সংস্কারের উদ্যোগ নেই মুঘল বিজয়ের স্মারক ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের’
রেজাউল করিম, চট্টগ্রাম || রাইজিংবিডি.কম
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ
বিশ্বে গর্ব করার মতো বাংলাদেশের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ স্থাপত্যকলা। শিল্পের এই মাধ্যমে কোনো অংশে কম ছিল না এই অঞ্চল। বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভ্রমণচারী ও মননশীল মানুষকে, তার মধ্যে অন্যতম দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। এমন মসজিদগুলোর অন্যতম চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।
১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে চট্টগ্রাম বিজয়ের পর প্রাদেশিক শাসক শায়েস্তা খাঁ’র ছেলে উমেদ খাঁ প্রথম চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লায় প্রবেশ করেন। এরপর ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামে নির্মাণ করেছিলেন নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর সুবিশাল একটি মসজিদ। পরে যার নামকরণ করা হয় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ হিসেবে।
প্রায় ৩৫০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ এখন জরাজীণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সংস্কারের অভাবে মসজিদের একটি ফ্লোরে নামাজ আদায়ও বন্ধ রয়েছে ১০ বছর ধরে। বৃষ্টি হলেই দেওয়াল বেয়ে পানি প্রবেশ করে মসজিদের ভেতরে। বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত এই মসজিদটি ১৯৯০ সালের পর আর কোনো ধরনের উন্নয়ন বা সংস্কার করা হয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে মসজিদের দোতলায় নামাজ আদায়
মসজিদ সংস্কারের জন্য কুয়েত সরকারের দেওয়া অনুদানের প্রথম কিস্তি ১০ লাখ ডলার পড়ে আছে ব্যাংকে। কিন্তু নানা প্রশাসনিক জটিলতায় মসজিদটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী থানা এলাকায় আনুমানিক ২ দশমিক ৪ একর জায়গার ওপর স্থাপিত আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের সময় মসজিদিটি জাতীয়করণ করা হয়। বর্তমানে এখানে ইমাম ও খতিবসহ ২৬ জন কর্মরত রয়েছেন। ১৯৯০ সালে সর্বশেষ মসজিদটির সংস্কার করা হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে মোট ২৩৫টি দোকান রয়েছে। মসজিদের নামানুসারে চট্টগ্রাম নগরীর ওই এলাকাটির নামও ‘আন্দরকিল্লা’। মসজিদটিতে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন ১০ হাজার মুসল্লি।
মসজিদটি নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের প্রায় প্রতিচ্ছবি হওয়ায় এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার জন্ম দেয়। মসজিদটি দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এটিকে পাথরের মসজিদ বা ‘জামে সঙ্গীন’ও বলা হয়ে থাকে। শুধু স্থাপত্য নিদর্শনেই নয়, শৈল্পিক দিক থেকেও এই মসজিদ উল্লেখযোগ্য। কারণ চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক হিসেবে শিলালিপি ভিত্তিক যেসব স্থাপনা আছে, সেগুলোর মধ্যে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের গায়ের শিলালিপি অন্যতম।
মসজিদের মূল ইমারতের প্রবেশপথে কালো পাথরের গায়ে খোদাইকৃত সাদা অক্ষরে লেখা ফার্সি লিপির বঙ্গানুবাদ হল- ‘হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় ২য় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি (১৭৬৬ সাল)। এই শিলালিপি থেকে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতার নামও পাওয়া যায়। এই মসজিদে পাওয়া সব শিলালিপির সঙ্গে সিরিয়ার ‘রাক্কা নগর’-এর স্থাপত্যকলার মিল রয়েছে।
মসজিদের প্রধান খতিব আনোয়ার হোসাইন তাহের আল জাবের আল মাদানি জানান, দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটি সংস্কার করা হচ্ছে না। জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় মসজিদের দ্বিতীয় তলার অবস্থা অনেকটাই নাজুক। গত ১০ বছর ধরে সেখানে নামাজ আদায় বন্ধ রয়েছে। এখন শুধুমাত্র মসজিদের মূল ভবনে নামাজ আদায় হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, মসজিদের ওজুখানা, টয়লেট সবগুলোরই বেহাল অবস্থা। ইসলামী ফাউন্ডেশন, ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং প্রত্নতত্ব বিভাগের সমন্বয়ে মসজিদটি সংস্কার কাজ শুরু প্রক্রিয়া চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় কোনো কাজ শুরু হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাংসদ সদস্য অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী জানান, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সংস্কার ও উন্নয়নে কুয়েত সরকার ২০১৭ সালে প্রথম কিস্তিতে ১০ লাখ ডলার অনুদান দেয়। পরবর্তীতে কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন ভিত্তিতে আরও অনুদান দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শুরু না হওয়ায় কুয়েত সরকারের সেই অনুদানও বন্ধ রয়েছে। এছাড়া প্রথম কিস্তিতে দেওয়া অনুদানের টাকাও ইসলামী ফাউন্ডেশনের ব্যাংকে অলস পড়ে আছে।
এদিকে রমজান মাসের প্রতিদিন ৩/৪ হাজার মানুষ এই মসজিদে ইফতার করেন। কয়েকজন বিত্তশালী মানুষের সহায়তায় বছরের পর বছর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে এই ইফতার আয়োজন চলে আসছে।
মাসুদ