বাবার সম্পত্তিতে নারীর ভাগ, বাধা যেখানে
মুমতা হেনা মীম || রাইজিংবিডি.কম
সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য দরকার পায়ের নীচের জমি। সভ্য সমাজ নারী ও পুরুষ উভয়েরই সংমিশ্রিত রূপ ও অবদান। কিন্তু বর্তমান কালেও নারীরা বঞ্চিত হন পরিবার এবং সমাজে। পারিবারিক সম্পত্তিতেও পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য অংশ। ফলে নিগৃহীত হচ্ছেন পদে পদে।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই নারীকে অবদমন করার চর্চা চালু রয়েছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব দিক থেকেই নারী হয়েছেন শোষণের লক্ষ্যবস্তু। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যা সন্তানকে জীবিত হত্যা করা হতো, অস্বীকার করা হতো। সে চর্চা এখনো এই সমাজে প্রচলিত! এখনো অনেক পরিবারে কন্যাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে, অধিকার হরণ করে সন্তান হিসেবে অস্বীকৃতি জানানো হয়!
আইয়ামে জাহেলিয়াতের ঘোর কালো অন্ধকার যুগে-যুগে ছিল এবং এখনো আছে; কেবল যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলে নতুন আকার ধারণ করেছে। উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে পবিত্র কোরানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বাবার সম্পত্তিতে দুই মেয়ে একজন ছেলের সমান অংশ পাবেন’। কোরআনে এই বিধান সমন্বয় করার পরে আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, এগুলো তোমরা অতিক্রম করবে না৷’
শরীয়াহ আইনে নারীর ভাগ পুরুষের অর্ধেক হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে নারীরা সেই সম্পত্তিও পান না। বেশিরভাগ নারীই তাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন৷ যারা সম্পত্তি পান, তারা স্বাধীনভাবে ভোগ করতে কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না৷ যদি কখনো ভাইদের কাছ থেকে সম্পত্তির অধিকার চান, তাদের অনেক সময় একঘরে করে ফেলা হয়, নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়।
ঘটনা-১: জনাব করিম সাহেব বিশাল সম্পত্তির মালিক। তার ৫ পুত্র ও ৫ কন্যা সন্তান রয়েছে। তিনি মনে করেন পুত্ররাই বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে, মেয়েরা অন্যের বাড়ি চলে যাবে। মেয়েদের কোনো মূল্যই নেই, কারণ তারা সমাজ-সংসারে কোনো অবদান রাখতে পারবে না। তাই তিনি মৃত্যুর পূর্বেই মেয়েদের অগোচরে সমস্ত সম্পত্তি ছেলেদের নামে লিখে দেন। ঘটনা জানাজানি হলে, তিনি ফতোয়া দেন, ‘আমার সম্পত্তি আমি যাকে ইচ্ছা তাকে দেবো’। এ অবস্থায় বঞ্চিত কন্যাদের কিছুই করার থাকে না। পরবর্তী সময়ে ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয় এবং পরিবারে এ নিয়ে সমস্যা চলতেই থাকে।
ঘটনা-২: হামিদা বেগম অঢেল সম্পত্তির মালিক। ৫ সন্তানের জননী। তিনি যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তার এক পুত্র বোনদের অবর্তমানে তার গলায় দা-বটি ধরে তাদের প্রাপ্য অংশ নিজের নামে লিখিয়ে নেয় এবং পরবর্তী সময়ে তাদের হুমকির মুখে রাখে। বোনেরা বিষয়টি জানলে পরে এ ব্যপারে জানতে চাইলে হামিদা বেগম কথা বলতে নারাজ হন। কারণ তিনি তার ছেলের ভয়ে ভীত। অন্য ছেলেরা নিজেদের ভাগ বুঝে নিয়ে চুপচাপ থাকে। এ ক্ষেত্রেও তার কন্যাদের কিছুই করার থাকে না। এজন্য পরবর্তী সময়ে তাদের পারিবারিক জীবনে বহু ভোগান্তি পোহাতে হয়।
প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজকে এমন বহু ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শরীয়াহ ও রাষ্ট্রীয় আইন থাকা সত্ত্বেও এসব সমস্যার নিরসন হচ্ছে না। ইসলামে সুনির্দিষ্ট ভাবে সম্পদ বন্টনের বিধান উল্লেখিত হয়েছে। ধর্মে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই লোভের বশবর্তী হয়ে বিধানকে অস্বীকার করছেন; কারণ তাদের যুক্তিতে বিচার পৃথিবীতে হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো তাহলে রাষ্ট্রের আইন যে অমান্য করলেন তার বিচার তো হবেই!
কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর দায় এড়িয়ে তার অধিকার হরণ করার মতো ঘটনা এ সমাজে অহরহ ঘটছে। সম্পদ যেন নিজ গোত্রের বাইরে না যায়, সে জন্য দেখা যায় পিতা কন্যার অংশ মৃত্যুর আগেই পুত্রদের দলিল করে দিচ্ছেন। কখনোবা লোভী পুত্রেরা পিতা-মাতাকে জোর-জবরদস্তি করে লিখে নিচ্ছেন বোনদের অংশ। দলিল হয়ে যাওয়ার পর বঞ্চিত কন্যা সন্তানদের আর কিছুই করার থাকছে না। আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ থাকলেও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এবং লোকলজ্জার ভয়ে প্রায় সবাই হাল ছেড়ে দেন। মেয়েদের প্রাপ্য অংশ যেন ছেলেদের অংশের সঙ্গে জুড়ে না যায়, তার নিশ্চিয়তা দিতে হবে।
ইসলামের মীরাসের বিধি-বিধান এবং অসিয়্যত ও ওয়াকফের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। এসব বিধান ও মাসায়েলের ব্যাপক চর্চা হওয়া উচিত। যারা ইসলামের খেদমত করেন, যারা খতীব, মুবাল্লিগ, মুআল্লিমের দায়িত্ব পালন করেন- তাদের দায়িত্ব এসব বিষয়ের মাসআলা মুসলিম জনসাধারণের কাছে তুলে ধরা। মুসলমানদের মনে রাখার বিষয়, মীরাস, ওয়াকফ ও অসিয়্যতের বিধি-বিধান তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এসবই ইসলামের সৌন্দর্য। সারা দুনিয়ায় উত্তরাধিকার ও ‘উইল’ নিয়ে বহু সাংঘর্ষিক ও ভারসাম্যহীন বিধান ছিল, ইসলাম এসে এ বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম বিধান দিয়েছে। সেই বিধান সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ও সে অনুযায়ী চর্চা করা প্রত্যেক মুসলমানেরই কর্তব্য।
প্রাপ্য অধিকার পেতে রাষ্ট্রীয় আইন কার্যকর করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার অবসান ঘটাতে হবে। ভাইদের দ্বারা হরণকৃত অংশ যেন উদ্ধার করা যায়, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে প্রশাসনকে বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। গ্রাম্য পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণকে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রতিটি নারী যেন তার প্রাপ্য অধিকার বুঝে পান সে জন্য কঠোর আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্বায়নের এই যুগে যেকোনা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন অত্যাবশ্যক। আর এই লক্ষ্য পূরণে দরকার তাদের সব মৌলিক, নাগরিক ও মানবাধিকারের সংরক্ষণ। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য সম্পত্তির ভোগদখল ও বিনিময়ে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা/মাহি