ছেলের জন্যই উদ্যোক্তা হয়েছেন ফাহিমা
মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম
![ছেলের জন্যই উদ্যোক্তা হয়েছেন ফাহিমা ছেলের জন্যই উদ্যোক্তা হয়েছেন ফাহিমা](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2024March/Fahima-Sultana-parveen-1-2403241319.jpg)
ফাহিমা সুলতানা পারভীন। পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও জন্ম ঢাকা সাভারে। স্কুল ও কলেজ পর্যায় শেষ হয় সাভার থেকেই। কারণ চাকরির সুবাদে তার বাবা বহু আগে থেকেই সাভার এলাকার বাসিন্দা। পরে ইডেন মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেন। বিয়ে হয় রাজধানীর বাড্ডায়। শ্বশুরালয় কুমিল্লা হলেও তারা এখন বাড্ডাতে থিতু হয়েছেন। সেই হিসেবে তিনি এখন বাড্ডারই বাসিন্দা।
এই ফাহিমার এতো পরিচয় দেওয়ার কারণ হলো- তিনি বর্তমান সময়ের একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। সরকার প্রথমে যে ২৮৮ নারী উদ্যোক্তাদের ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছিল, তিনি তাদের একজন। তবে এ সফতার পিছনের গল্পটা সহজ নয়, সম্পূর্ণই ভিন্ন।
স্বামী ও একমাত্র সন্তান রাইয়ানকে নিয়ে ফাহিমা সুলতানার সংসার। মূলত ছেলের জন্যই তার এই উদ্যোক্তা জীবন শুরু। স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার পরই তার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন মাস্টার্স করার পর সন্তান নিবেন। কারণ উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন শুধু তার নয়, তার বাবাও। মাস্টার্স শেষ করার পরপরই বেবি কনসিভ করেন এবং ডাক্তারের মাধ্যমে জানতে পারেন জমজ বাচ্চার খবর। এতে সবাই খুব খুশি হয়। কিন্তু এ খুশি বেশিদিন টিকেনি।
আড়াই মাস পর একটা বেবী মিসিং হয়ে যায়। এর মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দিলে প্রেগনেন্সির ছয় মাসের মাথায় বাধ্য হয়ে সিজার করাতে হয়। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি ১৩৫০ গ্রাম ওজন নিয়ে জন্ম নেয় রাইয়ান, সঙ্গে জন্ডিস ও নিউমোনিয়াও ছিল। টানা দুই মাস ছেলে ছিল ইনকিউবেটরে। এরই মধ্যে তার স্বামীর চাকরিটাও চলে যায়। এর মধ্যে তিনি তার বাবাকেও হারিয়ে ফেলেন। সব মিলিয়ে এক দুর্বিসহ জীবন। তবে মা-বাবা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনরা সবসময়ই পাশে ছিল।
ছেলে রাইয়ানের নয় মাসেও ঘাড় শক্ত না হওয়ায় ডাক্তার লং টাইম থেরাপির পরামর্শ দেন। সেই থেকে আজো চলছে থেরাপি। শুধু থেরাপিস্টের উপর নির্ভরশীল না থেকে তিনি কাজ শিখে নিজেও থেরাপি দিতেন। ছেলের থেরাপির জন্য ফাহিমার মা সবসময়ই কিছু খরচ দিতেন। সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া টাকা অল্প অল্প করে জমিয়ে ছয় হাজার টাকা হয়। তা দিয়েই শুরু করেন ব্যবসা।
২০২০ সালে করোনায় মানুষ যখন গৃহবন্দী, তখনই ফাহিমা তার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন। তবে তিনি ছোটবেলা থেকেই স্ব-নির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু বাসা থেকে বের হয়ে কিছু করাটা শ্বশুরবাড়ি থেকে পছন্দ করতো না। আবার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন হওয়ায় সন্তানকে শতভাগ সময় দিতে হতো। সব মিলিয়ে চাকরি জীবন বাদ দিতে হয়।
বিভিন্ন টাইপের বিছানার চাদর ভীষণ পছন্দ ছিল তার। এজন্য তিনি বিছানার চাদর দিয়েই কাজ শুরু করেন। এর আগে ছোট বোনের মাধ্যমে অনলাইন প্লাটফর্ম উই’তে যুক্ত হন তিনি। সেখানে নানা উদ্যোক্তার প্রচুর পোস্ট পড়া শুরু করেন। তিনমাস পর “রাইয়ান'স ভ্যারাইটিস কালেকশন” নামে একটি ফেসবুকে পেজ খুলে সোসিংয়ের মাধ্যমে কাজ শুরু করেন। শুরুতেই তিনি ব্যাপক সাড়া পান। প্রথম ছয় মাসে আড়াই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন। ছেলের থেরাপি ও স্কুল যাতে বন্ধ করতে না হয়, সেজন্য তার স্বামীও তাকে খুব সহযোগিতা করতেন।
ফাহিমা বলেন, আমার ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকি। আমার সবকিছুই করতে হতো অনলাইনে। কারণ আমার বাসা থেকে বের হওয়াটা কেউ পছন্দ করতো না। অনেক বাধা পাই, কিন্তু পিছপা হইনি। সন্তানকে সময় দিয়ে যেটুকু বেঁচে থাকতো, ওই সময়টা পেইজকে দিতাম।
২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ফাহিমা। তার লান্সেও ইনফেকশন ছিল। সুস্থ হয়ে আবার শুরু করেন ব্যবসা। কিছুদিন না যেতেই আবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। পরে অসুস্থতা কাটিয়ে ২০২২ সাল থেকে আবার শুরু করেন ব্যবসা এবং ভালোই সফলতা আসতে থাকে।
তিনি বলেন, ছয় হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। ছয় মাসে সেল হয়েছিল আড়াই লাখ টাকা, যা আমাকে অনেক উৎসাহিত করে। এখন পরিধি বেড়েছে, মাঝে মাঝে মেলাও করে থাকি। বিছানার চাদরের পাশাপাশি এখন ম্যাচিং পর্দা, জামদানি, শতরঞ্জি, টেবিল রানার ম্যাট ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছি। বাচ্চা ছোট হওয়ায় অফলাইনেই ব্যবসা করছি। ইনশাআল্লাহ, এখানেই ধৈর্য্য ধরে লেগে আছি। ক্রেতার আমার পেজে ও আইডির মাধ্যমে অর্ডার করেন। আমি তাদের চাহিদা মতো হোম ডেলিভারি দেই।
ফাহিমা ঐতিহ্যগত দেশিয় পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। দেশিয় পণ্যের গুরুত্ব তার কাছে সবচেয়ে বেশি। এজন্য তিনি সবাইকে বলতে চান, ভালো পণ্য, দেশিয় পণ্য, কিনে হোন ধন্য।
আরো পড়ুন