সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী মহানবী সা.
বছর ঘুরে আবার এলো বারো রবিউল আউয়াল। এটা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমন ও বিদায়ের দিন। তিনি মানবতার মুক্তির দূত রাহমাতুল্লিল আলামিন। পৃথিবীর একমাত্র ইনসানে কামেল বা পরিপূর্ণ মানব। তাঁর আগমনের দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাঁর সীরাত চর্চা ও আদর্শ অনুসরণের কথা। তাঁকে মহব্বত ও ভালোবাসার কথা। পৃথিবীর সব কিছু থেকে তাঁকে বেশি ভালোবাসা ছাড়া কোনো মানুষ মুমিন-বিশ্বাসী হতে পারে না। আর মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে হয়। মুখে মুখে বুলি আওড়ানোর নাম কখনো ভালোবাসা হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণই আন্তরিকতার ব্যাপার।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। কোনো মানুষ তার সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা, তার কোনো একটি গুণের সমানও হতে পারবে না। তাঁকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘ওয়া ইন্নাকা লাআ’লা খুলুকিন আজিম’। অর্থাৎ এবং নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। [সুরা কলম: আয়াত ৪]
আয়াতে ব্যবহৃত ‘আজিম’ শব্দটি আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর একটি। যার অর্থ আল্লাহ তায়ালা এমন মহান বা বিশাল সত্তা যার মহানত্ব ও বিশালতা সীমা-পরিসীমা আমাদের কল্পনা, চিন্তা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে। অর্থাৎ তিনি সীমা বা আয়ত্বের দুর্বলতা থেকে পবিত্র। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নৈতিক চরিত্রের মহানত্ব প্রকাশ করার জন্য ‘আজিম’ শব্দ ব্যবহার করে এই কথাই বুঝানো হয়েছে যে, তাঁর চরিত্রের বিশালতাও সীমাহীন। আমাদের কল্পনা, চিন্তা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাইরে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পরপর ভিনদেশী একজন নওমুসলিম মদিনায় আসেন। তার উদ্দেশ্য হলো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র সম্পর্কে জানা। সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত শোকগ্রস্ত। তিনি যার কাছেই যাচ্ছেন তিনি অন্য একজনকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে ব্যক্তি পরম্পরায় অবশেষে তিনি হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এলেন। তিনি হজরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র কেমন ছিল? তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু পাল্টা ওই ব্যক্তিকে বললেন, আচ্ছা আপনি তো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন, তার আগে আপনি পৃথিবীর দ্রব্যসামগ্রীর একটা বর্ণনা আমার কাছে পেশ করুন তো?
আগন্তুক আশ্চর্য হয়ে বললেন, তা কী করে সম্ভব হতে পারে? পৃথিবীর দ্রব্যসামগ্রীর বর্ণনা দেওয়া কি কারো পক্ষে আদৌ সম্ভব?
তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আরে ভাই! পবিত্র কুরআনে দুনিয়ার দ্রব্যসামগ্রীকে মহান আল্লাহ ‘কালিলা’ বা স্বল্প বলে আখ্যায়িত করেছেন, আপনি এই স্বল্পের বর্ণনাই দিতে পারছেন না, তাহলে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্রের বর্ণনা কীভাবে দেব, যাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ‘খুলুকুন আজিম’ তথা মহান চরিত্রের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন!
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সংজ্ঞা দিয়েছেন উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি বলেছেন, কুরআনই ছিল তাঁর চরিত্র।
যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন জীবন্ত কুরআন, সেহেতু তাঁর চরিত্রও ছিল মহান। তাঁর চরিত্র বা সুন্নাহ সব কালের জন্য প্রযোজ্য। তাঁর চরিত্র বা সুন্নাহ কখনো সেকেলে বা পুরাতন হয় না। বরং সব যুগে সব কালে রাসুলের চরিত্র ও সুন্নাহ নতুনভাবে কার্যকর। তাই তাঁর মহান চরিত্র চির আধুনিক এবং যেকোনো যুগ বা কালের সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে। আর এটিই ‘খুলুকে আজিম’ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ পৃথিবী যখন যেই সমস্যার সম্মুখীন হবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র ও সুন্নাহ তখন কার্যকর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।’ [সুরা আহযাব : আয়াত ২১] কল্পনাবিলাসী কবিরাও তাঁর চরিত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, খোদার পরে তুমিই শ্রেষ্ঠ, সংক্ষেপে আমরা এই তো জানি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্ববাসীর জন্য সুন্দরতম নমুনা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি শারীরিক গঠন কাঠামোর দিক দিয়েও ছিলেন নজিরবিহীন। তাঁর মতো অঙ্গ সৌষ্ঠবের অধিকারী এত সুন্দর আর কেউ ছিল না, কেয়ামত পর্যন্ত হবেও না।
তিনি বিশুদ্ধ আরবি ভাষায় কথা বলতেন। অসঙ্কোচ, অনাড়ষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক ও অর্থপূর্ণ কথা। সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতার গুণবৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে ছিল। পাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজ থেকে তিনি দূরে থাকতেন। তিনি ক্রোধ ও অন্যায় ব্যবস্থা থেকে দূরে ছিলেন। তাঁর দান ও দয়াশীলতা পরিমাপ করা অসম্ভব ছিল। তিনি কল্যাণ ও দানশীলতায় পরিপূর্ণ বাতাসের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন। বীরত্ব ও বাহাদুরীর ক্ষেত্রে তাঁর স্থান ছিল সবার উপরে। তিনি ছিলেন সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বীর। তিনি সুকঠিন সময়েও পেছনে না হটে সামনে এগিয়ে যেতেন। তাঁর চেয়ে বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে অন্য কেউ শত্রুর মোকাবেলা করতে সক্ষম হতো না।
তিনি ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। তিনি সাধারণত মাটির দিকে দৃষ্টি রাখতেন। কোনো কিছু তাঁর পছন্দ না হলে তাঁর চেহারা দেখেই বোঝা যেত। লজ্জাশীলতা ও সম্মানবোধ এত প্রবল ছিল যে, কারো মুখের ওপর সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি ন্যায়পরায়ণ পাক-পবিত্র, সত্যবাদী এবং বিশিষ্ট আমানতদার। বন্ধু, শত্রু সবাই এটা স্বীকার করতেন। তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী ও নিরহঙ্কার। নিজের জুতো, কাপড় নিজেই সেলাই করতেন।
অঙ্গীকার পালনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তিনি আত্মীয়-স্বজনের প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন। মানুষের সঙ্গে হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মিশতেন। স্বভাবগতভাবেই তিনি কখনো অশালীন কথা বলতেন না। কাউকে কখনো অভিশাপ দিতেন না। উচ্চস্বরে কথা বলতেন না। তাঁর খাবার-দাবার, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা সবকিছু সবার প্রতি সমান ছিল। তিনি কাউকে ছোট মনে করতেন না। তিনি বেশিরভাগ সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না। কথার শুরু ও শেষে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। তিনি ছিলেন নরম মেজাজের অধিকারী। তিনি কখনো কারো সমালোচনা করতেন না। সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী কিছু দেখলে বিরক্ত হতেন। তাঁর মন ছিল বড় উদার। তিনি কাউকে ইশারা করতে চাইলে হাতের পুরো তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত উল্টাতেন। ক্রুদ্ধ হলে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং খুশি হলে দৃষ্টি নিচু করতেন। বেশিরভাগ সময়ে মৃদু হাসতেন। হাসির সময়ে তাঁর দাঁতের কিয়দংশ ঝকমক করত।
তিনি সম্মানিত লোককেই নেতা নিযুক্ত করতেন। মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতেন। সাহাবায়ে কেরামের খোঁজখবর নিতেন। সব বিষয়েই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতেন। কোনো বিষয়ে অমনোযোগী থাকা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর কাছে তাঁদের মর্যাদাই ছিল অধিক, যারা ছিলেন অন্যের দুঃখে কাতর, স্বভাবতই গম্ভীর এবং অন্যের সাহায্যকারী। তিনি উঠতে বসতে সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তাঁর বসার জন্য আলাদা কোনো জায়গা ছিল না। যেখানে খালি জায়গা পেতেন সেখানেই বসতেন। তিনি তাদেরকেই বেশি সম্মান দিতেন যারা বেশি তাকওয়ার অধিকারী। তাঁর মজলিস বা সমাবেশ ছিল জ্ঞান, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা ও আমানতদারীর মজলিস। তিনি বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে আদেশ দিতেন।
তিনি সব ধর্মের প্রতি উদারতায়, বিধর্মীদের সঙ্গে ব্যবহারে, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মহামানবতায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে, নারীজাতির উন্নয়নে, মাতৃভক্তিতে, সাম্য ও মৈত্রী স্থাপনে, সুদক্ষ কূটনীতিকরূপে, ক্রীতদাসদের মুক্তিদানে, জ্ঞান-সাধনায়, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতায়, ক্ষমায়, ন্যায়বিচারে, বদান্যতায়, জীবে দয়ায়, শ্রমের মর্যাদা দানে, স্বামীরূপে, পিতারূপে, স্বাবলম্বনে, চরিত্র-মাধুর্যে, বীরবেশে, রাষ্ট্রনায়করূপে, সেনাপতিরূপে, আদর্শ প্রতিষ্ঠায়, বিবাহ-প্রথার উন্নয়নে, বহুবিবাহের ব্যবস্থায়, যুগ সমস্যার সমাধানে, বৈজ্ঞানিকরূপে, অতিথি সেবায়, আর্ত-পীড়িত ও দুর্গতদের সেবা ও সাহায্যদানে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, নাগরিক জীবনের কর্তব্য পালনে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল মানুষরূপে তথা মানবীয় গুণাবলির সর্বোচ্চ শিখরে তাঁর স্থান ছিল। মোটকথা সব গুণবাচক বিশেষণের তিনিই ছিলেন শেষ কথা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, অর্থনৈতিক জীবনে, শিক্ষা জীবনে, বিচার ব্যবস্থায়, জিহাদ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথা সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন আদর্শের মূর্তপ্রতীক। কিন্তু মানব রচিত মতবাদের ব্যর্থতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছেন তা নিশ্চিত করা। তাঁর অনুসারীরা তাঁর এ আদর্শকে ১০০ ভাগ বাস্তবায়ন করে একটি সোনালি সমাজের ভীত নির্মাণ করেছেন। বহু শতাব্দী অতীত হয়ে যাওয়ার পরেও আজকের সমাজ ও সভ্যতা যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবদান। তাঁকে আমাদের আদর্শ হিসেবে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেওয়া প্রয়োজন। তবেই আমরা নিজেদেরকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাঁটি উম্মত হিসেবে দাবি করতে পারব এবং হাশরের কঠিন দিনে তাঁর সুপারিশ লাভে ধন্য হতে পারব। তাই শুধু দিবসকেন্দ্রিক নয়, সারা বছরই আল্লাহর রাসুলের আলোচনা, আদর্শ চর্চা এবং তা পরিপালনের প্রয়াস চালাতে হবে।
/তারা/