার্বিক সহযোগিতা করেন। বিশেষ করে তার ছেলে সবসময় তার সঙ্গে থাকেন। তিনি বলেন, মেয়েদের পক্ষে শুঁটকি নিয়ে কাজ করা সত্যিই অনেক কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু আমি আমার স্বপ্নে অটল। নিজের পেইজকে ব্র‍্যান্ড করার স্বপ্ন আমার। আমার কাছে সামুদ্রিক সব ধরনের শুটকি আছে। ইনশাআল্লাহ, একদিন অফিসিয়ালি দেশের বাইরে যাবে আমার প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি সম্পুর্ণ রাসায়নিক মুক্ত শুঁটকি।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়