ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

পলি মাটি বিক্রির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে পর্যবেক্ষণ জরুরি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পলি মাটি বিক্রির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে পর্যবেক্ষণ জরুরি

পলি মাটি জমে ক্রমেই কমছে নদীর প্রশস্ততা। ছবি: সংগৃহীত

হাসান মাহামুদ : দেশে বন্যা হওয়া, নদীর পানি কমে যাওয়া কিংবা অসংখ্য খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করে বলেন নদীর তলদেশে জমা পলি মাটির কথা। কিন্তু এই পলির সুষ্ঠু এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার শুধু দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ নয়, দেশের আয়তনও বাড়াতে পারে। এমনকি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতির পরিমাণও কমানো সম্ভব। কিন্তু আমরা দেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ এই পলি বিক্রি করে দিচ্ছি। এরই মধ্যে মালদ্বীপের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রের পলি বিক্রি সংক্রান্ত চুক্তিও হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হয়ে গেছে। এখন যে কোনো সময়েই তারা পলি নেওয়ার কাজ শুরু করবে।

বিষয় হচ্ছে, যে চুক্তি হয়েছে, তা আর ফেরানো যাবে না কিন্তু আমরা দুটো বিষয়ে সতর্ক থাকতে পারি। প্রথমত, আমাদের এজন্য স্থান নির্দিষ্ট করে দেওয়া জরুরি। অর্থাৎ যাতে সব নদীর পলি মাটি নেওয়া না হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, যমুনার বালু রপ্তানি করা হবে এসব দেশে। আমরা চাই যমুনারও পয়েন্ট নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। আর অন্য কোনো নদী এতে অন্তর্ভুক্ত করা যেন না হয়। কারণ দক্ষিণের কিছু নদীর পলি নিয়ে আমরা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে পারি। দ্বিতীয়ত, আরেকটি বিষয়ে আমরা পরবর্তী সময়ের জন্য সচেতন থাকতে পারি, তা হলো- আর যাতে দেশের পলি মাটি বিক্রির কোনো চুক্তি না হয়।

নদীর পলি মাটি বিক্রির এই সিদ্ধান্তের অবশ্যই কিছু প্রভাব থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। যখন যমুনা নদীর পলি মাটি অপসারণ হবে তখন নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাবে। এসব নিয়ে আমাদের আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আমাদের আরো আয়তন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে সমুদ্রের এসব পলি ব্যবহারের মাধ্যমে। সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপ বাংলাদেশ থেকে পলি আমদানি করছে দ্বীপ তৈরি বা আয়তন বাড়ানোর জন্য। আমাদেরও কী নতুন ভূমি গড়ে তুলে আয়তন বাড়ানোর প্রয়োজন নেই? চুক্তির অন্যতম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই সুযোগটি আমরা হারাতে যাচ্ছি।

প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য যমুনা নদী ড্রেজিং এবং ড্রেজিং করা বালু সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে যাবে। এই ড্রেজিংয়ের ফলে  শুধু যে পলি বা বালু উঠবে তা নয়। এর সাথে ইতোমধ্যে জেগে ওঠা চর বা দ্বীপগুলোর উপরও প্রভাব পড়বে। ভেঙে যেতে পারে এসব চর বা দ্বীপ। সেক্ষেত্রে সেখানে এখন যারা বসতি গড়েছেন, তারা মালিকানাচ্যুত হবেন। তারা যাবেন কোথায়? তাদের পুনরায় বাসস্থান কে করে দিবে? পাশাপাশি এখন এসব চর বা দ্বীপ থেকে সামান্য পরিমাণে হলেও কৃষিতে যে অবদান রাখা হচ্ছে, তার প্রতিদানই বা কী হবে? এসব প্রশ্নের সমাধান জরুরি। আমাদের বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ ব্যবহার না করে আমরা প্রায়ই সেগুলো হেলায় নষ্ট করছি। অনেক খনিজ সম্পদ বিক্রির ফাঁদে হারিয়ে যাচ্ছে। তেমনি নদীর পলি বিক্রির সিদ্ধান্ত জলাভূমি, বনাঞ্চল, পাহাড়-ধ্বংসের মতই একটি সর্বনাশা পদক্ষেপ। আমাদের পলি সিঙ্গাপুর বা মালদ্বীপের ভূমি বাড়ানোর কাজে লাগালে আমাদের হয়ত অল্পকিছু আয় হবে। কিন্তু নদীর বালু জমে বঙ্গোপসাগরে যে নতুন ভূমি তৈরি হচ্ছে তার গঠন ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

আমরা ছোটবেলা থেকেই দাদা-চাচাদের কাছে শুনে এসেছি, বাংলাদেশের আয়তন আরো বাড়বে। কিন্তু সেই আয়তন আর বাড়েনি, বরং নদী ভাঙ্গনের কারণে মানচিত্রের ভেতরের অনেক অংশে পানিতে তলিয়ে গেছে। অথচ গভীর সমুদ্র তলদেশে প্রাকৃতিকভাবে জমা এই পলি (ভূবিজ্ঞানের ভাষায় ডিপ সি ফ্যান) বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করে দেশের আয়তন বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে আমাদের।

জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী প্রত্যেকটি দেশ উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে পেয়ে থাকে। অর্থ্যাৎ, নদীর পানির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে এবং স্রোতের ধারা পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করার মাধ্যমে এই বিশাল এলাকায় ব-দ্বীপ তৈরি সম্ভব। এর মাধ্যমে একদিক থেকে দেশের আয়তন বাড়বে, অন্যদিকে কৃষিজমির পরিমাণও বাড়ানো যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, স্যালাইন ওয়াটার নেমে যাওয়ার পর এসব এলাকায় কৃষিকাজ শুরু করা গেলে, জনবসতিও গড়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে জনসংখ্যার ঘনত্বও কমানো সম্ভব একমাত্র পলি মাটির সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, নদীর স্রোতের সঙ্গে আসা এসব পলির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে কিছু নতুন ভূমি তৈরি হওয়ার ঘটনা। কিন্তু উৎকন্ঠার বিষয় হচ্ছে, দেশের গভীর সমুদ্র তলদেশে প্রাকৃতিকভাবে জমা এসব পলি বিক্রি করতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে মূ্ল্য নির্ধারণসহ বিক্রির যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন যেহেতু পলি নেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে দুটো বিষয়ে আমরা কেবলমাত্র সংশ্লিষ্টদের পরবর্তী সময়ের জন্য সচেতন থাকার আহ্বান আমরা জানাতে পারি।

এটি ঠিক যে, দেশের প্রায় সাতশ ছোট-বড় নদীতে প্রতি বছর ২ বিলিয়ন ৪০ কোটি টন পলি পরিবাহিত হয়। এ থেকে নদীগুলোতে প্রায় ৩ কোটি টন পলি জমে থাকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা বছরে মাত্র ২ লাখ টন পলি অপসারণ করতে পারে। বাকি পলি মাটি দেশের নদ-নদীগুলোতে জমে থাকে। ইতিমধ্যে পলি পড়ে দেশের নৌপথ অর্ধেকেরও বেশি কমে এসেছে। বর্তমান সরকার নৌপথ সচল রাখতে কিছু উদ্যোগ নিলেও তা আদৌ যথেষ্ট নয়; এ কাজে সামান্য কিছু ড্রেজার সংগ্রহ করা হয়েছে। স্রোতের গতিপথ নিজের মতো করে ব্যবহার করে নতুন ভূমি সৃষ্টি করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে, সাময়িক সমাধান হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণে ড্রেজার কিনে সেগুলো ব্যবহার করে নদীর নাব্যতা বজায় রাখা যায়। তবে এতে পলির ব্যবহার নিশ্চিত হবে না।

বলা হয়, পলি জমে বাংলাদেশের নদীগুলো ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে, শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছে, আর বর্ষাকালে নদী ভাঙনের কারণ হচ্ছে। এসব পলি কিন্তু  আমাদের আশীর্বাদ।  আমরা এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি।  প্রতিবছর দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো ১ দশমিক ২ বিলিয়ন টন পলি বহন করছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পলি প্রবাহিত হয় সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’র একটি গবেষণার কাজে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার স্যারের সাথে। তিনি যদিও প্রধানত ভূমিকম্প, পুরকৌশল নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু তিনি তার গবেষণার অংশ হিসেবে বলছিলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পলির ব্যবহার নিয়ে। দক্ষিণাঞ্চলে নদীগুলোর পলি ব্যবহার করে নতুন ব-দ্বীপ তৈরি করা যায়। নদীর মোহনায় ক্রিকোণাকৃতি নতুন জেগে ওঠা ভূমিকে ব-দ্বীপ বলে। যেমন ভোলা, নোয়াখালী, কুতুবদিয়া, সন্দীপ ইত্যাদি। পদ্মা যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তখন ইছামতি, কুমার, মাথাভাঙ্গা, গড়াই নামে চারটি শাখানদী সোজা দক্ষিণমুখী হয়ে কুষ্টিয়া ও যশোর জেলার দক্ষিণে সামান্য পথ অতিক্রম করেই পদ্মার প্রচুর পলি ও মিষ্টি পানি বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে দেয়।

নদীর মোহনায় দিনে দুইবার জোয়ারের প্রভাবে পলি জমা পড়ে অতি দ্রুত গড়ে তোলে অসংখ্য ব-দ্বীপ। ব-দ্বীপে সৃষ্টি হয় নতুন পলি আধিক্য কাদামাটির নিম্নভূমি। প্রতিদিন জোয়ারে প্লাবিত হয় আবার ভাটায় জেগে ওঠে। সামান্য লবণ পানি ও মিষ্টি পানির মিলিত স্রোতধারায় বিধৌত হয় এই ব-দ্বীপ অঞ্চল। এই নিম্ন সমতল ভূমিতে জন্ম নেয় গরান জাতীয় শক্ত কাঠের ম্যানগ্রোভ বন। এভাবে সৃষ্টি হয়েছে সুন্দরবন। দ্রুত সাগরের মধ্যে বনভূমি এগিয়ে যেতে থাকে, দূরত্ব বাড়তে থাকে মিষ্টি পানির উৎস। এমনকি নতুন গড়ে উঠা ব-দ্বীপ স্যালাইন ওয়াটার নেমে গেলে, তা কৃষিকাজের পুরোপুরি উপযুক্ত হয়।

কৃষিকাজের সুযোগ সৃষ্টি হলে সেই ব-দ্বীপে নতুন বসতি গড়ে উঠতে পারে। এতে তিন ধরনের লাভ হতে পারে বাংলাদেশের। প্রথমত, দেশের আয়তন বাড়তে পারে। আশির দশকে যেটা বলা হতো অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণে বাংলাদেশের আয়তন বাড়বে। কিন্তু সেই আয়তন আর বাড়েনি সমুদ্রের পলিকে সুষ্ঠুভাবে আমরা ব্যবহার করতে পারিনি বলে। এই প্রক্রিয়ায় নতুন ব-দ্বীপ সৃষ্টি হয়ে দেশের আয়তন বাড়তে পারে। ফলে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমতে পারে। দ্বিতীয়ত, নতুন কৃষি ভূমির সৃষ্টি হবে। এমনিতেই দেশে প্রতিনিয়ত কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। নতু ব-দ্বীপ সৃষ্টির ফলে সেই সমস্যায় কিছুটা প্রলেপ দিতে পারে। তৃতীয়ত, দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে এসব ব-দ্বীপ তথা পলি বিরাট অবদান রাখতে পারে।

স্বাভাবিকভাবেই পলি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন ভূমি গড়ে তুলে আয়তন বৃদ্ধির জন্য সরকারের মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু এই অর্থ ব্যয়ের ফলে আমরা যে ভূমি পাবো, তার প্রতিদান নিশ্চয়ই অনেক বেশি। এমনকি সেই প্রতিদান পলি বিক্রির যে চুক্তি হয়েছে, তার থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ থেকেও বেশি হবে নিশ্চয়ই।

এ জন্য আমাদের করণীয় হলো,  পলি মাটিগুলোর পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করা। সমুদ্রের স্রোতের গতিপথ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই কাজটি করা যায়। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারিভাবে আরো বেশি গবেষণা করা যেতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়