প্যানিক অ্যাটাক থামানোর উপায়
![প্যানিক অ্যাটাক থামানোর উপায় প্যানিক অ্যাটাক থামানোর উপায়](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2021September/panic-attack-risingbd-2110311026.jpg)
গভীর রাত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ফারিনের। একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে থাকল তার। বুকের কাছে হাত দিয়ে দেখল হৃৎপিণ্ড প্রচণ্ড গতিতে লাফাচ্ছে। মুহূর্তেই ঘেমে গেল কপাল, মুখ, হাতসহ সারা শরীর। তীব্রভাবে কাঁপতে থাকল সে। মনে হলো কেউ যেন জোরালোভাবে তার গলা চেপে ধরেছে; প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল। বাতাসের প্রয়োজনে হাঁপাতে থাকল সে। হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হলো।
পেটে মোচড় দিয়ে বমি হওয়ার উপক্রম হলো। তীব্র গরম লাগতে থাকল তার। হাত-পা অবশ হয়ে আসতে লাগল। মাথা ঘোরা শুরু হলো; তার মনে হলো সে পড়ে যাবে। চারপাশের সবকিছু অবাস্তব লাগতে থাকল। সে আর নিজের ভেতরে নেই, এমন অনুভব করতে থাকল। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে বলে মনে হলো তার। মনে হতে থাকল, এই বুঝি হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবে। প্রচণ্ড মৃত্যুভীতি তাকে গ্রাস করতে থাকল।
এই ঘটনা যে কারও ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। এটা মূলত প্যানিক অ্যাটাক। প্যানিক অ্যাটাক একধরনের মানসিক সমস্যা। অত্যধিক দুশ্চিন্তা-ভয়-আতঙ্কে হঠাৎ করে শারীরিক প্রতিক্রিয়া ঘটলে বা উপসর্গ প্রকাশ পেলে তাকে প্যানিক অ্যাটাক বলা হয়। এর পেছনে যুক্তিসংগত কারণ বা প্রকৃত বিপদের উপস্থিতি থাকে না। যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগেভাগে অনুমান করা যায় না যে প্যানিক অ্যাটাক হবে।প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার জন্য ভয়-আতঙ্ক-দুশ্চিন্তার নির্দিষ্ট উৎস নেই। যেকোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রবল ভয়ভীতিতে আচ্ছন্ন হলে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রিস্ট ডেভিড এ. মেরিল বলেন, ‘অনেকের একবার প্যানিক অ্যাটাক হলে পরবর্তীতে আর হয় না।অন্যদের বারবার প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।’
প্যানিক অ্যাটাকের উপসর্গ সম্পর্কে জানা থাকলে এটা সামাল দিতে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। অ্যানজাইটি অ্যান্ড ডিপ্রেশন অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার মতে, প্যানিক অ্যাটাকের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো- বুক ধড়ফড় বা দ্রুত হৃদস্পন্দন, ঘেমে যাওয়া, শরীর কাঁপা, শ্বাসকষ্ট, শ্বাসরোধ হচ্ছে মনে হওয়া, বমিভাব, পেট কামড়ানো বা টাইট হওয়া, মাথাঘোরানো বা চেতনা হারাচ্ছে মনে হওয়া, অসাড়তা বা শরীর ঝিনঝিন করা, ঠান্ডা বা গরম লাগা, আশপাশের সবকিছুকে অবাস্তব মনে হওয়া, মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা ও মৃত্যু হতে যাচ্ছে মনে হওয়া। এসব উপসর্গের মধ্যে চারটি বা ততোধিক উপসর্গে ভুগলে ধরে নিতে পারেন যে প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে। তবে এর চেয়ে কম উপসর্গ নিয়েও প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, প্যানিক অ্যাটাকের ক্ষেত্রে শরীরের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম অত্যধিক সক্রিয় হয়ে যায়।আপনার মন কিছু একটাকে কেন্দ্র করে আতঙ্কিত হয়ে পড়লে এবং আপনি সেটাকে এড়িয়ে না চললে দ্রুত প্যানিক অ্যাটাক হবে এবং এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হবে।সাধারণত প্যানিক অ্যাটাকের স্থায়িত ১০ মিনিট। এরপর শারীরিক প্রতিক্রিয়া কমতে থাকে। চিকিৎসকেরা জানান, প্যানিক অ্যাটাককে ভয়াবহ মনে হলেও শরীরের ক্ষতি হয় না। যেকারো জন্য প্যানিক অ্যাটাক একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এর ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। যদি মনে করেন যে প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে, তাহলে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তা থামানো যেতে পারে।
* গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসে মনোযোগ দিন
প্যানিক অ্যাটাকের সময় এমনকিছু করতে হবে যা শরীরে শিথিল অনুভূতি সৃষ্টি করে। যেমন ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিতে পারেন। গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রিত শ্বাসপ্রশ্বাস বলতে পারেন। গবেষণা বলছে, নিয়ন্ত্রিত শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত শরীরের শিথিলায়ন প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করতে পারে এবং হৃদস্পন্দন কমাতে পারে। প্যানিক অ্যাটাক থামাতে এভাবে গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস চর্চা করতে পারেন-
স্বস্তিদায়ক স্থানে দাঁড়ান, বসুন বা শুয়ে থাকুন।
একটি হাত পেটের ওপর রাখুন।
নাকের মাধ্যমে গভীর শ্বাস নিয়ে পেটকে বাতাসে পূর্ণ করুন।
এরপর ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। ফুসফুস থেকে সব বাতাস বের করে দিন। হাত দিয়ে পেটের প্রসারণ ও সংকোচন খেয়াল করুন।
এটা ১০ বার রিপিট করুন।প্রয়োজনে আরো বেশি।
* বর্তমানে মনোনিবেশ করুন
প্যানিক অ্যাটাকের সময় মাইন্ডফুলনেস চর্চা করলেও কাজে আসতে পারে। মাইন্ডফুলনেস মানে হলো বর্তমান মুহূর্তে বাস করা। যখন যেখানেই প্যানিক অ্যাটাক হোক না কেন, ওই মুহূর্তে আশপাশের বিষয়বস্তুতে গভীর মনঃসংযোগ করলে দুশ্চিন্তা বা আতঙ্ক দূর হবে। এসময় কোনোকিছু বিচার করতে যাবেন না। নিজের মতাদর্শের সঙ্গে মেলাতে যাবেন না। করণীয় কি- সেটা নিয়েও মাথা ঘামাবেন না। শুধু দেখবেন বা পর্যবেক্ষণ করবেন। অথবা অনুভব করবেন। মাইন্ডফুলনেসের কিছু উদাহরণ হলো- খাবারে মনোনিবেশ করা, তাপমাত্রা অনুভব করা, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি উপভোগ করা, শব্দ শোনা, ঘ্রাণ নেওয়া, গণনা করা ও প্যাটার্ন বা গঠনপ্রকৃতি লক্ষ্য করা। কিছু একটা করার সময় নিজ শরীরকে পর্যবেক্ষণ করাও মাইন্ডফুলনেসের অন্তর্ভুক্ত, যেমন- গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় পেটের ওঠানামা অনুভব করা।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
ডা. মেরিলের মতে, ‘প্রথমবারের প্যানিক অ্যাটাক বিপজ্জনক নয়। এমনকি এরপরও মাঝেমধ্যে প্যানিক অ্যাটাক হলেও ভয়ের কিছু নেই।’ কিন্তু সমস্যাটা হয় তখন, যদি কেউ প্যানিক অ্যাটাক এড়াতে আচার-আচরণে বা জীবনযাপনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আনেন। এটা আগোরাফোবিয়াতে রূপ নিতে পারে। কোথাও বিপদ, জটিলতা বা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার আতঙ্কই হলো আগোরাফোবিয়া। এরকম দুশ্চিন্তা সহজে তাড়ানো যায় না। এর ফলে যিনি আগোরাফোবিয়ায় ভুগেন তিনি নিজেকে বাইরের জগত থেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন।উদাহরণস্বরূপ, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে যেতেও ভয় পান। একসময় তার অবস্থা এমন হতে পারে যে, ঘরে থাকাকেই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করেন। আগোরাফোবিয়া জীবনযাপনকে কঠিন করে তোলে। এমনটা হলে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে, বলেন ডা. মেরিল। ঘনঘন প্যানিক অ্যাটাক হলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
ঢাকা/ফিরোজ
আরো পড়ুন