পর্ব-১
ডিপিডিসি: গ্রাহক বাধ্য হচ্ছেন ৯ গুণ বেশি দামে মিটার কিনতে
![ডিপিডিসি: গ্রাহক বাধ্য হচ্ছেন ৯ গুণ বেশি দামে মিটার কিনতে ডিপিডিসি: গ্রাহক বাধ্য হচ্ছেন ৯ গুণ বেশি দামে মিটার কিনতে](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2024April/dpdc-risingbd-2405260209.jpg)
গ্রাফিক্স: রাইজিংবিডি
গ্রাহককে বিপদে ফেলে প্রায় ৯ গুণ বেশি দামে বিদ্যুতের মিটার কিনতে বাধ্য করছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশের দোহাই দিয়ে গ্রাহকসন্তুষ্টি বিবেচনায় না নিয়ে তাদের ‘পকেট কাটতে’ একতরফা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বললে, তারা এমন সব অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এক নির্দেশনায় জারি করা হয়েছিল, ৮০ কিলোওয়াটের লোডের উপরে হলে গ্রাহককে সাবস্টেশন করে উচ্চচাপ সংযোগ নিয়ে এইচটি মিটার স্থাপনের মাধ্যমে সংযোগ নিতে হবে। এই প্রজ্ঞাপন জারির পর বিদ্যুৎ বিতরণী ডিপিডিসি, ডেসকোর মতো কোম্পানিগুলোর প্রধানদের কাছে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করে, এত টাকা দিয়ে এইচটি মিটার কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পরে বিদ্যুৎ বিতরণী কোম্পানিগুলো পৃথকভাবে তখন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, গ্রাহকের আর্থিক সংকটের কথা বিবেচনা করে ২০০ কিলোওয়াট সাবস্টেশনে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত নতুন সংযোগে এলটিসিটি মিটার স্থাপন করতে পারবে। যেটি পরবর্তীতে ডিপিডিসি, ডেসকোর প্রধানদের বৈঠকে নোটশিট আকারে অনুমোদন করে সিদ্ধান্ত হয়।
পরবর্তীতে ডিপিডিসির ৩৬টি ডিভিশনের মধ্যে ৩৪টি এই নিয়ম অনুসরণ করলেও প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল ও নারিন্দা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এটি মানেননি। এদিকে, পুরনো উচ্চচাপ সংযোগের গ্রাহকরা, যাদের এইচটি মিটার কারিগরি ত্রুটির কারণে বার বার নষ্ট হচ্ছে; সেসব গ্রাহকদের আবারও বাধ্য করা হচ্ছে এইচটি মিটার কেনার জন্য। এই উচ্চচাপ সংযোগের গ্রাহকদের অভিযোগ, যেখানে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটার দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে, সেখানে উচ্চচাপ সংযোগ গ্রাহকরা এইচটি মিটার খারাপ হলে কেন এলটিসিটি মিটার লাগাতে পারবেন না? যে মিটারে (এলটিসিটি) খরচ মাত্র ৪০ হাজার টাকার মতো। অথচ এইচটি মিটারে খরচ সাড়ে ৩ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, পরিস্থিতি বুঝে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় গ্রাহকের ব্যয় কমানোর। এজন্য প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে ৮০ লোড থেকে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটারে সংযোগ দেওয়া যাবে বলে জানায়। এতে করে গ্রাহককে এলটিসিটি মিটার কিনতে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকার মতো খরচ হবে। তবে, বিষয়টি নিয়ে উল্টো পথে হাঁটেন ডিপিডিসির সদ্য যোগদানকারী নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম। এইচটি মিটার ও এলটিসিটি মিটার সংযোগে জটিলতা নিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রাহক ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে বিষয়টি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দৃষ্টিগোচর হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাৎক্ষণিক নির্বাহী পরিচালক অপারেশনকে বিষয়টি সমাধানে দ্রুত নির্দেশনা দেন। নির্দেশ পাওয়ার পর পরিচালক অপারেশন সম্প্রতি কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের বোর্ড রুমে ডিপিডিসির সব প্রধান প্রকৌশলী এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের নিয়ে বৈঠক করে তাদের মতামত নেন। ওই বৈঠকে একাধিক শীর্ষ প্রকৌশলী এইচটি ও এলটিসিটি মিটারের সংযোগের বৈষম্য বিষয় তুলে ধরেন।
পরে সিদ্ধান্ত হয়, নতুন উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগে ২০০ কিলোওয়াট সাবস্টেশনে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত এলটিসিটি মিটারে সংযোগ দেওয়া যাবে। কিন্তু পুরনো উচ্চচাপ সংযোগে যাদের এইচটি মিটারে ১৬০ কিলোওয়াট লোড পর্যন্ত রয়েছে, তাদের কারও এইচটি মিটার খারাপ হলে তাকে ওই মিটারই কিনতে হবে বলে পরিচালক অপারেশন সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। ঐ বৈঠকে একাধিক প্রকৌশলী এটার দ্বিমত পোষণ করলেও তা ধোপে টিকেনি। ডিপিডিসির পুরনো উচ্চচাপ গ্রাহক পর্যায়ে এইচটি মিটার কেনায় বাধ্য করায় গ্রাহকদের মাঝে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে মিটার খারাপ হলে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে এইচটি মিটার কেনা বার বার তাদের জন্য ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য (বিদ্যুৎ) আবুল খায়ের মো. আমিনুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কোনও ভোক্তা যদি তাদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আবেদন করেন, আমরা বিষয়টি দেখি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে সে সুযোগ আছে। যেটি সবার জন্য ভালো, সে ধরনের সিদ্ধান্ত আমরা দেব। কেউ যদি এইচটি মিটার চ্যালেঞ্জ করে আমাদের কাছে আসেন, আমরা ব্যবস্থা নেব। যদি কেউ না আসেন, বুঝে নেব গ্রাহকরা মেনে নিয়েছেন।’
গ্রাহকপর্যায়ে এবং ডিপিডিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এইচটি মিটার কিনতে গ্রাহকের খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। ১৬০ কিলোওয়াট লোডে নতুন গ্রাহকরা ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা খরচ করে সংযোগ নিতে পারছেন। আর পুরনো বিদ্যুৎগ্রাহকরা ১৬০ কিলোওয়াট লোডে এইচটি মিটার খারাপ হলে তাকে এইচটি মিটার কিনতে বাধ্য করানো হচ্ছে। উচ্চচাপ সংযোগে একই লোডে নতুন ও পুরাতন সংযোগকারীদের মিটার ক্রয়ে কেন এই বৈষম্য- সেই প্রশ্ন তুলছেন গ্রাহকরা। উচ্চচাপ সংযোগে পুরাতন বিদ্যুৎ গ্রাহকদের মিটার খারাপ হলে তাকে মিটার কিনতে হবে এইচটি, যার দাম আগের মিটারের তুলনায় ৯ গুণ বেশি।
ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এলটিসিটি মিটার ব্যবহারের জন্য একটি অফিসিয়ালি সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০২২ সালে। যেহেতু এইচটি মিটার নষ্ট হচ্ছে বেশি এবং অনেক টাকা খরচ পড়ে যাচ্ছে, সে কারণে ১৬০ কিলোওয়াট পর্যন্ত এলটিসিটি মিটার ব্যবহারের অনুমোদন দিচ্ছে। দু-একটা সার্কেল এটা আপত্তি করেছিল। আমরা এটা ঠিক করছি।’
এ বিষয়ে মিটারিং ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শাহেদ বিশ্বাস রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নিয়ম অনুযায়ী এলটিসিটি মিটারের পরিবর্তে এইচটি মিটার দেওয়ার বিধান আছে। এগুলো হচ্ছে উপরের লেবেলের বিষয়। তারা দিলে হবে, না দিলে নয়।’
পরের পর্ব পড়ুন: মিটারের ‘কমিশন বাণিজ্যে’ সর্বস্বান্ত গ্রাহক, নেপথ্যে কারা?
/এনএইচ/এসবি/
আরো পড়ুন