ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পরিবর্তনেই কি সমস্যার সমাধান  

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ২৮ মার্চ ২০২২  
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস পরিবর্তনেই কি সমস্যার সমাধান  

বেসরকারি অনার্স কলেজে পড়াশোনা করে অনেকেই চাকরি পান না। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিরাট একটা ব্যবধান তৈরি হয়। ফলে তৈরি হয় হতাশা। এ কথা আজকে অনেকেই বলেন, বেসরকারি কলেজগুলোকে আরও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি পরিমাণে প্রায়োগিত জ্ঞান পাবেন। যেটা তাদের চাকরি পেতে সহায়ক হবে। দেশও উপকৃত হবে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বহুমুখী উদ্যোগ জরুরি। এর মধ্য অন্যতম হচ্ছে স্কুল-কলেজগুলোতে পাঠ ও কারিকুলামকে কর্মবান্ধব করে তোলা। এজন্য বেসরকারি কলেজগুলোয় কারিগরি শিক্ষা যোগ করা উচিত।

শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, আমরা সনদধারী বেকার তৈরি করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছেন। কাজেই যারা অনার্স-মাষ্টার্স করবেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই করবেন। ডিগ্রী পাস কোর্সে পাশাপাশি বিভিন্ন শর্ট কোর্সও খোলা হবে। 

এদিকে অনার্স-মাষ্টার্স কলেজগুলোতে ডিপ্লোমা ও শর্ট কোর্স চালু করতে কৌশল নির্ধারণে কাজ করছে ১৪ সদস্যের একটি কমিটি। কমিটির অনেকে অনার্স কোর্স বন্ধের পক্ষে নন। বলা হচ্ছে, বন্ধ করতে নয়, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কলেজে ডিপ্লোমা কোর্স চালুর। অনার্স-মাষ্টার্স কোর্স চালুর পাশাপাশি যদি শর্ট কোর্স ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়, তাহলে বন্ধ হলো কোথায়? গণমাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন কৌশল নির্ধারণী কমিটির সভাপতি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি বলেছেন, আমরা অনার্স মাস্টার্স কোর্স বন্ধ করাকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। শর্ট কোর্স বা ডিপ্লোমা চালুর বিষয়টি প্রাধান্য দিচিছ। অনার্স কোর্স ধরে রেখে তার গুণমান ধরে রাখা হবে। তবে, অনার্স কোর্স সীমিত করার কথাও বলেন তিনি। 

কমিটির আরেক সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ড. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, কমিটি ২৭টি ডিসিপ্লিনের মধ্যে থেকে ১০টি ডিসিপ্লিনের ওপর কাজ করছে। এসব ডিসিপ্লিনের ওপর ডিপ্লোমা/শর্ট কোর্স চালু করা হবে। এই কোর্স চালু হবে ডিগ্রী পাস/অনার্স স্তরের পড়াশোনা শেষে। সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের এই কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। তাদের নিয়েই সিলেবাস, কারিকুলাম তৈরি হবে। ডিপ্লোমা কোর্স বা শর্ট কোর্স পরিচালনার সামর্থ্য আছে শুধু সে কলেজেই এসব ডিসিপ্লিনের কোর্সগুলো চলবে। কমিটির অন্য এক সদস্য বলেন, গ্রামে অনেক অনার্স-মাস্টার্স কলেজ রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাতে গোনা। এসব কলেজে অনার্স-মাস্টার্স চালুর প্রয়োজন নেই। কোনো কোনো কলেজের মানও নেই। নেই অবকাঠামো সুবিধা। এসব কলেজগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে, এসব কলেজে অনার্স-মাস্টার্স বন্ধ করা হবে।

এদিকে এ খবরে বেসরকারি কলেজের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক যাদের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। যদিও সরকার বলছে, অনার্স মাস্টার্স কোর্স বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। শিক্ষিত বেকার যাতে তৈরি না হন, শিক্ষার্থীরা যদি উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে চান, অনার্স-মাস্টার্স করতে চান তাদের এই কোর্সের পাশাপাশি অন্যান্য পেশাগত কোর্স করার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। 

এ দিকে বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফোরামের সভাপতি নেকবর হোসেন বলেন, ২৮ বছর ধরে কোর্সগুলো চলছে। আমরা যখন এমপিওভুক্তির দাবির জন্য সোচ্চার হলাম, তখনই অনার্স-মাস্টার্স কোর্স বন্ধের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরা হলো। এটা অমানবিক। 

এমপিওভুক্ত কলেজগুলোতে ১৯৯৩ সালে অনার্স-মাষ্টার্স স্তরের অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সারা দেশে এ ধরনের মোট ৩১৫টি সরকার অনুমোদিত বেসরকারি কলেজ রয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিধিবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত স্কেলে শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তে অনার্স-মাষ্টার্সের বিষয় পড়ানোর অনুমোদন নেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কলেজের টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এসব কলেজে ৬ হাজারের মতো শিক্ষক আছেন। আর শিক্ষার্থী আছে ৭ লাখের বেশি। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কেউ চাকরি হারাবেন না। এসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন। 

ইউজিসি বলছে, মাস্টার্স স্তরের শিক্ষা শুধু বাছাই করা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। এখানেও ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বছাই করা উচিত। বর্তমানে স্নাতক শেষেই নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, দেশের উচ্চ স্তরে চার বছর মেয়াদী স্নাতক ডিগ্রিকে প্রান্তিক বা সর্বশেষ ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়। কাজেই মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম কেবলমাত্র বাছাইকৃত মেধাবী স্নাতকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। এসব বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছে ইউজিসি। 

তথ্য অনুযায়ী দেশে ৫০টি সরকারি ও বেসরকারি ১০৭টি মিলিয়ে মোট ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ১৯ হাজার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ হাজার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৩ হাজার শিক্ষার্থী পড়ছে। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে ৫৫ হাজার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ছে ২৩ হাজার। সব মিলিয়ে মাস্টার্সে পড়ছে ৪ লাখ শিক্ষার্থী। ইউজিসি বলছে এতসংখ্যক শিক্ষার্থীর এই স্তরে পড়ার প্রয়োজন নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও অনার্স কলজেসমূহে মাস্টার্স পর্যায়ে পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা এবং যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক না থাকা সত্ত্বেও মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। ফলে, এসব প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষাদান সম্ভব হচ্ছে না। 

২০১৪ সালে প্রকাশিত ৪১তম প্রতিবেদনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়র অধীনস্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ইউজিসি। সেই প্রতিবেদনেও মাস্টার্সে ঢালাও ভর্তি বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ করে কতিপয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজ থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটছে, তবু শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।  

উপরোক্ত আলোচনা, সিদ্ধান্ত এবং বিরোধিতা সবগুলোই অত্যন্ত বাস্তব। আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশের কলেজগুলো থেকে যারা অনার্স মাষ্টার্স করছেন ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের অনেককেই চাকরির বাজারে অনেক বেগ পেতে হয়। তাই কর্মমুখী শিক্ষার কথা, টেকনিক্যাল এডুকেশনের কথা চিন্তা করা হচ্ছে।  বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। একদিকে শিক্ষার অধিকার সবার রয়েছে। শিক্ষাগ্রহণে কারো জন্য বাধার সৃষ্টি করা যাবে না। সুকুমার বৃত্তির চর্চা, মানবিক গুণাবলীর চর্চা ও বিস্তার ঘটাতে হবে শিক্ষার মাধ্যমে। কর্মমুখী করার উদ্দেশ্যে শিক্ষাকে যান্ত্রিক করা যাবে না। একজন মানুষ উপার্জন করতে পারবে এজন্য তাকে মানবিক গুণাবলীর চর্চা না করিয়ে শুধু উপার্জন উপযোগী করে তৈরি করলে সমাজে অর্থনৈতিক উন্নতি কিছুটা হবে হয়তো, কিন্তু মানবিক গুণাবলীর কি হবে? তাই, উচ্চশিক্ষার সংকোচন নয়। যে যে কাজই করুক না কেন, যে বয়সেরই হোক না কেন কেউ যদি চান যে, তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবেন তাকে সেই সুযোগ দিতে হবে। এটি রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। 

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক


 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়