ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের নেপথ্যে কী?

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৫, ২১ মে ২০২১   আপডেট: ১৪:৪১, ২১ মে ২০২১
ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের নেপথ্যে কী?

ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধ এখন বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। যদিও প্রায় ১১ দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের বিরতি টানা হয়েছে। হামাস মূলত গাজা উপতক্যা থেকে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়ছিল। গাজার আয়তন মাত্র ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার। যা আমাদের গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (৩২৯ বর্গ কিমি) চেয়ে সামান্য বড়ো। এর অধিবাসীর সংখ্যা ২০ লাখের সামান্য বেশি। এর নিয়মিত কোনো সৈন্যবাহিনী নেই। তেল, জল, বিদ্যুৎ সবই আসে ইসরায়েল থেকে। চারদিক থেকে মিশর এবং ইসরায়েলের দেয়ালে অবরুদ্ধ একটি শহর- গাজা।

অন্যদিকে ইসরায়েল বিরাট সৈন্যবাহিনী ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রসমৃদ্ধ একটি দেশ। চারবার আরবের দেশগুলো জোট বেঁধে যুদ্ধ করেও ইসরায়েলকে পরাস্ত করতে পারেনি। উপরন্তু আরব দেশগুলোর বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে ফেলেছিল ইসরায়েল। এমন এক পরাক্রমশীল শক্তি হামাসের মতো একটি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুগের পর যুগ কেন যুদ্ধ করে যাচ্ছে? এই অসমযুদ্ধের আড়ালে কি অন্যকিছু আছে?

২০১৩ সালের আগস্টে যুথাম ফেল্ডম্যান ‘দ্য ল্যাব’ নামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয়, গাজা উপতক্যা ও পশ্চিম তীরের ৪০ লাখ মানুষ ইসরায়েলি বাহিনীর কাছে সমরাস্ত্র পরীক্ষার ‘গিনিপিগ’ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা মাঝে মাঝে খণ্ড যুদ্ধের জন্ম দেয় এই অস্ত্র বিক্রি বাড়ানোর জন্য। নতুন আবিষ্কৃত উন্নত প্রযুক্তির এসব অস্ত্র বিক্রি করে ইসরায়েল বিপুল অর্থ আয় করে। তা দিয়ে সে তার অর্থনীতি চাঙ্গা রাখে।

দ্য ল্যাবের এই দাবির সত্যতা পাওয়া যায় গত এক দশকে ইসরায়েলের সমরাস্ত্র রপ্তানির তালিকা দেখলে। ২০১০ সাল থেকে ইসরায়েলের সমরাস্ত্র রপ্তানি ক্রমাগত কমতে দেখা যায়। ২০১৪ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের সংঘাত যুদ্ধের রূপ ধারণ করে। ইসরাইল ৮ জুলাই ২০১৪ গাজায় ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’ শুরু করে। ইউএনএইচআরসি’র মতে এতে ২ হাজার ২৫১ জন মানুষ নিহত হয়। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই ছিল সাধারণ নাগরিক। এই সংঘর্ষের পরই ২০১৫ অর্থ বছরে ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানি এক লাফে প্রায় ৯৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। যা প্রায় দ্বিগুণ। পরের বছরও ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এর পর ক্রমাগত কমতে থাকে। ২০১৬ সালের ১৪ বিলিয়ন রপ্তানি গতবছর সাড়ে ৩ বিলিয়নের কাছাকাছি এসে ঠেকেছে।

ইসরাইল ছোট্ট একটি দেশ। আয়তন ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি। আমাদের রাজশাহী বিভাগের (১৮,১৫৪ বর্গ কিমি) চেয়ে সামান্য বড়ো। লোক সংখ্যা ১ কোটিরও কম। ধূসর মরুভূমি আর মরুদ্যানের সমন্বয়ে এর ভূপ্রকৃতি। নেই তেমন খনিজ সম্পদ। কৃষি উৎপাদনও সামান্য। অথচ মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার ৩৩৬ ডলার। যা আমাদের বিশ গুণের কাছাকাছি। এই বিরাণভূমিতে এমন অর্থনৈতিক সাফল্য সম্ভব হয়েছে অস্ত্র বিক্রির কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়েই। অথচ ৪ বছর ধরে ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানি বছর বছর হ্রাসের দিকে। এর মধ্যে ইসরায়েল আয়রন ডোমের মতো উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার করে বসে আছে। কিন্তু এর বিক্রি নেই।

১৩ এপ্রিল রমজানের প্রথম দিন জেরুজালেমের দামাস্কা গেটে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১৫ এপ্রিল গাজা থেকে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে রকেট হামলা শুরু হয়। ১৭ মে পর্যন্ত পাওয়া রিপোর্টে দেখা যায় হামাস প্রায় ৩ হাজার রকেট ছুঁড়েছে ইসরায়েলের দিকে। এর একটা বড় অংশ আয়রণ ডোম প্রযুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও কিছু রকেট ইসরায়েলি স্থাপনার উপর আঘাত হেনেছে বটে, তবে তাতে খুব একটা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। রকেট ধ্বংস করার এই নিখুঁত প্রযুক্তি নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশই ইতিপূর্বে আগ্রহ দেখিয়েছি। এর মধ্যে উত্তর কোরিয়া ও ভারত উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এ প্রযুক্তি খুবই ব্যয়বহুল। একটি রকেট ধ্বংস করতে ১ থেকে দেড় লাখ ডলার খরচ হয়ে যায়। তাই তারা এ প্রযুক্তি কিনতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু হামাসের রকেট মোকাবিলায় এ অস্ত্রের সাফল্য অনেক দেশকে এই ব্যয়বহুল প্রযুক্তি ক্রয় করতে উদ্বুদ্ধ করে তুলবে।

ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানি থেকে আয়ের চিত্র

ইসরায়েলের মতো একটি ছোট্ট দেশ পৃথিবীর ৩ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ করে। এর একটা বড়ো অংশ সরবরাহ করে মুসলিম দেশগুলোতে। ইসরায়েল কখনোই অস্ত্র বিক্রি সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ্যে আনে না। তবে ২০১৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের এক রিপোর্টে দেখা যায় এর আগের ৫ বছরে ইসরায়েল গোপনে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের কাছে নিরপত্তা সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে। এছাড়া মিশর, আলজেরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরক্কোও এ তালিকায় আছে। ইসরায়েল এখন ড্রোন রপ্তানিতে পৃথিবীতে প্রথম স্থানে রয়েছে। তাছাড়া গোয়েন্দা কাজের জন্য আড়িপাতার যন্ত্র সরবরাহের বাজার নিরঙ্কুশভাবে ইসরায়েলের দখলে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ ইসরায়েলের এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।

এই অস্ত্রই ইসরায়েলের ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর অবস্থান টলিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। যে জর্ডান ও মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে একাধিকবার যুদ্ধ করেছে, তারাও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক করেছে মরক্কো ও সুদান। সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের গোপন আঁতাতের কথা এখন প্রকাশ্য। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের এই সখ্যের কারণে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর আক্রমণের পরও মুসলিম বিশ্ব নীরব। ওআইসিও’র ভূমিকাও সন্দেহজনক। এসবের নেপথ্যে রয়েছে অস্ত্রের ব্যবসা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হতো ‘গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার’। ইসরায়েল এখন সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েল সমরাস্ত্র গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে নরেন্দ্র মোদীর ইসরায়েল ভ্রমণের পর থেকে ভারত চাচ্ছে এই সম্পর্ককে ত্রিপাক্ষিক রূপ দিতে। যে ভারত ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে বিরোধিতা করে আসছে, ১৯৪৯ সালে ইসরায়েলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল, সেই ভারত বলছে ইসরায়েলের প্রযুক্তি ও ভারতের জনশক্তি দু’দেশের উন্নয়নে কাজ করবে। ইতোমধ্যে ভারতের সাড়ে ১৩ হাজার স্বাস্থ্য কর্মী সেখানে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ইসরায়েলকে চীনবিরোধী যুদ্ধে কাছে পেতে চায়।
এছাড়া ইসরায়েল অবৈধ সরকারগুলোর কাছে চড়ামূল্যে গোপনে অস্ত্র ও নিরাপত্তা সামগ্রী বিক্রি করে। অভিযোগ আছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারে কাছে ইসরায়েল প্রচুর অস্ত্র ও ড্রোন বিক্রি করেছে। এসব অস্ত্র রোহিঙ্গা নিধন ও বিতাড়নে ব্যবহার করেছিল মিয়ানমার সরকার। 

সূত্র: haaretz.com, knoema.com, আলজাজিরা, বিবিসি

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়