ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু...

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু...

ফাইল ফটো

লিমন আহমেদ
ঢাকা, ১২ সেপ্টেম্বর: অপার রহস্যের হিমালয় থেকে নেমে আসা জলরাশি বাংলাদেশের ভূ-ভাগের ওপর দিয়ে সহস্র নদীর ধারায় ভাটির পথ বেয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে।

বাংলাদেশ তাই ভাটির দেশ। এই ভাটির দেশেরই একটি ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ জেলা। যার দিরাই থানার উজানধল গ্রামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বেয়ে গেছে এই নদী, এর নাম কালনী।

কালনীর অনেক দান। তবে তার শ্রেষ্ঠ দান বুঝি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কালনীর বুক ঘেঁষে টিকে থাকা উজানধল গ্রামে তার জন্ম।

আকাশ, মাটি, আলো, হাওয়া, জল সর্বোপরি প্রকৃতির আবেগ নিয়ে এদেশের মানুষ প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বাংলা গানের যে ঐতিহ্য প্রবহমাণ রেখেছে। যাদের হাত ধরে এ জাতির এই ঐতিহ্য টিকে আছে তাঁদেরই একজন ভাবসাধক শাহ আবদুল করিম।
আজ এই সাধকের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। বিনম্র শ্রদ্ধা হে সাধক...

দারিদ্রতা ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। বাউল সম্রাটের প্রেরণা তার স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। তিনি তাকে আদর করে ডাকতেন ‘সরলা’।

ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ফকির লালন, রাধারমণ, পাঞ্জু শাহ এবং দুদু শাহ’র দর্শন থেকে।

তবে তিনি আধ্যাত্মিক ও বাউল গানের দীক্ষা লাভ করেছেন কামাল উদ্দীন, সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশ এর কাছ থেকে। তিনি শরীয়তী, মারফতি, নবুয়ত, বেলায়াতসহ সবধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন।

তার এসব চিন্তার সাথে পরিচয় মিলে-‘কি সুন্দর এক নাও বানাইছে’, ‘গাড়ী চলে না চলে না’ ইত্যাদি গানগুলোর কথায়।

তার গানের কথায় বারবার উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ। আধুনিক সভ্য সমাজে সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসন তাকে ব্যথিত করেছে। সে বেদনা তিনি প্রকাশ করেছেন গানের ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। গ্রামের নও-যোয়ান হিন্দু-মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম/ আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ শিরোনামের জনপ্রিয় বাণীতে।

শাহ আবদুল করিম তাঁর সঙ্গীত জীবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রথম থেকেই আমার গানের প্রতি টান। হিন্দু মুসলমানের দেশ গানের একটা পরিবেশ ছিলো। দাদা সারিন্দা নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতো।

‘ভাবিয়া দেখো মনে
মাটির সারিন্দা বাজায় কেমনে...’

দাদার এই গানটা আমারে খুব ভাবাইত।’

তারপর দিনে দিনে তিনি একসময় কেবল গানের সুর-বাণীতেই নিজেকে সমর্পিত করেন। এ কথাটি তিনি তাঁর গানেই প্রকাশ করেছেন সুর-বাণীর যুগল সম্মিলনে, ‘আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া।’
তারপর কেবল লিখেছেন, গেয়েছেন। আর এগিয়ে গিয়েছেন কিংবদন্তীর পথে।

জীবনের কোনো প্রতিরোধই শাহ আবদুল করিমকে রুখতে পারেনি। বরং তিনি সুগভীর একাগ্রতা, নীতিনিষ্ঠ সত্যাচার ও নিরন্তর সঙ্গীতসাধনার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলার মানুষের কাছে ভাটি অঞ্চলের বাউলসম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। রচনা করেছেন বিচিত্র ধারার গান। যা গ্রন্থাকারে ধলমেলা, ভাটির চিঠি, কালনীর ঢেউ, গণসঙ্গীত ইত্যাদি নামে প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তিগত জীবনে শাহ আবদুল করিম ছিলেন অত্যন্ত অনুভূতিশীল একজন মানুষ। সংসার জীবনে তিনি স্ত্রীর প্রতিই বেশি আসক্ত ছিলেন। বলা চলে তাঁর পত্নীপ্রেম ছিল অন্তহীন। সে কথার প্রমাণ আছে তাঁরই রচিত গানে, ‘সরল তুমি নাম তোমার সরলা।’

অকালে দেহত্যাগী স্ত্রী’র কথা মনে হলে তিনি উতলা হয়ে উঠতেন। অশ্রুভেজা নয়নে তার স্মৃতিচারণ করতেন। বলতেন, ‘বাবা-মায়ে নাম রাখছিল বৈশাখী। আমি নাম রাখছি সরলা। সে যদিও লেখাপড়া জানত না। তবু এমন একটা মানুষ আছিলা। তারে ধইরা রাখতে পারলাম না...!

সরলার স্মৃতিচারণে করিম গান বেঁধেছিলেন, ‘কেন পীরিতি বানাইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাবে যদি / ও  আমি মরণ জ্বালা সইতে না পারি...

স্বীকৃতি ও মৃত্যু

২০০১ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন বাউল শাহ আব্দুল করিম। এ ছাড়া দ্বিতীয় সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস এবং কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক পান।

বর্তমানে তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে, হাল আমলের জনপ্রিয় সঙ্গীতধারা ব্যাণ্ডসঙ্গীত শিল্পীদের কণ্ঠে, ইউরোপ থেকে সঙ্গীতশাস্ত্রে দীক্ষিত শিল্পীদের কণ্ঠে এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে ভারতে এবং যুক্তরাজ্যের বাঙালি সমাজে।

শাহ আব্দুল করিমের জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র এবং গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি তার দশটি গানের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে রচিত সকল গবেষণাপত্র ও গ্রন্থের অনিবার্য আশ্রয় তাঁর গান।

বাউল সাধক শাহ আবদুল জীবনের একটি বড় অংশ লড়াই করেছেন দারিদ্রতার সাথে। ২০০৬ সালে সাউন্ড মেশিন নামের একটি অডিও প্রকাশনা সংস্থা তার সম্মানে ‘জীবন্ত কিংবদন্তী : বাউল শাহ আবদুল করিম’ নামে তার জনপ্রিয় ১২টি গানের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে।

এই অ্যালবামের বিক্রির অর্থ তাঁর বার্ধক্যজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য তার পরিবারের কাছে তুলে দেয়া হয়।

২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট আমাদের ছেড়ে যান।

স্বপ্ন ও পূরণের প্রতীক্ষা...

বাউল সম্রাটের স্বপ্ন ছিল সুনামগঞ্জে ‘শাহ আব্দুল করিম সঙ্গীতালয় প্রতিষ্ঠা’। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চান তার ভক্ত-অনুরাগীরা।

শাহ আব্দুল করিমের পুত্র শাহ নূর জালাল বলেন, ‘বাবা বহুবার অনেক মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন যে, সঙ্গীতালয়টা হলে এখানে আমার গানগুলো অবিকৃতভাবে, শুদ্ধ স্বরে প্রকাশ হতো। এখানে আমার লোক ছিল, শিক্ষা দিত। কিন্তু আমার আশাতো এখনো পূরণ হয় নাই।’

অকাল প্রয়াত সাংবাদিক-গায়ক দলছুট ব্যান্ডের সঞ্জীব চৌধুরী বাউল আব্দুল করিমের ‘গাড়ী চলে না চলে না...’ গান গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিলেন। ২০০৫ সালে হাবিব ওয়াহিদের ‘মায়া’ অ্যালবামটি বাউল করিমের গানের জন্য সুপারহিট হয়।

আজ প্রিয় মানুষটি আমাদের মাঝে নেই। তবু আমাদের হৃদয়ে বয়ে চলবেই তার গান, তার সুর-তারই প্রিয় নদী কালনীর ঢেউয়ের মত। তার অনুরাগীরা ভালবাসার আকুতি প্রকাশ করবে তারই সৃষ্ট অভিমানের বানীতে-‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি...?


রাইজিংবিডি/এলএ /শামটি




রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়