ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘পিতা-মাতার অতিরিক্ত ভালোবাসা, হোমসিকনেস ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি’

অরিন্দম বিশ্বাস || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ২৩ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১৮:৩৮, ২৩ মার্চ ২০২৩
‘পিতা-মাতার অতিরিক্ত ভালোবাসা, হোমসিকনেস ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সমাপ্তি’

বঙ্গদেশে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক আর পশ্চিমা দেশগুলোতেও পিতা-মাতার সঙ্গে তাদের সন্তানের সম্পর্কের পার্থক্যটা বেশ চোখে পড়ার মতো। এদেশে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা অনেকটা আত্মার সম্পর্ক, এর মানে এমনটা নয় যে, পশ্চিমা দেশসহ অন্যান্য দেশে সন্তানের সঙ্গে তাদের পিতা-মাতার সম্পর্কটা অনাত্মীয়।

বঙ্গদেশে শৈশব থেকেই শিশুরা যতটা পিতা-মাতার সান্নিধ্যে বড় হয়, তেমনটি হয়তোবা পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখা যায় না। এদেশে শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মায়েরা সন্তানকে বুকে আগলে রাখেন। যত বিপদ আপদ আসুক না কেন, সন্তান যেন কষ্ট না পায়, সেরকমই ব্যবস্থা করে থাকেন এদেশের পিতা-মাতারা। এদেশের মায়েরা সন্তানকে রাতেরবেলা নিজের পাশে রেখে ঘুমাতে গেলেও, পশ্চিমা দেশগুলোতে সন্তানকে কক্ষের আলাদা জায়গায় রেখে রাত্রে ঘুমাতে যান, এর মানে আপনি ভাববেন না যে, এতে তাদের সন্তানের যত্নআত্তি কম হয়। তবে এতে একটা জিনিস প্রতীয়মান হয় যে, এদেশে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের গভীর ভালোবাসা ও আদরের সম্পর্কটা শুরু হয় সেই শৈশবেই, আর যা ভবিষ্যতের দিনগুলোতেও ছাপ ফেলে।

সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা, আদর-যত্ন থাকবে, এটা স্বাভাবিক এবং এটাই সত্য। কিন্তু সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অতিরিক্ত স্নেহ-ভালোবাসা, এটা বেশি খেলে যেমন বদহজম হয় তার মতন। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার অতিরিক্ত স্নেহ-ভালোবাসা বাস্তব জীবনে সন্তানকে মেরুদণ্ডহীন করে ফেলে।

যেমনটি বলছিলাম আরকি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যখন ভর্তি করানো হয়, তখন সবচেয়ে কাছের বিদ্যালয় ভর্তি করানো হয়, যাতে করে মা-বাবার চোখের আড়াল না হয় তার সন্তান। সন্তানও মা-বাবার সান্নিধ্যে থাকার কারণে মা-বাবা আর একটা নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বড়ো হতে থাকে। এমনি করে যখন প্রাথমিক সম্পন্ন করে, মাধ্যমিক ও উচ্চতর মাধ্যমিক সম্পন্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসে, তখন মা-বাবার অবস্থা হয়ে উঠে শোচনীয়। সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে দূরে পাঠাতে হবে, অনেক মা-বাবা সাহস পায় না। আবার মা-বাবার কাছে লালিত পালিত হওয়া ১৮/১৯ বছরের এরকম শিশু সন্তানও নিদির্ষ্ট পরিবেশে ও গণ্ডির মধ্যে বড় হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাইরের পরিবেশ ও প্রতিযোগিতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কষ্টকর হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন হয়, যেমনি এক ছন্দপতনের ঘটনার সাক্ষী হলাম। 

সেদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে ও তার মা (পরিচয় জেনেছিলাম পরে) বিভাগের অফিস-রুমের বাইরে দাড়িয়ে। আমি তাদের পাশ কাটিয়ে বিভাগের অফিস-রুমে ঢোকার পরপরই মেয়েটি আমার পিছন পিছন এসে আমাকে সালাম দিয়ে বললো, স্যার, আমি রিক্তা (ছদ্মনাম), ভর্তি বাতিল করতে এসেছি, আমি আইন বিভাগে প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী। 

আমি: আপনি ভর্তি বাতিল করবেন? আচ্ছা (ভেবেছি মেডিকেলে ভর্তি হবে)। আমাদের অফিস সহায়ক আফরোজা আপা আসুক উনার কাছে জিজ্ঞেস করলে বলে দিবেন কি করতে হবে। অফিসে কিছুক্ষণ বসে আছি, মেয়েটি আবার বললো যে, স্যার, আজই ভর্তি বাতিল করে চলে যাবো।

আমি: ঠিক আছে, আপনি আজকেই বাতিল করে যান। কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় ভর্তি হবেন?

রিক্তা: (কাঁপা কাঁপা গলায়) স্যার, কিশোরগঞ্জের অমুক কলেজে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার মনে হলো, একটু অস্পষ্ট শুনলাম, আবার মনে হলো, ঠিক শুনেছি তো? আবার জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ভর্তি হবে? একই উত্তর দিলেন রিক্তা।

আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজকে ছোট করছি না। কিন্তু অবাক হয়েছি এই কারণে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তারপরে আবার আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে সে কিনা কলেজে ভর্তি হবে! আমি একটু আশ্চর্য হয়েছি। কারণ প্রতি বছর লাখ লাখ পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয় শুধুমাত্র পাবলিক বিশ্বিবদ্যালয়ে একটা আসনে ভর্তি হওয়ার জন্য আর মেয়েটি ভর্তি হয়েও বাতিল করতে চাচ্ছে কেন? জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ভর্তি বাতিল করবেন কেন?

রিক্তা: স্যার, আমার ভালো লাগে না, এখানে মন টেকে না, শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ে। গত একমাস অনেক চেষ্টা করেছি এখানে থাকার কিন্তু পারিনি, শুধু কান্না আসে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। অসুস্থ হয়ে গেছি।

মেয়েটির মা এবার মুখ খুললো। আমাকে বলছে, স্যার, আমি অনেক বুঝিয়েছি যে, একটা বছর অনেক পড়াশোনা কোচিং করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হইছো বাড়ি যাইয়ো না, ভর্তি বাতিল করো না, মেয়ে কথা শোনে না। শুধু কান্দে। কি করবো স্যার? একটু বোঝান।

আমি মেয়েটি ও মেয়ের মাকে আমার চেম্বারে নিয়ে বসালাম। পরিবারের খোঁজ নিলাম, পরিবারে বাবা-মা আর রিক্তারা পাঁচ বোন। তার মধ্যে তিন বোন পড়াশোনা করেছে অমুক কলেজ থেকে রিক্তা চতুর্থ, এখানে ভর্তি ছিল বাতিল করে চলে যাবে আর ছোট বোন নবম শ্রেণিতে পড়ে। রিক্তার মাকে বললাম, আপনার মেয়েকে কি কখনো বাড়ির বাইরে রেখে পড়াননি বা কখনো বাড়ির বাইরে আত্মীয় বাড়ি একা একা থাকেনি?

রিক্তার মা: না, স্যার। ওর সব কিছুই বাড়ি থেকে। ওর বাবা কিংবা আমি গিয়ে স্কুল থেকে আনতাম, একইভাবে কলেজে গিয়ে। এমনকি বাড়ি থেকে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কোচিং করতো। বুঝলাম, মেয়েটির প্রচুর হোমসিকনেস। চেষ্টা করলাম বোঝানোর। আমার জীবনের কিছু গল্প ওকে বললাম। আমার এক সময় এমন হতো, কষ্ট পেয়েছি বাড়ির জন্য। সেই কষ্ট কাটিয়ে আজ আমি এখানে। ওকে বোঝালাম, তোমার জীবনে এই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি বাতিল সিদ্ধান্ত কতটা ভালো-মন্দ, এখন না বুঝলেও পরে বুঝবে। বিভাগে মিডটার্মের শুরু হওয়ার ১০ মিনিট বাকি, বললাম যে, আমাকে উঠতে হবে রিক্তা। তুমি আরো কিছুক্ষণ ভাবো, দরকার হলে আরো দুদিন ভাবো। তুমি ভর্তি বাতিল করো, তুমি ভর্তি বাতিল করতে চাইলে কেউ বাধা দেবেনা কিন্তু সময় নাও। আজ করো না, পরশু বা তারপরে করো।

মেয়েটির চোখে জল দেখতে পেলাম, বুঝতে পারলাম যে কাঁদছে, বিড় বিড় করে বলছে, স্যার, আমার এখানে কষ্ট হয়, মন বসাতে পারি না পড়ার জন্য। রিক্তার মায়ের চোখে জলের বিন্দু বিন্দু দেখতে পেলাম। বুঝলাম, আমার শেষ চেষ্টাও বৃথা হয়ে যাচ্ছে। মিডটার্ম শেষে বিষয়টা আমার বিভাগের বড় ভাই ও সহকর্মী আশিক ভাইকে জানালে বললো যে, উনার কাছে পাঠাতে। আশিক ভাইয়ের কাছে রিক্তা ও রিক্তার মা গিয়েছিল।

আমি দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্য ক্যাফেটেরিয়া যাচ্ছিলাম। দুপুর ২টার দিকে আশিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। আশিক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, মেয়েটি কি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে? আপনি কি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন?

আশিক ভাই বললো, মেয়েটি ভর্তি বাতিল করে এসেই তার সঙ্গে দেখা করেছে। 

ক্যাফেটেরিয়া না গিয়ে আবার বিভাগেই ফেরত আসলাম।

বাবা-মায়ের প্রতি অনুরোধ, সন্তানকে আদর-যত্ন, স্নেহ- ভালোবাসার পাশাপাশি তাদেরকে বেড়ে উঠার সুযোগ দিন। তাদেরকে সাপোর্ট দিন, কিন্তু পা থাকতেও পঙ্গু বানাবেন না দয়া করে।

লেখক: প্রভাষক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

/ফিরোজ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়