ঢাকা     শনিবার   ০৯ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ২৫ ১৪৩১

‘বুকের মধ্যে বালিকা বিদ্যালয়’, দুই মলাটের ভেতরে পুরো পাঠশালা

আমিনুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:২০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৯:৩৩, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘বুকের মধ্যে বালিকা বিদ্যালয়’, দুই মলাটের ভেতরে পুরো পাঠশালা

রফিক মুয়াজ্জিন সাংবাদিকতা করেন। তার চেয়ে বড় পরিচয় তিনি কবি। মূলত, গীতিকবি হিসেবে তার পরিচিতি বেশি। আপাদমস্তক শৈল্পিক মানুষ। মানুষ যত যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে, ততই আবেগ-ভালোবাসা গিলে খাচ্ছে কর্পোরেট জগত। এই চিন্তা মাথায় রেখে, হৃদয়ে সেই আবেগমাখা অনুভূতিগুলো কবিতার মধ্যে দিয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন রফিক মুয়াজ্জিন। 

এবার অমর একুশে বইমেলায় ‘দশমিক’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে রফিক মুয়াজ্জিনের কাব্যগ্রন্থ ’বুকের মধ্যে বালিকা বিদ্যালয়’। ৪২টি কবিতায় সাজানো এ বইয়ের নামকরণ এবং আল-নোমানের প্রচ্ছদ প্রথম দেখাতেই মনোযোগ আকর্ষণ করে। মলাট ওল্টালেই ভালোলাগা আরও বেড়ে যায় কিছু চমৎকার কবিতা পড়তে পেরে। নানা বিষয়ে, নানা আঙ্গিকে লেখা ভিন্ন ভিন্ন রসের কবিতা। একেকটি কবিতা আমাদের একেকটি বিষয়ে শিক্ষা দেয়। এ যেন দুই মলাটের ভেতরে আস্ত একটি পাঠশালা। প্রথম কবিতা ‘ফেরা’ আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ভিন্ন ভাবনার অনুপম সৌন্দর্যের দিকে।
‘... ফিরে গেলে শুধু ফিরে যায় কারো দেহ
ফিরে গেলে ফেরা হয় কি না, রয়েছে সন্দেহ’

মানব মনে বিশাল বিস্তৃত আকাশ। সেখানে নানা ঘাত- প্রতিঘাত চলে। প্রতিটি কবিতায় কবি নিখুঁতভাবে সেগুলো অঙ্কন করেছেন। এখানে কিছু কবিতায় অন্ত্যমিলে এবং কিছু কবিতায় অন্ত্যমিলের তোয়াক্কা না করেই ছিমছাম সাদামাটা করে বলেছেন নিগুঢ় আবেগের কথা। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই মনে হয়নি যে কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। এ যেন এক নিপুণ হাতের কাজ, বলা যেতে পারে মুন্সিয়ানার ছাপ। মাইল বা কিলোমিটার নয়, রফিক মুয়াজ্জিন দূরত্ব মেপেছেন অভিমানের এককে— তিনি লিখেছেন ‘এক অভিমান দূরত্ব’। নিঃসঙ্কচে বলে দিয়েছেন, ’কোলের বালিশ ভালো বিকল্প নয়‘। 

কখনো কখনো বাস্তবতার চোরা কাঁটা বিঁধেছে। তিনি কবিতাকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন এই বলে যে, ‘কবিতা, পাশ ফিরে শোও’।

রফিক মুয়াজ্জিন প্রাত্যহিক জীবনের কঠিন বাস্তবতার দিকে তর্জনি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছেন, ক্ষুধার কাছে সবকিছু পরাজিত। আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া বাস্তবতার কাছে বারবার পরাজিত হয়। দিনশেষ অপূর্ণতা ও অতৃপ্তি নিয়েই বাঁচতে হয় সবাইকে। এমনই চিন্তার প্রয়োগ ঘটেছে ‘ভাত ও ভাতারের কাব্য’ কবিতায়—
‘যহন প্যাটের সাথে ভেতর কামড় দেয় ক্ষিদার পোকা
শইল্লে মানে না শইল্লের দাবি 
প্যাটের সাথে যোনির কাইজা লাগে’।

আবার ক্ষুধা নিবারণের বাইরেও যে মানুষের কিছু চাহিদা থাকে, সেটাও ভোলেননি কবি। শরীরের অন্যান্য অংশেরও যৌক্তিক দাবি আছে—
‘বত্রিশ বছরের যুয়ান গতর
পেত্তেকটা পশমের গোড়া যেন একেকটা যোনি’

যে কোনো লেখক বা কবিই তার বর্তমান সময় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। সমাজের নানা অসঙ্গতি উঠে এসেছে তাদের কাব্য, গল্পে, প্রবন্ধে, উপন্যাসে। রফিক মুয়াজ্জিনও তেমন করেই ‘সাহিত্য-সন্তানের জন্ম : প্রসব পেক্ষাপট’ দেখিয়েছেন। মানুষের বিবেক যখন বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, মানুষ যখন একাই বাঁচার অলীক চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছে, মানুষ যখন যান্ত্রিক, তখন কথা না রাখার সময় তো এসে গেছে। এতে ক্ষিপ্ত কবি তার প্রতিবাদের লাভা ঢেলেছেন কবিতায়। দ্বিমত পোষণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কথা রাখতেই হবে, এমন নাও হতে পারে। তিন পহরের বিলে একাই যেতে সক্ষম। রাস উৎসবে চৌধুরী বাড়ির মেয়েদের বিকল্প খুঁজে নিয়েছেন রূপালী পর্দায়। প্রচণ্ড হতাশা উগরে দিয়ে তিনি বলেছেন— ‘বৃদ্ধাশ্রম খুব খারাপ জায়গা নয়।’

‘বুকের মধ্যে বালিকা বিদ্যালয়’ বইটির বেশিরভাগ কবিতা প্রেমের। তবে, কবির চোখ এড়ায়নি সমাজের নানা সমস্যা। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক নিমেষে পড়ে ফেলার মতো বই এটি। কোথাও খেই হারিয়ে ফেলার মতো ছত্র লেখেননি কবি। দুর্বোধ্য, কঠিন শব্দ চয়ন করে পাণ্ডিত্য ফলাননি রফিক মুয়াজ্জিন। নিরেট জীবনবোধসম্পন্ন সচেতন কবির স্বার্থক হাতের ছোঁয়ায় রচিত হয়েছে ‘বুকের মধ্যে বালিকা বিদ্যালয়’। সাবলীল ভাষা প্রয়োগ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে ছন্দপতন এবং অলঙ্করণে কবি দ্বিধাগ্রস্ত হলেও আমার মনে হয়েছে, কবিতার গতি ঠিক রাখতে গিয়ে তিনি এটা সচেতনভাবেই করেছেন। সর্বোপরি, আমি মনে করি, এই কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে রফিক মুয়াজ্জিন সাহিত্যজগতে যে পদচিহ্ন রাখলেন, তা মুছে যাবে না সহজেই।  

লেখক : কবি ও গল্পকার; সম্পাদক, হেঁয়ালি

তারা//


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়