যেভাবে নেবেন রমজানের প্রস্তুতি
রমজান মাস ইবাদতের ‘বসন্তকাল’। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের বিশেষ মৌসুম। বছর ঘুরে সেই রমজান আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করাই হলো রমজানের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য এক প্রশিক্ষণের মাস। যার মাধ্যমে রোজাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাস ভালোভাবে যাপন করবে, তার পুরো বছর ভালোভাবে যাপিত হবে।’
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজার কয়েক মাস পূর্ব থেকেই রোজার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করতেন। তিনি এ মাসের আগমনে পুলকিত হয়ে সাহাবায়ে কেরামদের (রা.) মোবারকবাদ জানাতেন। কিন্তু বর্তমানের মানুষের প্রস্তুতি দেখলে মনে হয়, রমজান শুধু ভোগের মাস। ভালো খাওয়ার মাস। আনন্দ-উৎসবের মাস। পণ্য মজুদের মাস। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাস। আসলে তা নয়। বরং রমজান হলো ত্যাগের মাস। রমজান ইবাদত-বন্দেগির মাস। আল্লাহর রহমত বরকত মাগফেরাত নাজাত ও যাবতীয় কল্যাণ লাভের মাস। চলুন রমজানের প্রস্তুতির জন্য কীভাবে পরিকল্পনা করবেন সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক:
ফরজ রোজার নিয়ম-কানুন জেনে নেওয়া
রমজান মাস আসার আগে রোজা পালনের মাসয়ালা-মাসায়েল তথা নিয়ম-কানুনগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি। এতে রোজা নষ্ট বা মাকরুহ হবে না এবং রোজার পরিপূর্ণ সওয়াব অর্জন করা যাবে।
বিগত রমজানের অসমাপ্ত কাজ চিহ্নিত করা
রমজান মাস আসার আগে বিগত রমজানের নেক আমলগুলো করতে না পারার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। যেমন- কেন নিয়মিত কুরআন পাঠ করা হয়নি? কেন তারাবিহ পড়া হয়নি? কেন দান-সদকা করা হয়নি? কেন ইতেকাফ করা হয়নি? কেন রোজাদারকে ইফতার করানো হয়নি? কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা সম্ভব হয়নি? কেন কুরআন-সুন্নাহর আলোচনায় বসা হয়নি? কেন রমজানে পরিবারের লোকদের হক আদায় করা হয়নি? কেন পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের হক আদায় করা হয়নি? এ বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নেওয়া। এ বছর রমজান আসার আগে আগে চিহ্নিত কারণগুলো থেকে নিজেকে বিরত রেখে কিংবা প্রস্তুতি গ্রহণ করে কল্যাণকর সব নেক আমলগুলো করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
রমজানের ২৪ ঘণ্টার রুটিন করা
রমজান মাসজুড়ে আপনি যে কাজেই থাকুন না কেন, পুরো সময় কোন কোন কাজে কীভাবে ব্যয় হবে তার একটি সম্ভাব্য রুটিন তৈরি করে নেওয়া। রুটিন করা থাকলে রমজানে চরম ব্যস্ততার মাঝেও নেক আমলসহ অন্যান্য কাজগুলোও ইবাদতের মধ্যেই কেটে যাবে।
রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান করা
শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদের অনুসন্ধান করা সুন্নাত। হারিয়ে যাওয়ার পথে থাকা এ সুন্নাতটিকে আবারও জীবিত করার পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এই চাঁদ দেখার অনেক ফজিলত রয়েছে।
গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা
সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। বিশেষ করে দেখা ও শোনার গুনাহ থেকে। কারণ, এই দুই গুনাহ কলব বা অন্তর কলুষিত করে ফেলে। কলবে অন্ধকার তৈরি করে। আমলের স্বাদ নষ্ট করে দেয়।
প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা
মাহে রমজানে ঈমান আমল, কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত এবং ইসলামের জরুরি বিষয়গুলো শিখে ফেলা যায়। কারণ রমজানে যেভাবে সময় করা যায় এবং মানুষের দিল নরম থাকে, অন্য সময় সেভাবে হয়ে ওঠে না।
ব্যবসায়ীর মজুদদারি বন্ধ করা
রমজান মাসে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকে গণমানুষকে ঠকিয়ে বেশি লাভ করার। তাদের এই মনোভাবের যুক্তিগ্রাহ্য কারণ না থাকলেও বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। চাল, ডাল, ছোলা, চিনি, ভোজ্য তেল, খেজুর ইত্যাদির দাম হয় গগণচুম্বী। একজন মুসলমান ব্যবসায়ীর রমজানকেন্দ্রিক এমন প্রস্তুতি কখনও হতে পারে না। কারণ পণ্য মজুদকরণের মাধ্যমে দাম বাড়ালে সে ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহ তায়ালা ক্ষুব্ধ হন এবং সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
কুরআন তেলাওয়াত বাড়িয়ে দেওয়া
কুরআন তেলাওয়াতের পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়িয়ে সাধারণ তেলাওয়াতের পাশাপাশি বুঝে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করা। বুঝে তেলাওয়াত বেশি না পারলেও প্রতিদিন কমপক্ষে এক আয়াত হলেও বুঝে পড়ার চেষ্টা করা। আর প্রতিদিন রুটিন করে অবশ্যই কুরআন তেলাওয়াত করা। কুরআন তেলাওয়াত যেন ছুটে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা। কুরআনের সান্নিধ্যে থাকার সময় মোবাইল-ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করা।
বেশি পরিমাণে আল্লাহর জিকির করা
অহেতুক কথা না বলে, বেশি বেশি আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকা। অতি প্রয়োজন ছাড়া দুনিয়াবি কথা থেকে বিরত থাকা। প্রয়োজনহীন কথা কলবের সজীবতা নষ্ট করে দেয়। আল্লাহর জিকির কলবকে সজীব রাখে। প্রাণবন্ত করে তোলে। আল্লাহর জিকিরহীন কলব ক্রমে নির্জীব হয়ে যেতে থাকে।
বেশি বেশি দরুদ ও সালাম পাঠ করা
প্রত্যেক মুমিনের জন্য প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরুদ শরিফ পাঠ করা উত্তম ইবাদত। এটি মানুষের জন্য একমাত্র ইবাদত যা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ও ফেরেশতারা পালন করেন এবং পৃথিবীর সব ঈমানদারকে নবীর প্রতি দরুদ পড়ার নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা নিজেই দিয়েছেন।
তওবা ও ইস্তেগফার করা
মানুষ স্বভাবত শয়তানের ধোকায় নিজেকে গুনাহের কাজে লিপ্ত করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা হলেন, গাফির-ক্ষমাকারী, গফুর-ক্ষমাশীল, গাফফার-সর্বাধিক ক্ষমাকারী। তাই বান্দা যখন নিজের গুনাহের জন্য অনুতপ্ত, লজ্জিত হয় এবং তওবা ও ইস্তেগফার পাঠ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তখনই আল্লাহ তায়ালা বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। তওবাকারীকে আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন।
যাবতীয় অপ্রয়োজনীয়তা পরিহার করে চলা
অপ্রয়োজনীয় মত-বিনিময়, গাল-গল্প ইত্যাদি রমজানের নূর নষ্ট করে ফেলে। যেসব বিষয় মুবাহ বা বৈধ, সেগুলোও পারতপক্ষে এড়িয়ে চলা। বিশেষ করে চোখ ও কানকে আপাত বৈধ তবে অপ্রয়োজনীয় বিষয় থেকেও যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা।
সব কাজ গুছিয়ে রাখা
রমজান ইবাদতের মাস। তাই রমজানের আগেই যদি পারিবারিক, ব্যবসায়িক ও পেশাগত কাজগুলো গুছিয়ে রাখা যায়, তবে রমজানে অধিক সময় ইবাদতে মগ্ন থাকা যাবে। বিশেষত নারীরা সাংসারিক কাজ গুছিয়ে রাখলে তারা ইবাদতে বেশি সময় দিতে পারবেন।
বেশি বেশি দান-সদকা করা
ইসলাম সাম্যের ধর্ম। তাই ধনবান ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে গরিব ব্যক্তিদের দান করার নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) নিজে সর্বদা বেশি বেশি দান-সদকা করতেন এবং সাহাবিদের দান করতে উৎসাহ দিতেন।
সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করা
আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসে অনেক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে এ সাধারণ ক্ষমা সবার ভাগ্যে জোটে না। কেননা এ ক্ষমা পেতে হলে দুটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করে তা থেকে ফিরে আসতে হবে। তা হলো- শিরক থেকে মুক্ত থাকা আর হিংসা থেকে মুক্ত থাকা।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম
/তারা/