‘যশোর ক্যান্টনমেন্টে ৬ মাস ধরে চলে অমানুষিক নির্যাতন’
বিএম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম
মুক্তিযোদ্ধা হালিমা পারভীন
বিএম ফারুক, যশোর : ১৯৭১ সাল। বয়স তখন ১৩ কি ১৪ বছর। দুরন্ত, চঞ্চল, কিশোরী মেয়ে হালিমা পারভীন। অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে সবেমাত্র উঠেছে। পাকবাহিনীর আগুনে পুড়ে যায় তার বাড়িসহ বই-খাতা। চোখের সামনে পাকবাহিনীর দেওয়া আগুনে বই-খাতা পুড়তে দেখে সহ্য করতে পারেননি হালিমা পারভীন। পাকবাহিনীর অত্যাচারের জবাব দিতে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখান তিনি। মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখানোর পর পাকবাহিনীর হাতে আটক হন। দীর্ঘ ৬ মাস যশোর ক্যান্টনমেন্টে তার ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। হালিমা পারভীন তার স্মৃতিতে থাকা মুক্তিযুদ্ধের সেই কাহিনি বর্ণনা করেছেন রাইজিংবিডির কাছে।
হালিমা পারভীন জানান, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ইন্দ্রা গ্রামে হামলা চালায় হানাদাররা। তারা গ্রামের বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। সেই আগুনে ভস্মীভূত হয় তার বাড়িঘর, ছাই হয়ে যায় গোলার ধান আর ঘরের সব আসবাব। জীবন বাঁচাতে মা সন্তানদের নিয়ে পাশে বাপের বাড়ি মালঞ্চি গ্রামে আশ্রয় নেন। ওই সময় হালিমা পারভীনের মামা সিদ্দিক হোসেন আগেই যুদ্ধে নাম লেখান। তিনি গ্রামের যুবকদের ডেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান। যুবকরা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে থাকে। প্রায়ই রাতে তারা সিদ্দিক মামার বাড়িতে জড়ো হতেন এবং যুদ্ধ নিয়ে কথা বলতেন। পাশে দাঁড়িয়ে হালিমা সেসব কথা শুনতেন।
হালিমা পারভীন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন যুদ্ধে যাওয়ার। একপর্যায়ে বাড়ির পাশের আমবাগানে এলাকার যুবকদের নিয়ে মামা সিদ্দিক যুদ্ধের মহড়া শুরু করেন। খবর পেয়ে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে নড়াইল থেকে লে. মতিউর রহমান মালঞ্চি গ্রামে আসেন। তিনি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্ব নিয়ে যুবকদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। মতিউর রহমান হালিমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। হালিমা মতিউর রহমানের সহায়তায় এই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। তার দেখাদেখি এলাকার মেয়ে ফাতেমা ও রোকেয়ারা ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করেন। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে লে. মতিউরের নেতৃত্বে বাঁশের লাঠি নিয়ে মালঞ্চি ক্যাম্পের যোদ্ধারা মে মাসের প্রথম দিকে বাঘারপাড়া থানা লুট করেন। থানার অস্ত্রাগার ভেঙে সব অস্ত্র ছিনিয়ে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। হালিমাও এই থানা লুটে অংশ নেন। তারা এই থানা থেকে ১৬টি রাইফেল ও কয়েক শ রাউন্ড গুলি লুট করেন। লুট করা অস্ত্র নিয়ে তারা সিদ্দিক মামার বাড়িতে ক্যাম্প গড়ে তোলেন। আনসার কমান্ডার কাওসার মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল চালানো শেখান। এরপর হালিমার জীবনের পটপরিবর্তন হয়ে যায়। সাহস করে হাত রাখেন রাইফেলের ট্রিগারে। হালিমার সঙ্গে ইন্দ্রা গ্রামের রোকেয়া আর মালঞ্চি গ্রামের ফাতেমাও যোগ দেন। এই তিন কিশোরীর শত্রুবধের কৌশল দেখে মুগ্ধ হন সবাই। একপর্যায়ে বাঘারপাড়ায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই হয়। সেই লড়াইয়ে সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে মালঞ্চি ক্যাম্পের যোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। হালিমাও সেই যুদ্ধের একজন অগ্র সৈনিক। এই যুদ্ধে সহযোদ্ধা রতন, সামছুর রহমান, বজলুর রহমান শহীদ হন। পিছু হটে যান মুক্তিযোদ্ধারা। রক্তের বদলা নিতে ফের প্রস্তুতি। তিন দিন পর শক্তি সঞ্চয় করে যখন মালঞ্চি ক্যাম্পের যোদ্ধারা প্রস্তুত ঠিক সেই মুহূর্তে ভোরবেলা পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা মালঞ্চি ক্যাম্পে হানা দেয়। শুরু হয় তুমুল লড়াই। এ লড়াইয়ে গোলাম সরোয়ার গুলিবিদ্ধ হন। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা রণকৌশল হিসেবে কিছুটা পিছু হটে পার্শ্ববর্তী শেখের বাতান গ্রামে আশ্রয় নেন। কিন্তু এ অবস্থানেও হানাদার বাহিনী আক্রমণ করলে শুরু হয় তুমুল লড়াই। একপর্যায়ে ফের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে পার্শ্ববর্তী শ্রীরামপুর স্কুলে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধের ২০-২৫ দিন পর পাকবাহিনী তাদের দেশীয় দোসরদের সহায়তায় ফের শ্রীরামপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। হালিমা এই যুদ্ধে একজন গেরিলা সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এক হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল অন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে তিনি শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই যুদ্ধে বাঘারপাড়ার রাজাকার কমান্ডার জয়নাল আবেদিন গুলিবিদ্ধ হন। শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা আফজাল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হয়।
শ্রীরামপুরের ভয়াবহ যুদ্ধের পর হালিমার সহযোদ্ধা দুই ভাই হাসান আলী ও হোসেন আলী সোলাইমান, অয়েন উদ্দিন, আনসার কমান্ডার প্রশিক্ষক কাওসার আলীসহ আরো অনেকে যুদ্ধের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যান। হালিমা, রোকেয়া, ফাতেমা, কোরবান আলী, সোহরাব, সিদ্দিক হোসেন, রজবসহ আরো অনেকে এলাকায় থেকে নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। রাতে খবর সংগ্রহ করে রণকৌশল নির্ধারণই ছিল তার প্রধান কাজ। একদিন হানাদার বাহিনী তাদের অবস্থান ঘিরে ফেলে। এ সময় বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গেলেও বাঁশের লাঠি আর রাইফেলের বাঁট দিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করতে থাকেন হালিমা, রোকেয়া, ফাতেমা, কোরবান, সোহরাবসহ আরো কয়েকজন। কিন্তু একপর্যায়ে তারা শত্রুর কাছে পরাস্ত হন। ধরা পড়েন তারা। এরপর হাত, পা আর চোখ বেঁধে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে তাদের নিয়ে যায়। এই ক্যাম্পে হালিমার ফুফাতো ভাই কোরবান আর সহযোদ্ধা সোহরাবকে হত্যা করা হয়। আর হালিমাসহ বাকিদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। একপর্যায়ে হালিমা, রোকেয়া আর ফাতেমা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে হালিমা বললেন, ‘সেখানে ৬ মাস আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরক্ষণে ভেবেছি যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করছি সেই দেশ আর দেশের পতাকা না দেখে মরতে পারি না। তাদের সব নির্যাতন সহ্য করেছি নীরবে।’
তিনি বলেন, ৬ ডিসেম্বর যশোর শত্রুমুক্ত হলে মুক্তিবাহিনী আর জনতা যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে হালিমা, রোকেয়া আর ফাতেমাসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্ত করে।
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হালিমা পারভীন বর্তমানে যশোর শহরের মুড়লী মোড়ে একটি ঘরে বসবাস করছেন।
রাইজিংবিডি/যশোর/১৭ মার্চ ২০১৬/দিলারা/ এএন
রাইজিংবিডি.কম