ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

একদিন শহীদুল জহির, অনেক দিন

হামিদ কায়সার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২  
একদিন শহীদুল জহির, অনেক দিন

সেখানে শুধু সুন্দরী মেয়েদেরই আনাগোনা করার কথা ছিল। এবং, যারা আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠতে চায় প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত। হ্যাঁ, আসত তারা। ঢাকা শহরের তাবৎ সুন্দরী মেয়েদের ঢল নামত। কেউ একা, কেউ দুজন, কেউ বা দল বেঁধে আসত। ঢাকা শহর তো বটেই, কলকাতার ছিপছিপে বেতস লতার মতো যার দেহ, সেই মুনমুন সেনও ঢাকা এলে একবার ঝড়োপাখির মতো ঢুঁ মারত ৪১ নয়া পল্টন বাড়িটায়!

তখনও কাকরাইলের রাজমণির মোড় থেকে জোনাকী সিনেমা হল অবধি নয়া পল্টন রোডের একদিকে বিএনপি অফিসটা মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়ায়নি। আরেক দিকে উটপাখির মতো গ্রিবা বাঁকানো গাজী ভবনেরও সরব উপস্থিতি ছিল না। তবে সেখানে সেই ৪১ নয়া পল্টনের একতলা ভবনের ভেতর একপাশে ছিল বিউটিশিয়ান জেরিনা আজগরের বিউটি পার্লার ‘লিভিং ডল’, আরেক পাশে গাজী নিজামউদ্দিন আহমেদের ফ্যাশন হাউজ ‘শখ’! আর সেই ভবনের পাশ ঘেঁষে ছিল জোনাকী সিনেমা হলের প্রাণময় অবস্থান, যেখানে তখনও ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ সিনেমা দেখার জন্য এসে লাইন ধরে সিনেমার টিকিট কাটত।

তাই সেখানে সে পরিবেশে লেখার সাধনে মজে থাকা কবি-লেখকদের ভিড়বাট্টা না থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক! কিন্তু যেত, কবি-লেখকরাও সেখানে যেত, একা যেত, দুজন মিলে যেত, দল বেঁধেও যেত তারা! কবি-লেখকরা তো আর সাজে না। তাহলে কেন যেত, কি তাড়নায়! লিভিং ডলে আসা সুন্দরী মেয়েদের দেখতে বুঝি? তওবা! তওবা! জোনাকী হলে সিনেমা উপভোগ করতে? তা দু-একবার তো আসাই যায়। কিন্তু হররোজ সিনেমা দেখতে আসার মতো অত সময় কোথায় কবি-সাহিত্যিকদের? তাহলে যে তারা নিত্য আসত? নিয়মিত গমনাগমন হতো?

হ্যাঁ, পদচারণার সঙ্গত কারণ ছিল। ফ্যাশন হাউজ ‘শখ’-এ বসতেন কথাশিল্পী সুশান্ত মজুমদার। শুধু কি সুশান্ত মজুমদার? কবি-সাহিত্যিকরা বুঝি সেই হারানো গোলাপের সৌরভও খুঁজতে যেতেন ৪১ নয়া পল্টনে, একদা যেখানে সাপ্তাহিক ‘সচিত্র সন্ধানী’র অফিস ছিল। প্রতি সপ্তাহে ফুটত সাহিত্যের স্নিগ্ধ রজনীগন্ধা; যার ভুরভুরে সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হতো বাংলাদেশের চারদিক। কিন্তু তত দিনে ‘সচিত্র সন্ধানী’ তৃতীয়বারের মতো বন্ধ হয়ে গেল! হ্যাঁ, সন্ধানীর একটা বায়ুচড়া রোগ ছিল! যেতে যেতে পথে হঠাৎ এর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেত! তবে, সেবার ‘সচিত্র সন্ধানী’ বন্ধ হলেও এর যিনি ছিলেন প্রাণপাখি, কবিতা-গল্প-উপন্যাস ছাপানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক, সেই সুশান্ত মজুমদার সে ভবনের মায়া ত্যাগ করতে সহসা সমর্থ হননি। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ অনুজ গাজী নিজামউদ্দিন আহমেদ সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এ লেখককে ‘শখ’-এর ব্যবস্থাপক বানিয়ে দারুণ সুসজ্জিত একটা রুমে বসিয়ে দিয়েছিলেন। সে রুম ঘিরেই কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকদের দারুণ জমজমাট আড্ডা বসত প্রায় প্রতিদিন, যার কোনো টাইমটেবিল ছিল না!

একেবারে যে বলেকয়ে বসত সে আড্ডা, তাও নয়, একেক সময় একেক কবি-লেখকের উদয় হতো। এভাবে সেখানে কতজনের যে সরব বিচরণ দেখেছি! লেখক কায়েস আহমেদ সেই পুরানা টাউনের গেন্ডারিয়া থেকে কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে আসতেন পড়াতে। অনেকটা পথ হেঁটেই যাওয়া-আসা করতেন। ফেরার পথে হয়ত সুশান্তদার রুমে খানিকক্ষণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-প্রাধান্য বাতচিৎ হলো। কবি মারুফ রায়হান কতকদিন কাজ করেছেন সন্নিকট ‘দৈনিক বাংলার বাণী’তে, কতকদিন বা ছিলেন ৪১ নয়া পল্টনেরই উল্টো পাশের ‘মাটি’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক, ফুরসত পেলেই চলে আসতেন, অবশ্য কার্যসূত্রও ছিল। লিটল ম্যাগ ‘বিনিময়’ সম্পাদনা সূত্রে আসতেন লুৎফর রহমান। তিনি এখান থেকেই ক্রমে শাহবাগের আজিজ মার্কেটে সন্দেশমুখী হন। অকালপ্রয়াত কথাশিল্পী শহীদ খান আসতেন ম্যারিয়েটা হয়ে। অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড় শ্রীখণ্ড, রাজনগর, মহিষকুড়ার উপকথা, দুখিয়ার কুঠি, নয়নতারা, মধু সাধুখাঁ, চাঁদবেনে এসব কোনো না কোনো বই থাকত হাতে। কথাশিল্পের কাগজ রূপম সম্পাদক আনওয়ার আহমদও এক রকম পড়ে থাকতেন সুশান্তদার কাছে। আরও আসতেন নিভৃতচারী কথাশিল্পী হুমায়ূন মালিক, কথাশিল্পী প্রশান্ত মৃধা, কবি মাশুক আল হুসাইন প্রমুখ। এছাড়াও আরও কাউকে কাউকে দেখতাম সেখানে, এ মুহূর্তে নাম মনে করতে পারছি না।

সুশান্ত মজুমদারের এ ঢেঁরাতেই একদিন দেখা হয়ে গেল কবি মোহাম্মদ সাদিকের সঙ্গে। লম্বা ছিপছিপে দেহের এ মেধাবী মানুষটির কবিতার ভক্ত হয়েছিলাম অনেক আগে থেকেই। কবে কোন পত্রিকায় পড়েছিলাম তাঁর কবিতা। মনের ভেতর গেঁথেছিল বেশ ক’লাইন। ‘ক্রিসেন্ট লেকের ধারে/ লেক জানে, লেক জানে, লেক জানে/ বুকের ঠিক বাঁ পাশে, বুক জানে, বুক জানে, বুক জানে।’ 

সেই কবিকে কাছে পেয়ে স্বভাবতই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলাম। মনে আছে সেদিন ‘রূপম’ সম্পাদক আনওয়ার আহমেদও ছিলেন। মারুফ রায়হান এবং মাশুক আল হুসাইনও থাকতে পারেন। স্মৃতি বিভ্রম হচ্ছে। সাহিত্য নিয়ে বেশ উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা হচ্ছিল। বিশেষ করে মোহাম্মদ সাদিক চিনুয়া আচেবের কথা বলছিলেন। সদ্য কী একটা উপন্যাস পড়েছেন তিনি সে লেখকের। কতটা ডিটেইলস এবং সূক্ষ্মভাবে বর্ণনা দিতে পারেন লেখক কৃষকের; কৃষকের জীবন ব্যবস্থার কতটা গভীরে পেরেছেন পৌঁছাতে তারই বৈশিষ্ট্য সবিস্তারে তুলে ধরছিলেন। তারপর সে কথার সূত্র ধরেই হোক অথবা প্রসঙ্গান্তরে মোহাম্মদ সাদিক, যিনি সাচ্চা কবি এবং তারচেয়েও অভিজ্ঞ ঋদ্ধ পাঠক, সেই সঙ্গে একজন সফল সরকারি কর্মকর্তাও বটে- এক কৃশকায় বই আমাদের সামনে মেলে ধরলেন। এবং বেশ দৃঢ় গলায়ই ঘোষণা দেওয়ার ভঙ্গিতে জানালেন, ‘বাংলাদেশে একজন শক্তিশালী কথাশিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে। সুশান্ত! বইটা আপনে পড়ে দেখবেন।’ 

সুশান্ত মজুমদার বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। পাতা উল্টিয়ে পড়েও নিলেন খানিক। তারপর কৌতূহলী আনওয়ার আহমদও এক রকম টেনে নিলেন বইটা নিজের কাছে। দেখতে দেখতে পড়তে পড়তে বলে উঠলেন, তাহলে সুশান্ত রূপমে একটা রিভিউ লিখে দিয়েন।  
মোহাম্মদ সাদিক খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ বইটার রিভিউ হওয়া দরকার। 

বইটি নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা হতে লাগল যে, আমিও কৌতূহল সংবরণ করতে পারি না। আনওয়ার আহমেদের হাত থেকে টেনে নিই নিজের কাছে। নামেই কেমন ধাক্কা লাগে। সার্থক কোনো গল্প-উপন্যাসের এমন প্রবন্ধ ধাঁচের নাম আগে কখনো শুনিনি, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। একটা ভিন্নতা তো আছেই, অভিনবও বটে। বইটার প্রচ্ছদও খুব সাদামাটা। যেন কেউ আনাড়ি হাতে আলগোছে লিখে রেখেছে বই এবং লেখকের নাম।

মোহাম্মদ সাদিকের উচ্ছ্বাস কিছুতেই থামছে না। আর তার কথা থেকেই পরিচয় বের হয়ে আসছে বইটির বিষয়বস্তুর। সেই সঙ্গে আমিও পড়ছি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা। প্রেক্ষাপট পুরনো ঢাকা। কিন্তু ১৯৮৫ সাল ঘিরেই সূচনা ঘটছে উপন্যাসের আখ্যানের। ‘১৯৮৫ সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রাসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিড়ে যায়।’ এই যে একটি বাক্য কী আশ্চর্য প্রতীকায়ন তখনকার বাংলাদেশের পরিস্থিতির, যেন সে আর সঙ্গতি বিধান করতে পারছে না। তখন তো পুরো বাংলাদেশটারই স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল। একদিকে স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের স্টিমরোলার চলছে। দমনপীড়ন নীতি চূড়ান্তে। সরকার-বিরোধী আন্দোলনও চরম রূপ ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরচারীর পতনের লক্ষ্যে একাট্টা। তাদেরর সঙ্গে যোগ দিয়েছে অপরাপর দলগুলো। এতটুকুর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নেই। দেশে দেশেই স্বৈরাচারী সরকারের আবির্ভাব ঘটে। আবার তাদের পতনের জন্য দুর্বার আন্দোলনও গড়ে ওঠে।

কিন্তু, অস্বাভাবিক ব্যাপারটি হলো, এই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে একাত্তরের ঘৃণিত অপশক্তি তখন স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির সঙ্গে ভিড়েছিল, প্রগতিশীল রাজনীতিকদেরর হাতে হাত ধরে রাজপথে গণআন্দোলন চালিয়েছিল। আর এ দৃশ্য দেখেই আবদুল মজিদেরর হৃদয়ের তন্তু স্যান্ডেলের ফিতের মতো ছিঁড়ে গিয়েছিল, কারণ সে দেখেছিল একাত্তরের পুনরার্র্ভিবকে, ‘নবাবপুরের ওপর অপরাহ্নের ম্লান আকাশ উইপোকায় ছেয়ে আছে আর পলায়নপর উইয়ের পেছনে অসংখ্য কাক হুটোপুটি করে। তার মনে হয় যেন কাকের চিৎকার এবং উইপোকার পলায়ন প্রচেষ্টার দ্বারা নবাবপুর রোডের ম্রিয়মাণ বিকেলে ও ভেতর এক ধরনের নীরব সন্ত্রাসের অনুভব চড়িয়ে পড়ে।’

আমি এভাবেই বইটির ভেতরে প্রবেশ করি। বইটির অবয়ব, নাম এবং প্রচ্ছদের মতোই বর্ণনাভঙ্গি এবং ভাষার ভেতরে সরলীকরণ খুঁজে পাই। তখন খুব পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাস পড়া হচ্ছিল। বাংলাদেশেও যারা লিখছেন বইয়ে এবং পত্রপত্রিকায়, সবার লেখাই পড়ছি; কিন্তু কারোর ভাষাভঙ্গি বা বর্ণনাভঙ্গির সঙ্গে মিল পাচ্ছিলাম না। আমার কাছে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছে, খুব আয়োজন নিয়ে যেন লিখতে বসেননি, আজকের কোনো কোনো তরুণ লেখক যেমন ফেসবুকে আগেই জানান দিয়ে রাখেন, একটা দারুণ উপন্যাস লিখতে যাচ্ছি। তেমন যেন আয়োজন ছাড়াই তিনি লিখতে বসেছিলেন, মাথায় ছিলও না বোধহয় কোনো ক্ল্যাসিক বা ঋদ্ধ কিছু একটা সৃষ্টি করে ফেলবেন এমন প্রগলভতা। এই যেমন উপমা অলঙ্লংকারের প্রয়োগ ঘটাবেন বা শৈলীতে আনবেন ভিন্নতা- এমন সব প্রস্তুতিও ছিল না। যেমন প্রস্রাব লাগলে প্রচণ্ড বেগ উপস্থিত হয়, তখন আর প্রক্ষালন-গৃহে না গিয়ে উপায় থাকে না, তেমনই একটি ভেতর-চাপে তিনি লিখতে বসে গিয়েছিলেন এবং লেখার সময় এই যে বাইরে এত কোলাহল চেঁচামেচি হচ্ছিল; আমাদের দ্বিতীয় সামরিক শাসকের সেনা বা পুলিশের গোলাগুলিতে কারও বুক এফোঁড় ওফোঁড় হচ্ছিল, এমনকি সে গুলির শব্দও, কিংবা যারা শ্লোগান তুলছিল, সে ধ্বনি কোনো কিছুই তার নিমগ্নতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারছিল না; তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন উনিশশ একাত্তর সালের পুরানা ঢাকার নবাবপুর রোডে, লক্ষ্মীবাজারে!

যেখানে বদু মাওলানা মানুষের মাংস বিলিয়ে বেড়াতো, নবাবপুরের পথেঘাটে রাস্তায় ছড়িয়ে থাকতো সেই সব মাংস আর কাকেরা সেই মাংস ভক্ষণের জন্য সারা আকাশেবাতাসে কালো আতঙ্ক ছড়িয়ে ঘুরে বেড়াতো। প্রতীকীর পর প্রতীকী মাত্রায় আর জাদুবাস্তবতার মিশেলে আমরা এরপর ক্রমাগত একাত্তরের সেই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করি আবদুল মজিদের ভীত চোখ এবং ধ্বস্ত সংবেদনার মন নিয়ে। আমরা ক্রমাগত সেই কালো দিনের অন্ধকারে নিজেদের হারিয়ে ফেলি এবং সেই কালো দিন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক বিপন্ন স্থবিরতায় কম্পমান হয়ে ওঠে এবং আমাদের জীবন এবং বাস্তবতা সংশয়ের ঘূর্ণাবর্তে আবর্তিত হয়ে যায়... এবং লেখাটা হয়ে যাওয়ার পর মানুষ যেমন প্রক্ষালন গৃহ থেকে বেরিয়ে আসে চাপমুক্ত, তেমনই একটা নির্ভার স্বস্তি তিনি অনুভব করেছিলেন। অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবে সেদিন, সেই ৪১ নয়া পল্টনের সুশান্ত মজুমদারের ঢেরায় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা খানিক উলটিয়ে পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছিল, তিনি লেখাটি লেখেননি, লেখাটি কেবল তাকে পরিচালন করেছিল মাত্র। প্রসববেদনায় যেমন নারী শুয়ে থাকে বিছানায়, কাতরায় যন্ত্রণায়, তেমনি তিনি আঁকড়ে ধরে বিছানার চাদরে  সমর্পিত হয়েছিলেন লেখাটিতে, তারপর সমস্ত যন্ত্রণা উগরে দিয়ে প্রসব ঘটিয়েছিলেন সে উপন্যাসের। হ্যাঁ, সেদিন সেই ৪১ নয়া পল্টনে সুশান্তদার রুমে আমার তাৎক্ষণিকভাবে তাইই মনে হয়েছিল, লেখাটি খুব ক্যাজুয়াল, লিখতে যাননি তিনি, লেখাটা তাঁকে ছিড়েফিড়ে বেরিয়ে এসেছে!

মনে রাখতে হবে, শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ বইটির সঙ্গে যেদিন পরিচিত হলাম, মোহাম্মদ সাদিক মাধ্যমে, তখন ১৯৮৮ সাল। বাংলাদেশ নামক শিশু রাষ্ট্রটির বুকে দ্বিতীয় সামরিক শাসকের যাতাকল চলছে। এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনেকখানেই ভুলুন্ঠিত। বেতার বাংলা পাকিস্তান আদলে হয়েছে ‘রেডিও বাংলাদেশ’, কুখ্যাত রাজাকার শাহ আজিজ পেয়ে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বাদ, সবুর খান কবরস্থ হয়েছেন জাতীয় সংসদ চত্বরে, নির্বাসিত গোলাম আযম দেশে ফিরে জামায়াতে ইসলামীর আমীরত্ব গ্রহণ করেছেন, দেশের নানা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবির সন্ত্রাসের মাধ্যমে সংহত করছে নিজেদের অবস্থান, ধর্মীয় লেবাসে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানী প্রেতাত্মা। টিএসসি ভবনে ছেলেমেয়েরা ব্যানারে টানিয়ে রাখছে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার চরণ, ‘জাতীয় পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরনো শকুন!’ 

ঠিক সেই সময়েই সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও শহীদুল জহির লিখে ফেলেছেন, ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। এবং তখনও শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের ডাক দেননি, তার আগেই স্বাধীনতার চেতনা হারানো দেশের বিপর্যয় সত্তাকে উন্মোচন করেছেন লেখক তাঁর প্রথম উপন্যাসে। কালিক বিচারে তো বটেই, দেশ এবং রাজনৈতিক সচেতন লেখক হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’র পর শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আলাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে বাংলাদেশের কথাশিল্প জগতে!

সেদিন, সেই ৪১ নয়া পল্টনে আড্ডা দিতে দিতে বেশ খানিক সময় অতিবাহিত হয়েছিল। সন্ধ্যা পেরিয়ে কখন রাত্রির নাকিকান্না শুরু হয়েছে। সুশান্ত মজুমদার তার অফিস সেদিনের মতো বন্ধ করে বেরিয়ে আসেন রাজপথে। আনওয়ার আহমেদ, মোহাম্মদ সাদিক, মারুফ রায়হান কিংবা মাশুক আল হুসাইন এবং আমি বা আমরা যে যার গন্তব্যে ফিরে যাব। সকলেই রিকশা খুঁজছি। তখন এই ঢাকা শহরে বেবিট্যাক্সিগুলো হাওয়ায় শিসের বিষ ছড়াত বটে, তবে বাসগুলোর ততটা তান্ডবতা ছিল না, প্রাইভেট কারের ড্রাইভারদেরও ছিল না ততটা মস্তানি আর মোটর বাইকের দৌরাত্ম্য তো কল্পনারই অতীত ছিল। আর রিকশার ছিল রমণীয় অবাধ অকুণ্ঠ বিচরণ। ঢাকার যে কোনো পথেই চলতো রিক্শা, খানিকটা ঔদ্ধত্য ছড়িয়েই যেন। সেদিন সে রাতে মোহাম্মদ সাদিক তার সফল জীবনধারায় অবিলম্বেই একটা রিকশা অধিকার করে বসলেন। তারপর আমি যখন আরেকটা রিকশা খুঁজতে যাব, তিনি, সেই সাচ্চা কবি ডাকলেন আমাকে, ‘হামিদ! আপনি তো ইউনিভার্সিটিতে যাবেন। আমার সঙ্গে আসেন। কথা বলতে বলতে যাই। শাহবাগে নামিয়ে দেব।’

আমি একটা ঠুমরি-সহবত খুঁজে পেলাম। মোহাম্মদ সাদিকের পাশে বসলাম। রিকশাটা কাকরাইল রাজমণি মোড়ের দিকে ছুটে চললো। আমাদের মধ্যে কথা আসে। কথা চলে। কত কথা। হাসান রাজা। সুরমা নদী। সুনামগঞ্জ। ঘাটেতে লাগাইয়া ডিঙা পান খাইয়া যাও। 

সে বড় সুন্দর শহর ছিল। ঢাকা। তখনও মানুষের দিকে তাকালে মানুষের নেগেটিভ থিঙ্কসটা আগে আসতো না। রাতের আলোগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দিত না বটে, মায়াবী অনুভবের অনুপল ছড়িয়ে দিত মানসচৈতন্যে। আমাদের রিকশাটা কাকরাইলের গির্জা পেরিয়ে হাইকোর্টমুখী পথ ধরলো না। একপাশে কাকরাইল মসজিদ আর একপাশে প্রধান বিচারপতির ভবন রেখে রমনার গাছের ছায়া ঘেরা পথ ধরে চলতে লাগল। মনে আছে, ঠিক সে পথেই আমি প্রথমবারের মতো শুনলাম শিল্পী ধ্রুব এষের নাম। মোহাম্মদ সাদিক, সাচ্চা কবি তিনি, বড়ই গৌরবের সঙ্গে ঘোষণা দেওয়ার ভঙ্গিতে জানালেন, ‘আমাদের সুনামগঞ্জ থেকে একটা ছেলে এসেছে ঢাকায়! ধ্রুব এষ। আর্টিস্ট। কী যে ছেলেটার হাতের টান! এত গভীর! দেখবেন হামিদ, এ ছেলেটা একদিন আমাদের শিল্পসাহিত্যের আঙ্গিনায় রাজত্ব করবে!’

তারপর যেতে যেতে রিকশাটা শেরাটনের মোড়ে এসেও শাহবাগের দিকে ঘোরে না, পরীবাগের রাস্তা ধরে। আমারও তখন কথা শোনার নেশা পেয়েছে। মোহাম্মদ সাদিকের সহবতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিস্তারে পৌঁছে গেছি যেনবা, ‘রিকশাটা আমাকে নামিয়ে দিয়ে আপনাকে হলে দিয়ে আসবে হামিদ।’ আশ্বস্ত করেন কবি।
তারপর গ্রিন রোডে সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের একটি গেটের সামনে যখন থামল রিকশা, মোহাম্মদ সাদিক বললেন, ‘শহীদুল জহির কিন্তু আমার পাশের বাসায়ই থাকেন। একই বিল্ডিংয়ে। আপনার সময় থাকলে দেখা করে যেতে পারেন!’

কথাটা শোনামাত্রই ঢাকা শহরের রাতের আধার মুহূর্তেই খুঁজে পেল পৌরাণিক আঁধার। আমি সঙ্গে সঙ্গেই মোহাম্মদ সাদিককে অনুসরণ করি। এবং অবিলম্বেই একতলা ভবনের বারান্দা পেরিয়ে একটি দরজার অভিমুখ করে দাঁড়াই। কলিং বেল নাকি খটখট। আজ আর কিসসু মনে নেই। দরজা খুলে সহাস্য শহীদুল জহির সামনে এসে দাঁড়ান। ‘এ হামিদ কায়সার। গল্প লিখে। আপনাকে দেখতে এলো।’ 
সঙ্গে সঙ্গে অভ্যর্থনা, ‘আসুন আসুন!’
মোহাম্মদ সাদিক দাঁড়ালেন না। ‘হামিদ আপনারা গল্প করেন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
তারপর, মোহাম্মদ সাদিক অন্তর্হিত হতেই, আমি নিজেকে খুঁজে পাই উত্তর দেয়াল লাগোয়া একটা সোফাসেটে। আর আমার সামনেই দেখতে পাই পূব দেয়াল সংলগ্ন একটি টেবিলে চেয়ারে বসে শহিদুল জহির এক ধ্যানে লিখে চলেছেন, যেন প্রসব-উন্মুখ মায়ের বেদনা নিয়ে। বসে থাকতে থাকতে আমার আর ধৈর্য্য থাকে না। জহির সাহেব কথা বলছেন না কেন। আমি উঠে দাঁড়াই। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই তার সামনে। তিনি এতটাই লেখায় নিমগ্ন যে, একটু ফিরে দেখারও ফুরসত নেই। কিন্তু কি লিখছেন তিনি? অক্ষরগুলো তো কিছুই বুঝতে পারছি না। অচেনা এক ভাষা। আমার চির চেনা সেই অ আ ক খ গ কোথায়? কাঁপা কণ্ঠে ডেকে উঠলাম, জহির ভাই! জহির সাহেব!

অবশেষে শহীদুল জহির মুখ তুলে তাকান। কিন্তু এ কি? গোঁফ কেন? কী ভারী গোঁফ! ঠিক যেন ম্যাক্সিম গোর্কি? আরে গোর্কিই তো! আমি বিস্মিত বিমোহিত তাকিয়ে থাকি। গোর্কি আমাকে হাত ইশারায় পাশের দিকে দেখিয়ে দিয়ে আবারও লেখায় মজে গেলেন। 

গোর্কির ইশারামতো আমি শহীদুল জহিরের খোঁজে অদূরেই আরেকটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যাই। তিনিও ধ্যানমগ্ন। গায়ের রং ফর্সা। দূর থেকেই দেখে বোঝা যাচ্ছে বাঙালি নন। তবু জহিরের আশায় তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে লেখা ফেলে এক নজর তাকালেন। ওহ গড! জেমস জয়েস! হাউ ক্যান ইট পসিবল! আমি এ কোন জগতে হারিয়ে গেলাম! শহীদুল জহির কোথায়? এখানে তো কেবল শহীদুল জহিরেরই থাকার কথা!
তিনি পেছন ফিরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দিকটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, দেখো তো, রেস্ট নিচ্ছে কিনা!

আমি সেদিকেই বিছানার দিকে এগিয়ে যাই। যতই সামনের দিকে এগোই। মানুষটাকে চিনতে পারি। কত ছবি দেখেছি। অর্ধশায়িত হয়ে কী একটা বইয়ে ডুবে রয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়ে অধীর গলায় জানতে চাইলাম, এখানে তো শহীদুল জহিরের থাকার কথা! তিনি কোথায়?
হেমিংওয়ে বই থেকে মাথা উঁচিয়ে পশ্চিম-উত্তর কোণটা দেখিয়ে দেন, এগোই। সেখানেও শহীদুল জহিরকে দেখি না। গুস্তাব ফ্লবেয়ার আর দস্তয়ভস্কি কী গভীর মনোযোগ দিয়ে দাবা খেলছেন! তীব্র ভয়, দুর্বোধ্য সব কৌতূহলে আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! এসব কি ঘটছে? কেন ঘটছে? আমি কি তবে এ পৃথিবীতে নেই। ওদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিয়ে উঠি, এখানে তো শহীদুল জহিরের থাকবার কথা ছিল?
গুস্তাভ এবং দস্তয়ভস্কি দুজনই আমার দিকে তাকান। তারপর ভেতরমুখী দরজার দিকে হাত ইশারা করে যেতে বলেন।

আমার অস্থিরতা আমাকে গভীরভাবে তাড়া করতে করতে সেই পেছনমুখী দরজার দিকে ঠেলে দেয়। দরজা খুলে ওপাশে যেতেই বেশ সুরম্য দীঘল এক বারান্দায় নিজেকে আবিষ্কার করি। আর অবাক হয়ে দেখি যে, সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করীম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক কী একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে! কথার ফাঁকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পাইপে একটা দীর্ঘ টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। আমি সেই অবসরে তার কাছে জানতে চাই, শহীদুল জহির?
তিনি হাত নির্দেশ করে সামনের খোলা প্রান্তরের দিকে দেখান। প্রান্তর কি, আসলে একটা বাগান। খোলা জায়গাটা পেরুলেই নানা রকম ফুলগাছের সারি। আমি বারান্দা থেকে নামি। কী সুন্দর জোছনা ফুটেছে! কামিনি ফুলের ঘ্রাণে বাতাসে কেমন একটা মম ব্যাপার। আমি বাগানের সরু পথে হাঁটতে থাকি। আর শহীদুল জহিরকে খুঁজি, খুঁজে বেড়াই। হঠাৎ কানে আসে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। চমকে বারান্দার দিকে তাকাতেই দেখলাম মোহাম্মদ সাদিক দাঁড়িয়ে আছেন। বারান্দায় ছায়ায় মানুষটাকে ঠিক ঠিক বোঝা যাচ্ছে। আমাকে ডাকছেন, ‘হামিদ একা একা কী করছেন ওখানে?’
‘সাদিক ভাই, আমি তো শহীদুল জহিরকে খুঁজছি!’
‘ও তো ঘরেই আছে! আসেন! আসেন!’

আমি ঘরে ডুকে দেখি সত্যি সত্যি শহীদুল জহির। শুধুই শহীদুল জহির। কেবলই শহীদুল জহির। দাঁড়িয়ে আছেন। বাল্বের মৃদু আলোয় ছায়ামগ্ন মুখ। আমার দিকে প্রসন্ন হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘হামিদ চা খাবেন তো? বানাই?’
আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা আসে না। আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখেই যাচ্ছি!

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়