ঢাকা     বুধবার   ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ||  কার্তিক ৭ ১৪৩১

রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (শেষ পর্ব)

মো. জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২৮, ৯ নভেম্বর ২০২৩  
রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (শেষ পর্ব)

পড়ন্ত বিকেলে রক গার্ডেনে কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে

কিছুক্ষণ পর চোখের পাতা মাঠের দক্ষিণ কোণে ঘোরাতেই দেখতে পেলাম উষ্ণ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে এক যুবককে একাকী আকাশের নিচে গোমড়া মুখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ওর অন্তরাত্মার একেবারে গভীরে বিষাদে ছেয়ে আছে। কোনও মানুষের স্বপ্ন নীরবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেই সে  কেবল প্রকৃতির কাছে এসে এভাবে নীরবে নিজেকে সপে দেয়। আসলে এমন মানুষেরা অতীতের দুঃখের স্মৃতিকে চলমান সময়ে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ভাবনার ঘরে জীবন্ত রেখে বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এসব মানুষ যখন আত্মার বিশুদ্ধতা দিয়ে আর ভাবনার দিক পরিবর্তন করে নিজের সমস্ত অতীত থেকে নিজেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে, তখনই কেবল ভালো থাকতে পারে।  

পড়ুন: রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (প্রথম পর্ব)

পেছন থেকে হঠাৎ একজন ডেকে বলল, কেমন আছেন স্যার? টিমের এই ছেলেটি নিজের আনন্দকে ধুপের মতো পুড়িয়ে ছারখার করে অন্য সবার খাবার, হোটেলে আর পরিবহন ব্যবস্থাপনার প্রতিনিয়ত খোঁজখবর নিয়ে ভ্রমণে সুগন্ধি বিলিয়ে যাচ্ছে। ওর নাম শাওন, আমি ওর কাছে ডেকে জানতে চাইলাম— ভ্রমণের সব ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক হচ্ছে তো? সে মাথা নিচু করে বলল, ‘স্যার কোনও সমস্যা হচ্ছে না, সব ঠিকঠাক মতো চলছে’। তারপর শাওনের আরও কাছে গিয়ে একটু ইতস্ততভাবে বললাম, ‘শাওন আমাকে আপনার মোবাইল দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে দেন না’। হাসি মুখে মাথানিচু করে বলল, ‘ঠিক আছে’। ছেলেটির পরিপক্ব আচরণ দেখে মনে হয় তার যে প্রকৃত বয়স, তার চেয়ে সে বয়সে অনেক বড়ো। আসলে আমার মোবাইলটা কম দামের আর ক্যামেরা রেজুলেশন খুব নিম্নমানের হওয়ায় ভ্রমণকালে কোনও ছবি উঠানে সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য সুযোগ বুঝে সহকর্মীরা যখন গ্রুপ ছবি তুলেছে, আমিও তখন ওদের সাথে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। 

এদিকে, পশ্চিম দিকে সূর্য হেলে পড়ে তার হলুদ আভা ছেড়ে দিয়েছে। সূর্যের আলো মেঘের ওপর আঁচড়ে পড়ে শ্বেত মেঘগুলো রক্তিম আর হলুদাভ হয়ে এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া রক গার্ডেনের ভেতরে ও পাহাড়ের ঢালুতে থাকা গাছগুলোর পত্রপল্লব বৃষ্টির পর আরও সবুজ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। শেষ বিকেলে এমন স্বল্পস্থায়ী প্রকৃতির ঐশ্বর্য দেখে ভাবছি, পাহাড় চূড়ায় এরূপ মুহূর্ত হয়ত দ্রুতই আর ফিরে আসবে না। মনে মনে ভাবছি, রঙিন মেঘের উড়াউড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর চোখের ক্যামেরায় দৃশ্যাবলী ধারণ না হওয়া পর্যন্ত সূর্য যেন অস্ত না যায়। রাত্রি যেন পৃথিবীতে নেমে না আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য দিনের শেষ আভা বিকিরণ করে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আর অল্প সময়ের মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুবে গিয়ে চারদিকে অন্ধকারের প্রাচীর টেনে দিল। সন্ধ্যায় আঁধার চতুর্দিকে ছেয়ে যাওয়ার পর, আমরা স্টোন গার্ডেন হতে উঠে ধীরে ধীরে রাস্তার দিকে চলে আসলাম।

পূর্ণ চাঁদ থাকলেও সন্ধ্যায় সাঁঝ করার কারণে মেঘে ঢেকে আছে চাঁদ, তাই চাঁদ আলো বিলাতে পারছে না পাহাড়ের দিগন্তের সীমায়। যার কারণে হেলিপ্যাডে সন্ধ্যার পর আমাদের পূর্ব নির্ধারিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করা হলো। এবার নতুন সঙ্গী সহকর্মী লাহিদুল আর রানা ভাইকে নিয়ে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে পথ চলছি সামনের দিকে। যখন ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে পাহাড় আর লেকের সকল সৌন্দর্য। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি হেলিপোর্টের পাশেই খোলা আকাশের নিচে অবস্থিত ফুটকোর্টের সামনে। এখানে অনেক দোকান আর দারুণ সব খাবারের সমারোহ চলছে— রসপুরী, চিকেন ম—ম, চিকেন অনথন, পাহাড়ি জুম চালের জিলাপি, বাঁশের চপ, ফ্রাইড ফিসসহ নাম না জানা নানা বাহারি খাবার। রানা ভাইয়ের আতিথেয়তায় খাওয়া হলো বাঁশের চপ, চিকেন ম—ম আর বাঁশের কাপে চা। 


 
রক গার্ডেনের পাথরে বসে সহকর্মী রানা ও তুষার কান্তির সঙ্গে

হেলিপ্যাডের পাশেই বিভিন্ন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর হাতে তৈরি পণ্য ও পোশাকের দোকান আছে। দোকান থেকে সংগ্রহ করা যায় পছন্দের হাতের চুড়ি, গয়না, বাঁশের তৈরি মগ, পানির পট, বাঁশের কলমসহ নানা পাহাড়ি সামগ্রী। আকাশের জমাটবদ্ধ মেঘগুলো হঠাৎই আমাদের ওপর যখন বৃষ্টির দানা হয়ে পড়ছে তখন আমরা দৌড়ে গিয়ে মুশফিকদের মেঘ আভা কটেজে গিয়ে দাঁড়ালাম। যখন রাস্তা থেকে সিঁড়ি মাড়িয়ে নিচের দিকে নামছি, তখন বিচ্ছু বাহিনীর একজনের সঙ্গে দেখা হতেই বলল— স্যার, আমাদের রুমে চলেন। ব্যালকনিতে জুনিয়র সব পোলাপান আড্ডায় মেতে উঠেছে। আমি প্রথমে ইতস্তত করে যেতে অস্বীকৃতি জানালেও এমনভাবে আবদার করলো আমি আর না করতে পারলাম না। ভেতরে গিয়ে দেখি শারমীন, রুনা, সবাই গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে ব্যালকনিতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ বেড়ে গিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। আমাকে খাটের ওপর বসতে বললো আর ওরা সবাই ফ্লোরে আমার চারপাশে বসে পড়ল। হঠাৎ করেই ওরা আবদার করে বসলে, আমার স্বরচিত কবিতা নিজে আবৃত্তি করে শোনাতে হবে। আমি আপত্তি জানিয়ে অনুরোধের সুরে বললাম, টুকটাক লিখলেও কবিতা কখনও আবৃত্তি করা হয়নি বা পাঠও। ওরা নাছোড়বান্দা, কোনভাবেই ছাড়বে না। সবাই একযোগে ধ্বনি দিচ্ছে আবৃতি হবে করতে হবে। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে— আমি যেন অনেকগুলো বিচ্ছুর মাঝে আটকে পড়া অসহায় এক ঘাসফড়িঙ! হঠাৎ করে আমার মনে হলো— জড়তায় আবিষ্ট হয়ে কবিতা আবৃত্তি/পাঠ না করার কারণে কয়েকবার এক সহকর্মীর কাছে নাজেহাল হয়েছি! ভাবছি, আর নয়! আজ এই মুহূর্তে অনুভূতিতে জমে থাকা ছোট-বড় সব জড়তা মাড়িয়ে শুরু হলো স্বরচিত কবিতা পাঠ। দুটো কবিতা পাঠ করার পর বিদ্যুৎ চলে গেল আর রাতের ডিনারের সময় হয়ে গেলে আমি বিদায় নিলাম। এক ফ্লোর নিচে অন্য সহকর্মীদের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত তুমুল তুফান বেগে আড্ডা হলো। রাত বারোটার পর আমি নিজের রুমে ফিরে গেলাম। 


 
ভোরের আভায় রিসোর্টে একান্ত মনে লেখক উপভোগ করছেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য

ভ্রমণের শেষ দিন, সকাল নয়টায় ফিরতি পথের যাত্রী হয়ে ঢাকায় উদ্দেশ্য রওনা হবো। আগেই স্থির করে রেখেছি, শেষ দিন সকালে আর বাহিরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে নিজের ক্লান্তি বাড়াব না। সহকর্মীরা সবাই ভোরের আভা মুছে যাওয়ার আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেছে প্রকৃতির শীতল বাতাসের পরশ পেতে। আমি ব্যালকনির খুব কাছে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের ওপর দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছি। রিসোর্টের নিচের ফ্লোরে তাকাতেই চোখে পড়ল এক জোড়া তরুণ-তরুণী  প্রেমের নির্জনতার গভীরে ডুব দিয়ে অন্য রকম এক অনুভূতিতে শরীর উষ্ণ করে চিত্তের সুখ বাড়িয়ে নিচ্ছে। ওদের কর্মকাণ্ডে লজ্জায় জড়সড় হয়ে প্রথমে বিস্তীর্ণ পাহাড় উপত্যকায় তারপর ঊর্ধ্বলোকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেঘের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, একসাথে কখনো নারী আর প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্যে ডুব দেওয়া যায় না! অনেক কিশোর—যুবক যৌবনে মনে করে কোনও সুন্দরী রমণীকে প্রেমসঙ্গী হিসেবে পেলে জীবনে সুখের অভাব থাকবে না। এসব অপরিপক্ব ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য জীবনের অসময়ে প্রেমের ফাঁদে পড়ে আটকে ফেলে নিজের মন। তারপর, অনেকে ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে স্মৃতিচারণে আটকে গিয়ে জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। আবার অনেকে যৌবনে এলোমেলো ভাবনায় ডুবে জীবনের সুখ বলতে নারী—পুরুষ একে অপরের রূপ সৌন্দর্যে ডুবে কামনাকে বোঝে। বিশেষ করে বাঙালি পুরুষদের মস্তিষ্কের বড় একটা অংশ জুড়েই নারীকেন্দ্রীক চিন্তা-চেতনা খেলা করে। বলছি না, নারী বিবর্জিত উদাস জীবনের ঢেউয়ে পুরুষ নিজেকে ভাসিয়ে দেবে আর কখনও নারীতে ডুব দিয়ে ভালোবাসা খুঁজবে না। তবে এটা সত্য, কেউ প্রেমকেন্দ্রীক জাগতিক এলোমেলো ব্যাপার—স্যাপার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসতে হবে এবং প্রকৃতিকে বোঝার ভাষা শিখতে হবে। প্রকৃতির মতো শক্তিশালী আর কিছুই নেই। প্রকৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাঠাগার।

পড়ুন: রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (দ্বিতীয় পর্ব) 
 
বেশিরভাগ মানুষ সাদা চোখে দেখে বলে প্রকৃতির মাঝে কিছুই খুঁজে পায় না। অথচ গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে কেউ যদি প্রকৃতির মাঝে ডুবে যেতে পারে, তার ভাবনার জগৎ উলট-পালট হয়ে খুলে যেতে পারে জ্ঞানের অসীম দোয়ার। মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে নিজের নিঃসঙ্গতার চাদরে মোড়ানো রুক্ষ্ম হৃদয়কে করে নিতে পারে প্রকৃতির মতোই সজীব। কেউ যদি প্রকৃতির ভাষা পড়তে পারে তাহলে সে বই না পড়েও স্বশিক্ষিত হয়ে বড় সার্টিফিকেটধারীর চেয়েও হয়ে উঠতে পারে সত্যিকার জ্ঞানী।  

লুসাই পাড়ায় উপজাতিদের পোশাকে সজ্জিত ওরা কয়েকজন

সময় হয়েছে সাজেক ভ্যালির বাক ছেড়ে নিজের চিরচেনা কর্মব্যস্ত শহরে ফিরে যাওয়ার। সকাল ১০টা, আমরা চান্দের গাড়িতে বসে সেনাবাহিনীর সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি। ফিরতি পথে অনুভব হচ্ছে পাহাড়ের তাঁতানো তাপপ্রবাহ, অনেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি প্রত্যাশা করছে আর গরমে হাঁসফাঁস করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাজেকের প্রকৃতির কূল থেকে মুছে যাবে আমাদের অস্তিত্ব। ফিরতি পথের যাত্রী হয়ে ফিরে যাব পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নগর আর ধীরগতির অরক্ষিত যান্ত্রিক শহরে। সাজেকের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো ভ্রমণ শেষে দৃশ্যপট নিমজ্জিত হয়ে থাকবে স্মৃতির পাতায়। যা পরবর্তীতে ভ্রমণের প্রতীক হিসেবে অবসরে স্মৃতিগুলো জেগে উঠবে মস্তিষ্কের শিরা—উপশিরায়। ধীরে ধীরে চান্দের গাড়ি সাজেকের চূড়া হতে নিচের দিকে নামতে থাকল। 

পড়ুন: রাঙ্গামাটির দূর পাহাড় সাজেকের বাঁকে (তৃতীয় পর্ব)

যাদের সক্ষমতা বা সামর্থ্য আছে, তাদের উচিত ভ্রমণ করে মনের ভেতরে যে সুপ্ত মন থাকে তাকে জাগ্রত করে তোলা। এটা সত্যি কথা, গরিবের মরণফাঁদ হচ্ছে অভাব। তারা মন থেকে প্রত্যাশা করলেও দেশের বা দেশের বাইরের দর্শনীয় স্থান টাকার অভাবে ভ্রমণ করতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা একই সময়ে একইসঙ্গে সব কিছু একজন মানুষকে দান করেন না। অনেকের অনেক অর্থ-বৈভব থাকার পরও চাইলেই এমন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন না। ওরা কেউ কেউ সম্পূর্ণ অমূলক এমন ধারণা মনে ধারণ করেন যে, জীবন মানেই সুখের জন্য টাকার পাহাড় গড়ে তোলা। তাদের জীবন মিথ্যা আস্ফালনে আর বাগাড়ম্বরে মধ্যে থেকেই কেটে যায়। আসলে ওরা টাকার নেশায় বুদ হয়ে চার দেয়ালের মধ্যে জ্যান্ত সমাধিস্থ করে রাখে নিজেকে।

ঢাকা/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়