ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বুলাওয়ে থেকে হারারে : প্রকৃতির নিখাদ আঁধার

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ১৬ মে ২০১৩   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
বুলাওয়ে থেকে হারারে : প্রকৃতির নিখাদ আঁধার

উদয় হাকিম, জিম্বাবুয়ে থেকে
বুলাওয়ে শহরটা খুব সুন্দর। আসলে জিম্বাবুয়ের ছোটবড় সব শহরই সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। সবকিছুই প্রকৃতির আপন হাতে সাজানো। প্রকৃতি এখানে যেন উজাড় করে দিয়েছে সব।

এত সৌন্দর্যের আরেকটা রহস্য আছে। সবই বলা চলে বৃটিশদের অবদান। তারা কম বেশি যা কিছু করেছে সবই পরিকল্পিতভাবে। সেঞ্চুরি পার্ক, লাইব্রেরী, শপিং সেন্টার সবই পরিকল্পিত এবং পরিচ্ছন্ন।    

যা’হোক পরদিন যথাসময়ে মাঠে উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় টি- টোয়েন্টি ম্যাচ দেখতে। বিদেশের মাঠে নিজের কোম্পানির (ওয়ালটন) পেরিমিটার বোর্ড  দেখে বুকের ভেতরে গর্ব কাজ করে।

এদিন অবশ্য ভালোই খেললো বাংলাদেশ। বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা পুরো ম্যাচে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি জিম্বাবুয়েকে। ৩৪ রানের জয়। আর তাই প্রেজেন্টেশান সিরিমনিতে গেলাম ফুরফুরে মেজাজে।

ভালো লাগাটা পুরোপুরি পাখা মেলতে পারল না। আমাদের সঙ্গে আসা ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছোট-খাটো হার্ট এ্যাটাক। তার জন্য আমরা সবাই উৎকন্ঠায় ছিলাম। ১৫ মে সকালে শুনলাম তিনি সুস্থ। হাসপাতাল ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি অবশ্য তখন বুলাওয়ে থেকে হারারে চলে এসেছি। দ্বিতীয় দিনের খেলাশেষে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। উনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন।

বুলাওয়ের বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট ক্যাটেলম্যান। এখানকার গরুর মাংস নাকি বিশ্বখ্যাত। অন্যান্য স্টেকসও বেশ ভালো। সেখানে খেতে গিয়েই সচিব মহোদয় অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো।  

১৩মে সকালে হারারের বাসে উঠলাম। বাসের নাম পাথ ফাইন্ডার। মঙ্গলে যাওয়ার বাহন! চমৎকার দোতলা এসি বাস। আরামদায়ক সিট। বাসে এতো কমফোর্টেবল সিট ভাবাই যায়-না। ভেতরে বিমানের মতো টয়লেট আছে। দোতলায় বসলে আফ্রিকার ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের মহাসুযোগ। আমি অবশ্য নীচেই বসেছি। সঙ্গে আছেন মইনুলের বন্ধু সোহান। কিছুক্ষণ পরপর খাবার দাবার দিচ্ছে, পানি দিচ্ছে, ফল ফলাদি দিচ্ছে। সোহান জানালেন, উপরের সিটগুলোর তুলনায় নিচের সিটগুলো বেশি আরামদায়ক। এরকম বাস আমাদের দেশে ভালো যাত্রী পাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- এসব গাড়ি চলার মতো রাস্তা নেই।   

আমরা এসেছি শীতের শুরুতে। তারপরও শীতে শরীর জমে যায়। স্থানীয়দের কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না। অবশ্য দিনের বেলা রোদের প্রচন্ড তেজ। কিন্তু বাতাস শুষ্ক, ঠান্ডা। নাকে রক্ত জমে যায়। প্রথম দিন ভয় পেয়েছিলাম। পরে বুঝলাম আবহাওয়ার কারণে এটা হচ্ছে। আবার গরমে এক ধরনের র‌্যাশ দেখা দিচ্ছে হাতে পায়ে। প্রচুর লোশন মেখেও পার পাচ্ছি না।

বুলাওয়ে থেকে হারারে আসতে মাঝপথে পড়ে জিম্বাবুয়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর কোইকে। মহাসড়কের ধারেই পড়লো ইডেন সুপার মার্কেট। মনে হলো এটি শহরের সবচেয়ে বড় মার্কেটগুলোর একটি। কিন্তু মার্কেটে ক্রেতা নেই।

জিম্বাবুইয়ানরা কেনাকাটা করে দুপুরের দিকে। বিকেলে সবাই বাড়ি ফেরা নিয়ে ব্যস্ত। আর পুরো সপ্তাহের কেনাকাটার জন্য তারা অপেক্ষা করে উইকেন্ডের। ঘোরাফেরাও  ওইসময়। সন্ধ্যা নামতেই প্রায় সবাই ঘরে চলে যায়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় ৫ টার সময়ই। ছ’টায় বেরুলে মোটামুটি কোন দোকানই খোলা পাওয়া যায় না, কেবল দু’একটা খাবারের দোকান ছাড়া।

জিম্বাবুয়ের লোক সংখ্যা দেড় কোটি। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ। এতোবড় দেশে অল্প মানুষ। এমনিতেই রাস্তায় লোকজন কম থাকে। প্রায় পুরো দেশটাই একটা বড় বনাঞ্চল। এজন্য সূর্য ডোবার আগেই ঘরে ফেরার অভ্যাস তাদের। তা হোক শহর কিম্বা গ্রাম।

বুলাওয়ে থেকে হারারে আসার পথে দু’পাশে অনেক গ্রাম দেখেছি। গ্রাম বলতে ৫/৬ টি বাড়ি। খুব বড় গ্রাম হলে ১০/১২ টি। তবুও একেকটা নূন্যতম ২/৩ কিলোমিটার  পর পর। আর বাড়ির বর্নণা করা দুষ্কর। ওরকম বাড়ি ভারতীয় উপমহাদেশে নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ বাড়িই একটি মাত্র ঘর নিয়ে। ঘরের ছাউনি ঘাসের। আমরা যাকে বলি শণের ছাউনি। দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৮ ফিট, ৬ ফিট। গোলাকার। মাটির বেড়া। বেড়া থেকে এক ফুট দূরত্বে কাঠের বেড়ি। আধহাত কিম্বা একহাত পর পর একেকটা কাঠের খুঁটি দিয়ে বেড়ি তৈরি। জিম্বাবুইয়ানরা অনেক লম্বা চওড়া। তারা এসব ঘরে দাঁড়ায় কীভাবে, থাকে কীভাবে-ভাবতে গেলে উত্তর মেলা ভার।

রাস্তার ধারে কিছু কৃষি খামার আছে। বিশাল জায়গা নিয়ে একেকটা খামার। তাতে সবজি, তরমুজ, ভুট্টা, তাকাম ইত্যাদি চাষ করা হচ্ছে। হারারের কাছে একটি গ্রিণ হাউজ খামারও দেখলাম। দু’একটা ঘৃতকাঞ্চন দেখলাম। দেখছি মোরগ ফুলের মতো ডাটা গাছ। অনুমান করলাম, এসব খামারে প্রচুর সেচ দিতে হয়। খামারগুলোর পেছনেই উঁচু পাহাড়। এই পাহাড়- হারারে থেকে ভিক্টোরিয়া সিটি- প্রায় এক হাজার কিলোমিটার লম্বা।

জিম্বাবুয়ে যাওয়ার আগে বাসায় ওইদেশের উপর একটা ভ্রমণ কাহিনীর প্রচ্ছদ দেখেছিলাম। বইমেলা থেকে কিনেছিলো আমার স্ত্রী। জিম্বাবুয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওই রাস্তাটা খুঁজছিলাম। ভিক্টোরিয়া সিটি থেকে বুলাওয়ে আসার পথে ওইরকম জায়গা দেখেছি। বড় বড় পাথরের পাশ দিয়ে সড়ক। সড়কের উপর কিছু ছাগল এবং জিম্বাবুইয়ান শিশু। আমি অবশ্য ছাগলের ঘাস খাওয়া এবং দু’একজন পাহাড়ী শিশু দেখেছি। দেখেছি গাধায় টানা গাড়ি। বিশেষ করে- বাস স্টেশনগুলোতে এ ধরনের স্থানীয় গাড়ি দেখেছি। অনেক দূরের লোকজন সম্ভবত: ওই গাড়িতে চড়েই স্টেশনে আসে।  

হারারে শহরে প্রবেশের কিলো দশেক আগে দেখলাম পাথরের পাহাড়। বড় বড় পাথর পড়ে আছে রাস্তা থেকে একটু দূরে। মহাসড়ক থেকে কিলো খানেক দূরে আকাশ ছোঁয়া পাথরের পাহাড়। একটা পাথরের ওপর আরেকটা পাথর এমনভাবে বসে আছে; মনে হয়, যেকোন সময় পড়ে যেতে পারে। কিন্তু পড়ে না। এমনকি নড়েও না। আর সেই সৌন্দর্য্য দেখতে হা করে তাকিয়ে থাকেন পর্যটকরা।

লুসাকা থেকে বিমানে হারারে যাওয়ার সময়ও ওই পাথরের সৌন্দর্য দেখেছিলাম। পরে শুনেছি, পাথরের একটি পার্কও আছে এখানে। সময় স্বল্পতায় যাওয়া হয়নি। কিন্তু গেলে ভালো লাগবে যে কারোরই, হলফ করে বলা যায়। বলে রাখা ভালো, জিম্বাবুয়েতে অসংখ্য পাথরের খনি আছে। এখন যেটার কথা বলছি- এটি তারই একটি। হারারে শহরের উত্তর পশ্চিমে এর অবস্থান।  

এর আগেও লিখেছি পথে ছোটছোট খালের মতো পড়ছে। প্রায় সবই শুকনো। তবে বুলাওয়ে- হারারে সড়কে দু’একটা বড় নদীও দেখছি। যেখানে পানি আছে। যদিও এসবের কোনটিই আমাদের দেশের নদীগুলোর মতো অতো বড় নয়। শুকনো খাল এবং কালভার্টই বেশি।

বাসস্ট্যান্ডগুলো আগে যেমনটি বলেছিলাম তেমনই। বলার মতো ছাউনি নেই, যাত্রীও নেই। বেশির ভাগ স্টেশনেই গাছের নিচে লোকজন অপেক্ষা করে। বনের ভেতর যে দুএকজন মানুষ বাস করে তারাই কদাচ দূরে কোথাও গেলে স্টেশনে আসে। বাস কিম্বা যাত্রী টানা লম্বা মাইক্রোবাসের জন্য অপেক্ষা করে ঘন্টার পর ঘন্টা।

জিম্বাবুয়েতে যত রাস্তা দেখেছি সবগুলোই অদ্ভূত সুন্দর। মনে হয়েছে সবগুলোই প্রকৃতি গড়ে দিয়েছে। এখানে মানুষের কোন হাত পড়েনি। প্রকৃতিকে তার মতো রেখেই তার সৌন্দর্য বর্ধনের চেষ্টা হয়েছে মাত্র। এত গাছ, এত প্রাণবৈচিত্র থাকার পরও জিম্বাবুয়ে পরিবেশের ব্যাপারে ভীষণ সচেতন। বিভিন্ন জায়গায় জনগণকে পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে।

ভাবছি-ওদের মতো আমরাও যদি পরিবেশ সচেতন হতাম! আমরাতো প্রতিনিয়ত নিজ হাতে পরিবেশকে নষ্ট করছি।

তবে ভিক সিটি থেকে বুলাওয়ে কিম্বা বুলাওয়ে থেকে হারারে এর একটি রাস্তায় ভ্রমণ করলে যে কেউই সহজে বুঝতে পারবেন জিম্বাবুয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কত অফুরান। আর ওই যে গ্রাম এবং জঙ্গলের পাশের ঘরের কথা বললাম- সেখানেই থাকে প্রকৃতির সন্তানেরা। যারা কৃত্রিমতা পছন্দ করেন না, থাকতে চান প্রকৃতির কোলে তাদের জন্য লোভনীয় জায়গা জিম্বাবুয়ের এই গ্রামগুলো। যেমনটি ভুলিয়েছিলো রবি ঠাকুরকেও (গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ..)।

যান্ত্রিকতা, কৃত্রিমতা এবং শঠতামুক্ত জীবন চাইলে জিম্বাবুয়ের এই গ্রাম হতে পারে প্রার্থীত ভূ-স্বর্গ। এই গ্রাম, এই মাটিইতো প্রকৃতির নিখাদ আধাঁর!

 

রাইজিংবিডি/ ১৬ মে, ২০১৩

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়