ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

মানুষের কথায় কান দিতে মানা উদ্যোক্তা শারমিনের

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:০৪, ৭ মে ২০২৪   আপডেট: ২০:০৭, ৭ মে ২০২৪
মানুষের কথায় কান দিতে মানা উদ্যোক্তা শারমিনের

মৌলভীবাজারের আগর আতর, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, টাঙ্গাইল শাড়ীসহ বাংলাদেশের ২৮টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব জিআই পণ্য নিয়ে বর্তমানে দেশে অসংখ্য নারী কাজ করছেন, হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা। তাদেরই একজন শারমিন জামান।

তিনি স্বামী ও একমাত্র সন্তান নিয়ে রাজধানীর বাসাবো থাকেন। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে থেকে ২০১২ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন অপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখন তিনি অন্যতম সফল উদ্যোক্তা।

নিজের সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, স্নাতকে পড়া অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। পরে সেটা সম্পন্ন করে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করি। ইচ্ছে ছিল কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে ফার্মাসিস্ট হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করবো। কিন্তু সংসার ও সন্তান সামলিয়ে চাকরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়।

২০১৯ সালে নিউট্রিশনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পরও আর চাকরিতে ফেরা হয়নি। ওই সময় তিনি ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করার কথা ভাবছিলেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘আলিফস কালেকশন’ নামে একটা পেজ খোলেন। শুরু করেন অনলাইন ব্যবসা।

শারমিন বলেন, বসে না থেকে কিছু করতে হবে, এমনটাই ভাবছিলাম সবসময়। কিন্তু অনলাইন বিজনেস সম্পর্কে কিছুই জানি না, কিভাবে শুরু করবো বুঝছিলাম না। তারপরও সাহস নিয়ে শুরু করলাম ভারতীয় গহনার ব্যবসা। এটা নিয়ে লাইভ করতাম নিয়মিত। লাইভেই সব পণ্য বিক্রি হয়ে যেত। কিন্তু ওই সময় অনেকেই ভারতীয় গহনা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। সব পেজেই পণ্যগুলো কমন হয়ে যায়। তখনই দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করার বিষয়টি মাথায় আসে।

এরপরই তিনি ঢাকাই জামদানি ও টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে পণ্য সংগ্রহ নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে যান এ নারী উদ্যোক্তা। এরপর সরাসরি কারখানায় গিয়ে পণ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন।

তিনি বলেন, ব্যবসা শুরুর আগে সোর্সিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে সরাসরি কারখানায় গিয়ে অল্প কিছু শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন উই গ্রুপের খোঁজ পেয়ে সেখানে যুক্ত হলাম। উইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের কোর্স সম্পন্ন করে বেশ ভালো একটা ধারণা পেলাম। বিভিন্ন নিয়ম সম্পর্কে জানলাম, ফটোগ্রাফি শিখলাম। শাড়ির মডেল নিজেই হতাম। সবমিলিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে ভালোই সাড়া আসতে থাকে।

প্রথম দিকে অল্পকিছু টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। সেখানে সফলতা আসলে ২০২০ সালে তালিকায় বাঁশের তৈরি পণ্য যুক্ত করেন। তিনি বলেন, কোভিডের সময় মানুষ ঘরে বসেই কেনাকাটা করতো। বাঁশের পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করলেও সেখানে তেমন ভালো সাড়া না পাওয়ায় সেটা বাদ দিতে হয়। এখন ঢাকাই জামদানি ও টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি নিয়ে কাজ করছি। 

তবে জামদানি শাড়ি নিয়ে কাজের শুরুতে তিনি পরিচিতজনদের কাছ থেকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত হয়েছেন। তবে সমালোচকদের কথায় কান দেননি এ উদ্যোক্তা।

শারমিন বলেন, কাজের শুরুতে তো সবাই বলতো- ‘এতো পড়াশোনা করে শাড়ি, গহনা বেচবে অনলাইনে!’ তারপর যখন জামদানি নিয়ে কাজ শুরু করলাম, তখন আবার সবাই বলতে শুরু করলো- ‘জালি জালি শাড়ি কে কিনবে?’ কিন্তু আমি কারো কথায় কান দিইনি। তারপর নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে গিয়ে তাঁতি খুঁজে বের করলাম। যেটা ছিল খুবই কষ্টের। ওই তাঁতিদের ডিজাইন, রং দেখিয়ে দিতাম। তারা আমাকে চাহিদা মতো তৈরি করে দিত।

কোভিড সময় তাঁতিদের অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিল। ওই সময়ে যে কয়জন নারী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, শারমিন তাদেরই একজন। তিনি বলেন, আমার তিনজন ভেন্ডর (বিক্রেতা) আছে। শাড়ি তৈরি করার আগে আমাকে দেখায়, আবার আমি নিজেও গিয়ে দেখে আসি। সবসময় তারা আমাকে আপডেট দেন। তাদের মাধ্যমেই আমি শাড়িগুলো সংগ্রহ করে থাকি।

নতুন করে যারা উদ্যোক্তা হতে চান তাদের উদ্দেশ্যে এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, আমি শুধু অনলাইনে কাজ করি। এখানে কাজ করতে হলে আগে থেকেই পর্যাপ্ত পরিকল্পনা থাকতে হবে। পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ঋণ করাও লাগতে পারে। তবে ঋণ নেওয়ার আগে কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। অন্যত্থায় হিতে বিপরীত হতে পারে। একই সঙ্গে নারীদের জন্য আরও সহজ শর্তে সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 

তিনি মনে করেন, উদ্দোক্তা হতে হলে সবার আগে অবশ্যই আপনাকে মানুষের কথায় কান দেওয়া যাবে না। নিজের কাজটা মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। কাজকে নিজের সন্তানের মত দেখতে হবে, অনেক সময় দিতে হবে। অন্য উদ্যোক্তারা কিভাবে ব্যবসা করছে দেখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের দেওয়া পোস্টগুলো পড়তে হবে। এজন্য বড় বড় গ্রুপগুলো নিয়মিত ফলো করতে হবে।

এ নারী উদ্যোক্তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জামদানি নিয়ে উদ্ধাবনীমূলক কিছু করা। সেটা নিয়ে ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছেন। তিনি বলেন, দেশের বাইরেও জামদানি ছড়িয়ে দিতে চাই। এতে করে দেশীয় পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে এবং নতুন বাজার তৈরি হবে।

তিনি ২০২২ সালে উই আইসিটি গ্রান্ট পেয়েছিলেন। ওই বছরই উই এর উদ্যোক্তাদের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা হয়। তিনিও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একজন রেজিস্ট্রার্ড উদ্দোক্তা। এছাড়া তিনি ২০২৩ সালে উই নারী উদ্যোক্তা অ্যাওয়ার্ড ‘সাহসিকা’ পেয়েছেন।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়