ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

৩ মিনিটের আক্রমণে ২০ পাকিস্তানি সেনা হত্যা করি : আব্দুল মজিদ

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ৩ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৮:৩৪, ১১ মার্চ ২০২১
৩ মিনিটের আক্রমণে ২০ পাকিস্তানি সেনা হত্যা করি : আব্দুল মজিদ

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ শেখ। বগুড়ায় একের পর এক সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বহু পাক সেনা হত্যা বা বন্দি করেছেন। বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো কেমন ছিল এবং মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে শক্তিশালী পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন- তা জানতে রাইজিংবিডির বগুড়া সংবাদদাতা এনাম আহমেদ সম্প্রতি কথা বলেন আব্দুল মজিদ শেখের সঙ্গে। আলাপচারিতায় যুদ্ধদিনের বহু কথা জানিয়েছেন তিনি। পাঠকের জন্য সেগুলো তুলে ধরা হলো। 

আব্দুল মজিদ শেখ বলেন, ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে যে পরিকল্পিত গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করেন, সেই খবর আমরা রাতেই জানতে পারি। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে অল্প সময়ের মধ্যে ট্যাংকসহ সাজোয়া বাহিনী বগুড়ায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে- এ খবর আমাদের জানান তৎকালীন বগুড়ার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি জিপ নিয়ে বের হয়ে বগুড়াশহরের পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে চিৎকার করে বলেন- রাতের মধ্যে বগুড়ার সমস্ত মানুষকে হত্যা করবে পাক সেনারা। আপনারা প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। পুলিশ আপনাদের সঙ্গে থাকবে। সেই রাতেই বগুড়ার জনগণ যে যেভাবে পারে, শত্রুদের ঠেকাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকসেনারা যেন রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে এগোতে না পারে, সেজন্য রংপুর রোডে গাছের গুড়ি, কাঠ, ইট ফেলে ব্লক করা হয়। উত্তর বগুড়া থেকে যেন দক্ষিণ বগুড়ার দিকে পাকসেনারা যেতে না পারে সেজন্য রেললাইনে বগি দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ ভোরের দিকে পাক সেনাবাহিনী বগুড়ায় প্রবেশ করে। বগুড়ার লোকজন তাদের প্রতিরোধ করতে থাকে। আর পাক সেনা নির্বিচারে গুলি চালায়। মাটিডালিতে রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার সময় এক রিকশাচালককে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে তারা। বগুড়ায় তিনিই প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তার নাম তোতা মিয়া। ঠেঙ্গামারায় তার বাড়ি। এরপর সেদিনের যুদ্ধে শহীদ হন হিটলু, ছোনু, আজাদ, টিটু, দোলন। মন্ত্রী ফজলুল বারীও পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন। সেদিন পাক সেনাদের গুলিতে প্রাণ যায় আরও ২৫-৩০ জন হোটেল ও দোকানের কর্মচারীর। পাক বাহিনী বড়গোলা থেকে রেলঘুমটি পর্যন্ত আসতে পেরেছিল। পরে বগুড়াবাসীর প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে তারা আশ্রয় নেয় মজিবুর রহমান মহিলা কলেজ এবং কটন মিল রেস্ট হাউজে। ২৬ মার্চের পরে বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যার কাছে যা ছিল, সেটা নিয়ে যুদ্ধ করেছে। 

আব্দুল মজিদ শেখ বলেন, যখন আমি যুদ্ধে যাই, তখন আমার বয়স ১৯ বছর। আমি তখন বগুড়ার শাহ সুলতান কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সময়টা ১৯৭১ সালের মে মাস। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর অত্যাচার আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার পালা। প্রথমে আমি এবং আমার খালাতো ভাই হেলাল বগুড়া থেকে সারিয়াকান্দি উপজেলার হাটশেরপুর যাই। এরপর সেখান থেকে নৌকাযোগে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে পৌঁছাই। পরে ট্রেন এবং বাসে ভারতের বালুগঞ্জের ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে আমরা আটদিনের মতো ছিলাম। এরপর ইয়ুথ ক্যাম্পের কর্তাব্যক্তিরা আমাদের শিলিগুড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে পানিঘাটা নামে একটা জায়গা ছিলো। মূলত সেটাই মূলপ্রশিক্ষণ ক্যাম্প। আমরা তাঁবুতে থাকতাম। একদিন অবসর দেওয়ার পর প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একজন ইন্ডিয়ান মেজর প্রশিক্ষণ দেন। তার নাম এখন মনে করতে পারছি না। সব মিলিয়ে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণকালীন আমরা ভালো খাবার পাইনি। তবে প্রশিক্ষণ শেষে যেদিন আমরা বিদায় নেবো, সেদিন ভালো খাওয়ানো হয়।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, শিলিগুড়ি থেকে ট্রাকে করে প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ আমাদের রাজশাহীর কালুপুর বর্ডারে পৌঁছে দেন তারা। আমাদের ব্যাচে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম; আর ২ জন মেডিকেল অফিসার। যাদের বাড়ি রাজশাহীতে। তারা আমাদের প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিতেন জরুরি মুহূর্তে। আমরা ভারি অস্ত্র কাঁধে নিয়ে নদী ডিঙিয়ে হেঁটে চলেছি। আমাদের সঙ্গে একজন গাইড ছিলেন। আমরা সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত হাঁটতাম বগুড়ায় আসার জন্য। আর দিনে বিশ্রাম করতাম। রাজশাহীর কালুপুর বর্ডার থেকে পায়ে হেঁটে বগুড়ায় পৌঁছাতে তিন রাত লেগে যায়। 

আব্দুল মজিদ শেখ আরও বলেন, বগুড়ায় ফিরে মাত্র একদিন বিশ্রাম করি। তখন জুলাই মাস। শিলিগুড়ি থেকে ফেরার আগে আমাদের প্রথম টার্গেট জানিয়ে দেওয়া হয়। জানানো হয়, বগুড়ার শিবগঞ্জ ব্রিজের কাছে পাক হানাদারদের ক্যাম্প আছে। সেখানে একজন রাজাকারসহ ২১ জন পাক সেনা থাকে। আমাদের প্রথম অপারেশন সেই ক্যাম্পের বিরুদ্ধে। সাহস সঞ্চার করে আমরা এগোতে থাকলাম। অভিযানের কৌশল হিসেবে ৩টা গ্রুপে ভাগ হই। এরপর পজিশনে প্রস্তুত হলাম শত্রুদের দিকে গুলি করার জন্য। সিগন্যাল পাওয়ার পর একাধারে গুলিবর্ষণ শুরু করলাম। শত্রুপক্ষও গুলি ছুড়লো। প্রচন্ড গুলির শব্দ হচ্ছিলো। রাতের বেলা শুধু আগুন দেখা যাচ্ছিল। আমাদের আক্রমণ ছিলো মাত্র তিন মিনিটের। এরপর সেখানে দেরি করিনি। চলে আসি। পরের দিন খবর পেয়েছি, ২১ জনের মধ্যে এক রাজাকার ছাড়া সবাই মারা গেছে। যে রাজাকার বেঁচে ছিলেন, তার পায়ে গুলি লাগে। পরে তার একটা পা কেটে ফেলতে হয়। 

তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে যেভাবে পেরেছে, যুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছে। কেউ খাবার দিয়ে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, কেউ তথ্য জোগাড় করে; যেটা খুব দরকার ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়পুরহাট এবং বগুড়া জেলাকে ৭ নম্বর সেক্টর ঘোষণা করা হয়। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নূরুজ্জামান।

আব্দুল মজিদ শেখ আরও বলেন, পরের অপারেশন ছিলো কাহালু উপজেলায়। তখন জুলাই মাস। কাহালুতে রাস্তার ওপরে যে রেললাইন ব্রিজ ছিল, সেটা পাহারা দিচ্ছিলেন রাজাকাররা। সেখানে কোনো সেনা নেই। শুধু রাজাকার। এই অপারেশন সফল করার জন্য আমরা রাজাকারের কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তার নাম আব্দুস সামাদ। আমরা তাকে বললাম- আমরা যে অপারেশন করবো তাতে সবাই মারা যাবে। কাজেই অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করুন। তখন আব্দুস সামাদ বললেন- তারা না হয় আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু পাক সেনারা তো ঠিকানা জানে। পরে পাক সেনারা রাজাকারের পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করবে। তাহলে কী করা যায়? তখন আমরা কৌশল করলাম- অভিযানের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা গুলি চালাবে। রাজাকারও ফাঁকা গুলি করবে। তাহলে পাক সেনারা বুঝবে প্রতিহত করেও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে রাজাকাররা ধরা পড়েছেন। কথামতো তাই করা হলো।  এরফলে ৫০ জন রাজাকার ধরা পড়ে। রাজাকারদের কমান্ডারকে শুধু হত্যা করা হয়। বাকিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেকের কান কেটে দেওয়া হয়। এতে তারা যে রাজাকার এটা চিহ্নিত করে দিয়েছি মাত্র। কান কাটার পর যে যার মতো দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। এছাড়াও কাহালুতে যেসব বড় ব্রিজ ছিলো, সেখানে সেনারা পাহারায় ছিলেন; সেখানে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়।

এই মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, এরপর তৃতীয় অপারেশন ছিলো বগুড়া সদর উপজেলার ছোট কুমিড়ায়। তখন মহাসড়ক কাঁচা ছিলো। মাত্র মাটি উঠানো হয় পাকা করার জন্য। এই অপারেশনটা দিনের বেলায় করা হয়। আমরা পশ্চিমপাশে আর পাক সেনারা পূর্বপাশে। সামনাসামনি যুদ্ধ চলছিল। আমাদের দলের দুইজনের মাথায় গুলি লেগে শহীদ হয়। তাদের একজনের নাম বাবলু, অপরজন লাল মিয়া। বাড়ি বগুড়ায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাক সেনারা পরাজিত হয়। এরপর লাল ও বাবলুর মরদেহ পাশের জঙ্গলে পুঁতে ফেলা হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ শেখ বলেন, এরপর একটা ঘটনা ঘটে গাবতলী উপজেলার রামেশ্বরপুরে। সময়টা ডিসেম্বরের ২ বা ৩ তারিখ। আমাদের অস্ত্র আছে কিন্তু গুলি ফুরিয়ে গেছে। তখন গ্রুপ কমান্ডার এ টি এম জাকারিয়া তালুকদার আমাকে ভারতে পাঠিয়ে দেন গুলি সংগ্রহের জন্য। ভারত থেকে গুলি নিয়ে রামেশ্বরপুরে ফিরে আসি। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য গ্রুপে যোগ দেয়। তাদের কাছে খবর ছিলো একটি ধানের খেতে ১৪ জন পাক সেনা লুকিয়ে আছে। তখন জমিতে পাকা ধানগাছ ছিলো। আমরা সেই জমি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। পরে তারা আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধে একজন পাক সেনা আহত হয়। তিনি উঠতে পারছিলেন না। তাকে সেখানে মেরে ফেলা হয়। আটক করা হয় ১৩ জনকে। তাদের পকেটে শুধু ধান ছিলো। তারা বগুড়া থেকে পালিয়ে এসে রামেশ্বরপুরে লুকিয়ে ছিলেন। তারা শুধু ধান খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারা আত্মসমর্পণের পর জানান- তিনদিন না খেয়ে আছেন। এরপর তাদের গাবতলী সদরে নিয়ে গেলাম। সেখানে একটি বাড়িতে চিনি চম্পা কলা আর খৈ খেতে দিলাম। খাবার শেষ হলে তাদের গাবতলী থানায় হস্তান্তর করি। এরপর খোঁজ নিইনি তাদের সঙ্গে কী হয়েছে। এটা ছিলো ১৫ ডিসেম্বরের ঘটনা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ শেখ বলেন, পরদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ২ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা বগুড়ায় আত্মসমর্পণ করে। স্থানটা ছিলো বগুড়ার সাতমাথা থেকে বড়গোলা। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হলো বিসিকে। বাঘোপাড়া রোডের ওপর মঞ্চ করা হয় সেদিন। সেখানে তৎকালীন বগুড়ার ডিসির কাছে অস্ত্রসহ পাক সেনাদের হস্তান্তর করি আমরা মুক্তিযোদ্ধারা।

ঢাকা/বকুল

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়