আ.লীগের কেউ না, তবু কার্যালয়ের ঠিকানায় ওলামা লীগ
এনআর || রাইজিংবিডি.কম
নিজস্ব প্রতিবেদক : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নয় আওয়ামী ওলামা লীগ। তারপরও সংগঠনটি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৃতীয় তলা ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করছে।
সম্প্রতি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কর্তৃক গণমাধ্যম কর্মীদের হত্যার হুমকি এবং সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও রাজনীতির প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে সংগঠিনটি। এর সংবাদ সংগ্রহের জন্য সংগঠনের পক্ষে মঙ্গলবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মো. দেলোয়ার হোসেন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান।
এতে বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম কর্তৃক হত্যার হুমকি এবং সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদ ও রাজনীতির প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগের সংবাদ সম্মেলেন সচিত্র সংবাদ প্রকাশ ও পরিবেশনের জন্য আপনাদের পত্রিকা/সংবাদ সংস্থা ও টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও ফটোসাংবাদিক প্রেরণের আহ্বান করা হচ্ছে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনের সভাপতি আল্লামা ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালী।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে- আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ(৩য় তলা), ঢাকা-১০০০।
তবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, শাসক দলের নাম ভাঙিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিভিন্ন কাজের জন্য তদবির, চাঁদাবাজি, কাজী ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে সংগঠনটি। ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে ওলামা লীগ। দুই গ্রুপের মধ্যে প্রকাশ্যে সংঘর্ষও ঘটছে। গত শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ওলামা লীগের বোখারী অংশের মানববন্ধনের ওপর চড়াও হন হেলালী অংশের নেতা-কর্মীরা। বোখারী অংশের সভাপতির দায়িত্বে আছেন টাঙ্গাইলের মাওলানা আখতার হোসেন বোখারী এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা শেখ আবুল হাসান শরীয়তপুরী। এরা দুজনই পেশায় কাজী। আর হেলালী অংশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালী এবং সাধারণ সম্পাদক মাওলানা দেলোয়ার হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালী নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। আর দেলোয়ার হোসেন একসময় ট্রাকচালক ছিলেন। এখন ট্রাকের মালিক। দুই বছর আগে ওলামা লীগের আরো একটি গ্রুপ ছিল, যেটি বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে ইসলামিক ইউনাইটেড ফ্রন্ট নামে স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই অংশের নেতা মাওলানা ইসমাইল হোসেন হেলালী এখন এই দলটির সভাপতি। আর একসময়ের প্রতাপশালী হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরী গ্রুপ হেলালী গ্রুপে মিশেছে। হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরী মাদকদ্রব্য এবং নারীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এখন জেল খাটছেন।
সংগঠনটির আদি নাম ছিল আওয়ামী ওলামা পার্টি। এর জন্ম ১৯৬৯ সালে। মূলত ছয় দফাকে কেন্দ্র করে এ সংগঠনটির জন্ম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে পাকিস্তানি আলেম-ওলামারা এর বিরোধিতা করেন। তারা এটাকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান অংশে ছয় দফাকে সমর্থন করেন মাওলানা শেখ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বিন সায়ীদ জালালাবাদী (জালালাবাদী হুজুর)। ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু তাকে সমমনাদের নিয়ে কাজ করতে বলেন। এরপর মাওলানা ওলিউর রহমান, মাওলানা বেলায়েত হোসেন প্রমুখকে নিয়ে ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ছয় দফা’ নামে প্রচারণায় নামেন তারা। তারা বলেন, ছয় দফা ইসলাম পরিপন্থী নয় বরং ইসলামের পরিপূরক। এরপর ১৯৬৯ সালে তারা আওয়ামী ওলামা পার্টি গঠন করেন।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায় এই সংগঠনটি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই সংগঠনের প্রাক্তন নেতারা আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৯৮ সালে তারা আনুষ্ঠানিক সম্মেলনের মাধ্যমে মাওলানা হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরীকে সভাপতি এবং মাওলানা জহিরকে সাধারণ সম্পাদক করে কাজ করতে থাকেন। এই কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ইলিয়াস হোসাইন বিন হেলালী। কিন্তু ২০০১ সালে ভাঙনের মুখে পড়ে সংগঠনটি। সে সময় কাঁচপুরীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এদিকে মাওলানা ইসমাইলের নেতৃত্বে একটি অংশ আলাদা সম্মেলন করে তাকে সভাপতি এবং মাওলানা শেখ আবু হাসান শরিয়তপুরীকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে। আর হেলালী কাঁচপুরী অংশের হাল ধরেন। ২০০৪ সালে মাওলানা আখতার হোসাইন বোখারী ইসমাইল অংশের সভাপতি নির্বাচিত হলে মাওলানা ইসমাইল আরেকটি ওলামা লীগ কমিটি করেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ায় ক্রমান্বয়ে সব অংশই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে, মাঝে মধ্যে বোখারী অংশের নেতাদের আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের পাশে দেখা যেত। প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমকে পুলিশ পেটানোর সময়ও ওলামা লীগের এই অংশের নেতাদের উপস্থিতির ছবি সে সময়ে সংবাদপত্রে ছাপা হয়। আর হেলালী অংশকে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার সঙ্গে আন্দোলন করতে দেখা যায় কখনো কখনো।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আবার রাজনীতির মাঠে আবির্ভূত হয় ওলামা লীগ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শুরু থেকেই বিবাদে জড়িয়ে পড়ে বোখারী ও হেলালী অংশ। এদের মধ্যে হেলালী বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এবং বুখারী অংশ তোপখানা রোডে বসে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অক্টোবর ২০১৫/এনআর/রফিক
রাইজিংবিডি.কম