ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

এমাদাসি কেওয়াদাসি: ৮ বছরের পরিকল্পনায় আমার ভুটান-ভ্রমণ

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৪, ২৩ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১৮:১৬, ২৩ মার্চ ২০২২
এমাদাসি কেওয়াদাসি: ৮ বছরের পরিকল্পনায় আমার ভুটান-ভ্রমণ

দেবকুলের মন কবে গলেছে সে হিসাব রাখার সময় হয়নি। তবে এক মুহূর্তে আঙ্গুলের রেখায় হিসেব কষে দেখলাম মাঝখান দিয়ে পেরিয়ে গেছে মাত্র আট বছর। সড়ক পথে ভুটান যাওয়ার ট্রানজিট ভিসা প্রদান শুরু হয়েছে। তাদের শখ হয়েছে তাই নরম হয়েছে, আবার যখন শখ মিটে যাবে তখন শক্ত হবে। এই নরম-শক্তের খেলায় আমাদের মতো মানুষের শখগুলো হয়ে যায় দরকচড়া। 

অবশেষে আট বছর পর পরিকল্পনার সেই ভুটান যাত্রা। বাস ছুটছে হনহন করে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লক্করঝক্কর বাসের নড়বড়ে আসনটায় বসে মনে হলো নাগরদোলায় চড়েছি। ঠান্ডায় যখন কুলানো গেল না তখন মিনতি করে একটা কম্বল চেয়ে নিলাম। সে কম্বল আর নাভির উপর টেনে তোলা গেল না। দুর্গন্ধে হাঁপানির টান উঠে যাওয়ার উপক্রম। পরের দিনের পথ সম্বন্ধে ধারণা যতটুকু আছে তার শতভাগই শোনা কথা। একটু ঘুমিয়ে নেওয়া দরকার কিন্তু ঘুম আর এলো না। যখন এলো তখন যাত্রার সমাপ্তি ঘটেছে। পৌঁছে গেছি বুড়িমারী স্থলবন্দরে। 

ও-পাড়ে বেড়ার ঘরের জায়গায় পাকা ঘর উঠেছে। দোকানপাট আগের মতোই আছে তবে ভিড়ভাট্টা বেড়েছে, এই যা। অপেক্ষায় আছি কখন সুবিধা মতো একটা গাড়িতে জায়গা করে নিতে পারবো। বোধহয় দশ মিনিটও পেরিয়ে যায়নি, লক্ষ্য করি আমার বয়সী দুই যুবক একরূপ ছোটাছুটি করছে। জানতে চাইল কোথায় যাব? গন্তব্য মিলে যাওয়ায় গাড়ির পাশে দাঁড়াতে বলে হাওয়া হয়ে গেল। পাঁচ মিনিট পর চার সদস্যের আস্ত একটা পরিবার নিয়ে হাজির। মাইক্রোবাস বলতে যা বুঝায় গাড়িটা ঠিক তাই। ক্ষুদ্র গাড়িটার সামনে একজন আর বাদাবাকি ছয়জন ঠাসাঠাসি করে পেছনে। চালক জানাল মহাসড়কের সংস্কার চলছে তাই ভিন্ন পথে যেতে হবে। আমাদের তাতে আপত্তি নেই, জয়গায় পৌঁছলেই হলো। ওদিকে চার সদস্য পরিবারের শিশু দুটির উচ্ছ্বাসের সীমা পরিসীমা নেই। 

শুরু হলো তাদের মহা প্যাচাল। যুবকদ্বয় পুরান ঢাকার বাসিন্দা, পেশা ব্যবসা। সময় করে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা তাদের শখ। কার কি অবস্থা সেদিকে খেয়াল নেই, কথা চলছে এক নাগাড়ে। একটানা এত দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকাই ভাষা শোনার পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। বেতাল কথার মাঝে বেফাস শব্দের উচ্চারণগুলো সামনে বসা লোকটির ভাষণকে অধিকতর শ্রুতিমধুর করে তুললো। তাতে শিশু দুটি বারংবার পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি আদান-প্রদান করে মজা পেল। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মা আলতো চর বসিয়ে দেওয়ার মতো করে হাত তুলে নিঃশব্দ শাসন বজায় রাখলেন একেবারে শেষ পর্যন্ত। 

ওদিকে তাদের নির্লিপ্ত পিতার দৃষ্টি এবং সমস্ত মনোযোগ বাইরের দিকে। উল্টো দিক হয়ে বসার কারণে আমার জন্য বাইরে দেখা সুখকর হয়ে উঠল না। আমি যেন তারই দৃষ্টিতে দেখতে থাকলাম। নীরব এবং স্বল্পবাক মানুষটির দুই চোখজুড়ে ফুটে ওঠা ঝলমলে উচ্ছ্বাস পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই, তবে তার গভীরতা ঠিকই আন্দাজ করতে পারলাম। আগস্ট মাস, রোদের প্রচন্ড তাপ। তার উপর দিয়ে গাদাগাদি করে বসা। সকলের অবস্থা মোটামুটি কাহিল। শুধু একজন বাদে, তার মহাভারতে কততম পর্ব চলমান সেদিকে অবশ্য কারও খেয়াল নেই। যাই হোক, একটা বিরতি খুব প্রয়োজন। মিলেও গেল। 

ছোট্ট ভোজ পর্বে পরস্পরের খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশ আন্তরিক হয়ে উঠল। এতক্ষণ যে লোকটিকে সকলেই ভাই বলে সম্বোধন করছিলাম পুরান ঢাকার সহযাত্রীদ্বয়ের বদৌলতে তিনি হয়ে গেলেন দুলাভাই। বিরতির পর সন্তানদের মা একা একা বিড়বিড় করে বলছিলেন- বড় মেয়ে ষষ্ঠ  শ্রেণীতে আছে, ওর এসএসসি পরীক্ষার আগে আর কোথাও বের হচ্ছি না। দুলাভাই হাতের আঙ্গুলে সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম তারপর এসএসসি এমন করে গুনে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন- ততো দিনে আমি তো দম বন্ধ হয়ে মারা যাব। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। বাংলাদেশের মানুষ ভ্রমণকে জীবনের অনুষঙ্গে পরিণত করতে শিখছে! ভদ্রলোক জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়ে দিয়েছেন মালয়েশিয়ায়। পরিশ্রম করে যে কয়টা টাকা উপার্জন করেছেন তা দিয়ে নারায়ণগঞ্জে মোটর পার্টস-এর ব্যবসা শুরু করেছেন। সড়কে দুই-তিনটি লেগুনাও নামিয়ে দিয়েছেন। উপার্জনের একটা অংশ বরাদ্দ রাখেন ভ্রমণের জন্য। প্রতিবছর পরিবার নিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া এবং নেপালের বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরে বেড়ান।

জয়গাঁ সীমান্তে ইন্ডিয়া এবং ভুটান উভয় পাশের আনুষ্ঠানিকতা ঝুটঝামেলাহীন, টাকা খাওয়ার জন্য কেউ এক হাত জিহ্বা বের করে বসে নেই। আমার পরিকল্পনা ছিল ভুটানে প্রবেশ করে ফুন্টশলিং-এ থেকে যাওয়া এবং পরের দিন সকালের বাসে থিম্ফুর উদ্দেশ্যে রওনা করা। পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করতে করতেই একটা মাইক্রোবাস ঠিক হয়ে গিয়েছে। সকলেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাহলে আমি আর বাদ থাকি কেন? উন্নত গাড়ি, বেশ আরাম করে বসার ব্যবস্থা। একেক জনের চোখে মুখে স্বস্তির বহিঃপ্রকাশ। সামান্য এগিয়েই পথ উঠে গেল উপরের দিকে। এক ঘণ্টার মধ্যে আবহাওয়ার পরিবর্তন, তীব্র গরম থেকে ঢুকে গেলাম শীতল হাওয়ায়। মেঘমালার মাঝ দিয়ে সুন্দর, সুনিয়ন্ত্রিত এবং নিরাপদ পথ। 

গাড়িঘোড়ার সংখ্যা নেহায়েতই কম। পথে কতবার বিরতি নেয়া হলো হিসাব নাই। হঠাৎ কোন ফলের দোকান দেখলেই নেমে পড়া। দৌড়ে গিয়ে যার যেটা পছন্দ নিয়েই ফিরে আসা অথবা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া। ফলাহারের একাধিক বিরতির পর সন্ধ্যার আগ দিয়ে আর পারা গেল না। এবার ভারি কিছু খাওয়া দরকার। গাড়ির চালক সজ্জন লোক, আমাদের কোন আবদারই অপূর্ণ রাখলেন না। গাড়িটা থামালেন পাহাড়ের পাদদেশে অত্যান্ত পরিপাটি এক রেস্টুরেন্টের সামনে। জনমানবহীন রেস্টুরেন্ট তবে মেঘেদের প্রতাপে একেবারে জমজমাট। ভাত না পেলেও বিকল্প হিসেবে যা পাওয়া গেল তা ভাতের কাছাকাছি। প্রত্যেকেই এক বাটি নুডুলস নিলাম। সঙ্গে যে যার পছন্দ মতো পানীয়। পেট ভরে খাওয়ার পর শরীর যেন তখনই শুয়ে পড়তে চাইল। ওটাকে আসকারা দিলে যে আমাকে পাঁজাকোলা করে গাড়িতে তোলা লাগতে পারে সেই আতঙ্কে একরূপ জোর করেই উঠে দাঁড়ালাম। বিল পরিশোধের সময় হলে আপা তার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমাকে দুলাভাই ডেকেছে এখন কর্তব্য পালন করো। দুলাভাই স্বস্নেহে কর্তব্য পালন করলেন এবং সর্বশেষ বিরতি পর্যন্ত করেই গেলেন।

রাত সোয়া দশটা বাজলো থিম্ফু গিয়ে। থিম্ফুতে সোয়া দশটা মানে অনেক রাত। শহরজুড়ে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সবাই মিলে ভেবে দেখলাম অন্তত এই রাতটা একই হোটেলে থাকা উচিত। সকাল হলে যে যার সুবিধামতো জায়গায় চলে যাব। দুইটা হোটেল দেখার পর তৃতীয় হোটেলে যাওয়ার আগেই এক জায়গাতে থাকার যে সমন্বিত ভাবনা তাতে চিড় ধরল। দুইজন চলে গেল নিজেদের সুবিধামতো জায়গায়। নিস্তব্ধ শহরের রাস্তায় একটা মানুষও নেই। বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে আমি আর কেটে পড়তে পারলাম না। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তিতে বাচ্চারা প্রায় ন্যুয়ে পড়েছে। অগত্যা ফিরে গিয়ে প্রথম দেখা হোটেলটাতেই উঠে পড়লাম। মুখোমুখি ঘর। আমারটা সিঙ্গেল আর তাদের ডাবল। হোটেলের পরিবেশ মোটেও ভালো না। এত নিম্নমানের জায়গায় আগে কখনও থাকা হয়নি। ভাবলাম একটা রাতই তো, ঘুমিয়ে পড়লেই পার হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর দরজায় ঠকঠক শব্দ। খুলে দেখি একজোড়া কলা আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুলাভাই। আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন- খেয়ে নিন। (চলবে) 
  
 

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়