ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১০ম পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৫, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৯:৪৬, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ১০ম পর্ব

মা তাণ্ডব শুরু করে দিলো। বিরক্ত, মর্মাহত রাগে মুখ নীল। ‘এই শেষবার বলে দিলাম মহল্লার পোলাপানের সঙ্গে তোমার ঘোরাঘুরি! ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রীর এই দশা! আর শোনো, তোমার পেছনে আমরা পয়সা খরচ করি!’ 

তার হঠাৎ যেন মনে হলো আমাকে একটা পথ বেছে নিতে হবে। ‘তোমার কি স্কুলে কোন বন্ধু বান্ধব নাই? তুমি বরং তাদের সাথে খেলো!’ তো আমার মা যথার্থই দোষী, সে আমাকে বেছে নিতে বাধ্য করেছে। সে ভয় পাচ্ছিলো, আমি হয়তো স্কুলে আর ভালো করবো না, হয়তো মনেটের মতো হয়ে যাবো, ফূর্তিবাজ, দায়হীন... সে মনে করতো আমাকে ঘরে রাখলে এমনই ঘটতো, আমি এমন কিছু একটা হয়ে যাবো যেটা ‘ভয়াবহ’। লোকে তখন তাকেই দোষ দেবে... এ যেন তারই কর্ম। যে কোনভাবেই, এটা চলতে দেয়া যায় না, মনেট আর বাকীরা তো স্থানীয় স্কুলে পড়তো, আমার মায়ের মগজে কেবল এই জিনিসটাই খেলতো। পরের বছর ছিলো প্রথম পবিত্র কমিউনিয়ন, বেদী থেকে ফেরার পর, আমি সাবধান ছিলাম মনেটের দিকে না এগুতো। আমি প্রথম সারিতে বসেছিলাম, কারণ আমি ক্লাসে প্রথম, কারণ আমি প্রশ্নোত্তরে ধর্ম শিক্ষা ‘ক্যাটেচিজম’ পরীক্ষাতেও প্রথম হয়েছিলাম। আমি একবারও পেছন ফিরে তাকাইনি। আমি চাইনি অন্যেরা জেনে যাক যে আমি মনেটকে চিনি। আমি তাকালেই বাকীরা ঠিক বুঝে যেতো। যদিও সেটা ছিল মে মাস, আরও একটা খরগোশের চামড়ার কোট পরেছিল, দেখে মনে হচ্ছিল ও বড় হয়ে গেছে আর তার ঢেউ খেলানো চুল শক্ত করে বাঁধা। 

সব রসুনের এক কোয়া, শিক্ষক সব সময় এমনই বলতো। আমার পা প্রার্থনার চৌকিতে, পাদ্রীর মুখোমুখি আর সে তখন কিচিরমিচির করছে আর আমাকে উত্তর দিতে বলছে। আমি তো ভালো করেই জানতাম আমার ভেতরে মনেট হওয়ার কোন ইচ্ছা নাই, ওকে তো আমার খুবই সাধারণ, জবুথবু আর আকর্ষণহীন লাগে। এলাকার ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা করার আর কোনো ইচ্ছাও আমার নাই। কিন্তু আমি স্কুলের বন্ধুদেরও বাড়িতে ডাকিনি কখনো। ডাকতে পারিনি। ওরা এখনও বেমক্কা, বিদ্রূপ করে কথা বলে, আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুযোগ পেলেই, ‘কালকে আমরা তোমাদের দোকান দেখছি!’ কিংবা বলে, ‘তুমি নিশ্চয়ই প্রচুর মিষ্টি পাও?’ সবচেয়ে বিশ্রি সময়টা হলো যখন ওদের কেউ লজেন্স কিনতে আসে, ওরা জিজ্ঞাসা করে- আমি আছি কি না। আমার মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, ‘নিনিস! তোমার ছোট্ট বন্ধুরা এখানে এসেছে! আমি সিঁড়িঘরের উপরে লুকাই আর ভাণ করি যে আমি সেখানে নেই। তারা ভালো করে চারপাশটা দেখে, অন্যদের এটা প্রসঙ্গে বলে, লেস্যু তেমন কোনো ভালো জায়গা না, পুরুষরা পান করছে, পুরনো ধাঁচের দোকান, মোটেও সমবায় দোকানগুলোর মতো নয়। আমি বরং মরে যাবো কিন্তু ওদের ঘরে আসতে বলবো না। আমার মা বুঝতে চাইতো না, সে ভাবতো আমি বুঝি অন্যদের মতোই, আমরা বোধহয় স্কুলে সবাই এক রকম। সে সবসময় বলতো, ‘তুমি ওদের মতোই ভালো’, যখন আমি লাজুক হয়ে থাকতাম। তার বরং চুপ থাকাই ভালো হতো, আমি তো জানি বিপরীত কথাটাই সত্য। সেই সময় থেকেই আমার জীবনের একমাত্র গণনার উপযুক্ত জিনিস হলো বই আর স্কুল, আমি বাকী সব কিছুকেই আমার মন থেকে সরিয়ে দিয়েছি।

মনেট আমার অনেক পেছনে ছিল। প্রথম সারির শেষ মাথায় আমার প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন, ছোটখাটো আর লাল মুখ, উৎসাহ দেবার মতো করে হাসছেন। ‘যদি তুমি বাইরে যাওয়ার কথা ভেবে পাদ্রী বয়ান মিস করো তবে সেটা হবে সাংঘাতিক পাপ।’ প্রধান শিক্ষিকার দিকে একটা দ্রুত চাহনি দেই: সে গর্বিতভাবে মাথা ঝাকায়, আমার ক্যাটেকিজম পুরস্কার ঠিকঠাক আমারই প্রাপ্য। আমি আশাকরি যে মনেট শুনছিল, তিনি শুনে দেখছিলেন যে আমি সব মুখস্থ রেখেছি কিনা। এমন কিছুই নাই যা আমি ঠিক ধরতে পারছি না। গোলাপী আর সবুজ চেসিবল, হলি কমিউনিয়নের আগেই পুদিনার ফোঁটা চুষে খাওয়া, এটা ইচ্ছাকৃত হলে তা সাংঘাতিক পাপ, অনিচ্ছাকৃত করলে লঘু পাপ, জিভে আগুন, জ্ঞান, বিজ্ঞান, উপদেশ, আমি সব কিছুকেই ভেতরে নিয়েছি, আমি উত্তর জানি, এটা কি পাপ নাকি পাপ না, না, পাপ নয়। এর জন্য প্রয়োজন যথার্থ ও সূক্ষ্ম বিচারবোধ। আমার চারপাশের সবকিছু দুটো ভাগে বিভক্ত, একপাশে খারাপ, অন্যপাশে ভালো, তা নির্ধারিত করেছে পাদ্রীরা। কেবল আমি এখনও পুরনো অনির্ধারিত এক পাপ বহন করি, সাংঘাতিকও না, লঘুও না, কারণ এটা বলার মতো না, এটা পচা, এটা কোরো না ধাঁচের সব পাপ, মিষ্টি চুরি করা, শ্রমিকের টিনের কৌটার তলা থেকে ক্যাসুলে চেছে খাওয়া, স্কুলে দিবাস্বপ্ন দেখা আর সর্বোপরি, আমার পিতা-মাতা আর জীর্ণ দোকানদারদের পুরো পৃথিবী।

বিশাল সেই দিন এলো আর চলেও গেলো। আমিই একমাত্র লোক না যে প্রথম পবিত্র কমিউনিয়ন ভালো মতে করেছে, আমি আমার ক্যাটেকিজমকে জানতাম, পাদ্রীটা তরুণ ছিল, কিন্তু আমার কাছে এসব কিছুই ছিল প্রহসন। মাথার সঙ্গে মাথা লাগানো, আমি খুব একটা সাধু ভঙ্গি করার চেষ্টা করলাম। মনেট নিশ্চয়ই পেছনের সারিতে বসে দাঁত কেলাচ্ছে। হাতগুলো... নিশ্চয়ই কোনো ভেজা কিছুতে, গন্ধ শুঁকে দেখার আগ পর্যন্ত আমি ভেবেছিলাম সেটা ছিল প্রস্রাব। আমি নিরুপায়, যতোই আমি এটা ভুলতে চাইছিলাম, ততোই আমি তার কথা ভাবছিলাম। আমাদের মতো পাপীদের জন্য প্রার্থনা করো, আমার জন্য প্রার্থনা করো... আমি ভেবেছিলাম আমি যথার্থই একটা সুন্দর পোশাক আছে, আমার মা বলেছিল এটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু অন্য মেয়েদের পোশাকের তুলনায় সেটা কিছুই ছিল না। আমার মাথার উপরের ঘোমটার মতো আবরণ আমার কোকড়া চুলগুলোকে চ্যাপ্টা করে দিচ্ছিল। আমাকে ঠিকঠাক দেখাচ্ছিল না। প্রধান শিক্ষিকা অন্য দুজনকে বলছিল তাদের কী সুন্দর লাগছে! তারা নিজেদের গাড়িতে করে এসেছে। আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম যদি সে আমার পরিবার দেখে ফেলে। সে নিশ্চয়ই গর্ব করার মতো কিছু না। 

আমার চাচা আর চাচী দেরীতে পৌঁছাল, তাদের কাপড়চোপড় পরতেই দেরি হলো, তারা তো এসব পোশাক পরে অভ্যস্ত না। যাওয়ার পথে আমার আশেপাশের মেয়েরা ছবি তুলছিল আর আমি সেখান থেকে সরে যাচ্ছিলাম। পরিবারের নারী সদস্যরা আমাকে একজন ফটোগ্রাফারের সামনে নিয়ে গেল, তবে লোকটা তখন লায়ন ডি’য়র-এ পান করতে গিয়েছিল। আমরা পায়ে হেঁটেই রু ক্লোপার্টে গেলাম। ক্যাফেতে টেবিল সাজানো হলো। সেখানে স্যামন মাছ, মুরগির মাংস, স্তরে সাজানো কেক ছিল। খাওয়ার মাঝখানে, আমার কাজিনদের সঙ্গে আঙিনায় খেলাধুলা করেছিলাম। এর মাঝে আমি আবার খেয়াল করতে গিয়েছিলাম যে আমার সাদা পেটিকোটে কোন লাল দাগ পড়েছে কিনা। কেবল আমি যদি সেই একই দিনে এমনটা শুরু করতে পারতাম! তবুও আরেকটা নৈরাশ্য। আমি কল্পনা করছিলাম খাওয়ার পরে আড্ডা হবে ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোতে কিংবা সুঁজে রেস্তোরাঁয় সাপ্তাহিক শিশুদের পার্টিতে যেমন হয়। যেমন আমরা পেয়ে গিয়েছি ক্যাটারিং সার্ভিস দেয়ার লোক, হাতে লেখা মেন্যু আর টেবিলে সাজানো ফুল, তো আমি ভেবেছিলাম এটা একটা ফিটফাট অভ্যর্থনা আসর হবে। অর্ধেকটা দিন পেরিয়ে গেলো প্রায় আর আমি দেখলাম সে রকম কিছুই ঘটলো না। খাবার পরিবেশ করতে অনেক দেরি হলো। আমার মা সবার চেয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছিল। পাছার কাছে তার স্কার্ট ছিঁড়ে যাওয়ার মতো টানটান, কিন্তু সে তা খেয়ালই করলো না। 

আমার কাজিনরা আমাকে মনেটের কথাই মনে করাচ্ছিল, কারণ ওরা নোংরা রসিকতা, অসভ্য গল্প করছিল, একটা জার থেকে সবগুলো ইরেজার তারা বের করে ফেলেছিল, আমরা সরিষার সস তোলার চামচ দিয়ে মারামারি শুরু করলাম আর যথাবিহিত আমার জামার হাতায় বিরাট এক হলুদ দাগ লেগে গেল। সন্ধ্যার প্রার্থনার সময় প্রচুর উঁচু স্বরে গান হচ্ছিল, আমি আমার দাগঅলা জামার হাতা লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, প্রধান শিক্ষিকা ঠিকই তা দেখেছিল। আমি আশা করছিলাম আমার চাচারা যেন না-আসে, নিশ্চয়ই তারা পর্যাপ্ত মাতাল থাকবে। আমি গান গাওয়া বন্ধ করে দেই, আমার মনে হতে থাকে আমি যেন একটা হলুদ হ্রদের তলায় ডুবে যাচ্ছি, আলো, মোমবাতি, মন্ত্রপাঠ সব যেন স্বর্গ পানে ভেসে যাচ্ছে, আমি একটা টাইলসের মেঝেতে বসে আছি, দীর্ঘ অপেক্ষায় আছি দিনটি ফুরানো, ডেনিস লেস্যু, ক্যাটেকিজমের শীর্ষ স্থান অধিকারী, অন্যদের চেয়ে উত্তমতর, একজন নিখাঁদ পবিত্র কমিউনিয়নের উদাহরণ, ফুল, উপহার, আমার গরীবি পোশাক যা এখন নোংরাও। ওরা খাওয়া দাওয়া করেছে, চেচিয়ে গাইছে ‘লা ক্রেডো দ্যু পায়সান’ গানখানি আর এই সন্ধ্যায় এইটা সবচেয়ে পচা ছিল। 

এটা আমার দিন ছিল, আমার জন্য হলেও ওদের উচিত ছিল আরো শালীন আচরণ করা, এমন ভাব তারা করতেই পারতো যে তারা বড় স্টোরকিপার, ধনী পরিবার, এক কোণায় বেমানান, আনাড়ি, এলোপাথারি লোকের মতো দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে ভালো কিছু করতে পারতো তারা। ওদের কারণেই যখন আমন্ত্রণকর্তারা আমার প্লেটের দিকে নজর দিলো আমি কোনো কিছুই অনুভব করিনি, আমি খুব অল্প খাবারই নিয়েছি, এটা আমার তো দোষ নয়, এটা বদলাতে হতো, আমার পিতা-মাতাকে অন্যদের মতো হতে দাও... আমিই কেন, জেন বা রোসালিন নয় কেন? জেনের মা বাছাই করা পোশাকগুলো নেয়, সে তরুণ এবং সুন্দরী! আমি জানি, মনেট এসব পাত্তা দেয় না, ওর বিবেচনায় ওরা দেখানেপনা করছে। কিন্তু আমি মনেটের মতো নই। প্রথম কারণ হলো আমি ভালো নাম্বার পাই সদা, আমি আগামী বছর ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠবো, এখনও প্রাইভেট স্কুলেই পড়ছি। ও প্রাইমারি স্কুলের সার্টিফিকেট নেবে, তারপর টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কাজ শুরু করবে। আমি এই অন্যায় নিয়ে কাঁদতে পারি। ঈশ্বর কেন এমন বিবেধ সৃষ্টি করেন... আমার মোটেও উচিত নয় পবিত্র কমিউনিয়ন নিয়ে আলোড়িত হওয়া, এটা স্রেফ সাধারণ যে কোনো দিনের চেয়ে দশগুণ বিশ্রি, আমার পরিবার আমার প্রধাণ শিক্ষিকার বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টির সামনে উন্মোচিত। ঠিক যেমন তারা এতোটা নিকবর্তী হয়নি কখনো, ওরা নিশ্চয়ই ভেবেছে আমার পরিবার এইসব জায়গা থেকে দূরেই থাকে। 

এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে তাদের খুব স্থুল মনে হয়েছে... আর আমার ঋতুমতী হওয়ার স্বপ্ন তখনও শুরু হয়নি, এমনকি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো একটা উজ্জ্বল ছোট্ট লাল দাগও নেই জামায়। সেই মুহূর্তে আমি ক্যাটেচিসম ক্লাসে সবার নিচে থাকতেও আপত্তি করতাম না যদি জেনের পোশাকের সঙ্গে আমার পোশাক, জেনের পরিবারের সাথে আমার পরিবারকে বদলাতে পারতাম।

একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছবির মতো মনে হয়। তুলনায়, গর্ভপাত ব্যাপারটাও যেন একটা পার্টির মতো... যখন তোমার বয়স দশ তখন সব কিছু এতো গুরুত্বপূর্ণ যে তুমি একগাদা কাজ করে ফেলো, এর সবগুলোই অদ্ভুত আর নতুন। তারপরও, সেই দিন সন্ধ্যায় আমার ভালো সময় কেটেছিলো খানিকটা, আমার সব অশ্লীল গল্পগুলো শুনেছিলাম, তোমার দম আটকে রাখো, তুমি যে হতবিহ্বল এমন বুঝতে দিও না, পাপ ব্যাপারটা ভুলে যাও আর আমার কাজিনেরা আর আমি সাটার বন্ধ করা দোকানটায় খেলেছিলাম। আমার সবচেয়ে বড় কাজিন দেখিয়েছিল তার ব্রেসিয়ারের তলায় কী আছে। হয়তো সেটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর সবচেয়ে সত্যিকার। আমি যেমন ভাবতাম ব্যাপারগুলো তেমন সহজ স্বচ্ছ ছিলো না। আজকের দিনে এসে আর ওইসব কাজিনদের সইতে পারি না। খতম আর নিজেকে পারিবারিক পথে দেখা, আহা, তোমার জন্য আমরা যতো আত্মত্যাগ করেছি, তোমার জন্য আমরা সব করেছি, সবকিছু, যাতে করে তুমি এগুতে পারো সামনে! এ ভাবেই বুঝি তুমি আমাদের ধন্যবাদ জানালে! তারা হয়তো মৃগীক্রান্ত হয়ে যাবে, যথাবিহিত পালিয়ে যাবে, খানকি, মাগী, ও ছেমরি কোনদিন আমাদের কথা শোনে, সে সবচেয়ে ভালো জানতো, বেশ্যা কোথাকার! এ সব না-জানানই তাদের জন্য ভালো। এটা আমাকে খুব ভাবায় যে আমি ওদের টাকা গর্ভপাতের জন্য খরচ করেছি, উচিত ছিলো আমার বৃত্তির টাকা দিয়ে এটা করা, কিন্তু সেটুকু তো যথেষ্ট ছিলো না। 

সবসময়ই একই ব্যাপার, আমি কখনো তাদের অবজ্ঞা করে বাদ দিতে পারিনি, অথচ তা চেয়েছি সবসময়। ওরা চায়নি আমি সামার ক্যাম্পে যাই, কিংবা হয়তো আমিই চাইনি। কী জানি, মনে পড়ে না। হয়তো আমি ওদের আঘাত করতে চাইনি। হয়তো সে সময় আমি ওদের এতো অপছন্দ করতাম না, আমি ওদের থেকে দূরে বড় হচ্ছিলাম, আমি ওদের সঙ্গে তেমন দেখা সাক্ষাৎ করিনি, কিন্তু আমি নিজেকে ওদের থেকে সরাতেও পারিনি অতোটা। আমার প্রথম কমিউনিয়নের সময়, যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে গেলাম, সেই পুরনো আজ অনুভূতি আমাকে কখনো সহজ হতে দেয়নি, কেবল আমার বাড়ির কাজ, রচনা, আঙিনার এক কোণায় বই পড়া, দিনের বেলা কম্বলের তলায় শুয়ে বই পড়া, যেদিন স্কুল থাকতো না, কিংবা সিঁড়ির উপরে লুকিয়ে থাকা। আমি সবার কথা শান্তভাবে শুনতাম, আমি ঝামেলা করার মতো বাচ্চা ছিলাম না, আমার মা সময় বলতো, ‘ও স্কুলে সব কিছুতেই ভালো, ও সত্যিই কোন ঝামেলা করে না...’। 

আমি আমার মন থেকে আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জিনিসপত্র শুষে নিতে শিখেছি। দোকান, ক্যাফে, ক্রেতারা এমনকি আমার বাবা-মাকেও সরিয়ে দিতে পারতাম কল্পনায়। আমি অনেক দূরে, যেমন তারা বলতো, বইয়ের মধ্যে, মগ্ন আমার বাড়ির কাজে। ‘এতো পড়লে তোমার মাথা ধরে না?’ এসব মন্তব্য আমাকে বিরক্ত করতো। আমি ক্রমে আরো এবং আরো যোগাযোগহীন হয়ে গেছি। তারপর তারা যা করতো তা থামালো, আমার দিকে সন্তুষজনক দৃষ্টি দিতে থাকলো, একটা স্নেহময় চাহনি, তারা নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকলো, এগুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো মানেই হয় না, ওরা কোনোদিন বুঝবেও না। ‘শিক্ষক কী বলে’ ‘তেমন কিছু না’ ‘ভালো, তুমি তাই করবে যা ওরা বলে, কেমন?’ আমি তাদেরকে মজার কিছু বলি কিন্তু তারা এর মধ্যে কৌতুকটাই খুঁজে পায় না। সব কিছুর প্রসঙ্গেই, চেষ্টার কোন বিকল্প নেই, আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতের ইংরেজি, ল্যাটিন, বীজনগণিত, রসায়ন পড়া শুরু করি। তারা আনন্দিত কিন্তু ওগুলো আদতে কি তা আমার কাছে শুনতে চায় না।

‘খুব ভালো। তুমি তোমার সেরাটাই করো, আমাদের এটাই চাওয়া, পরে তুমি আমাদের উপর কৃতজ্ঞ হবে।’ তারা মন্তব্য যোগ করে বলে যে আমি কতো ভাগ্যবতী আর তারা কতো ভালো। ‘যখন আমি তোমার বয়সে ছিলাম, আমি ভোর পাঁচটায় উঠতাম আর দঁড়ি বানানোর কারখানায় যেতাম। তোমাকে তো ক্রেতাদের মাঝে ওয়াইন পরিবেশনও করতে হয় না!’ ক্যাফে বা দোকান পার হওয়ার সময় নেহাত একটা শুভেচ্ছা জানানো ক্রেতাদের। ব্যাস। আমি দূরে সরে যাচ্ছিলাম... আমি অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। স্কুল, সেখানেই আমি দাঁড়িয়েছিলাম মেরুদণ্ড সোজা করে। অন্যরা আমাকে অপমান করা বন্ধ করেছে। ডেনিস লেস্যু, ওরা যতো দূর মনে করতে পারে ২৬ জনের ক্লাসের সেরা সে। আমি দুপুর একটার দিকে আবার স্কুলে ফিরে যেতে থাকলাম যখন আমার বাবা-মা রেডিও লুক্সেমার্গের জিন গ্রেন্ডমোগ-এর প্যাঁচাল শুনতো, যাতে করে আরো গালগল্প জানতে পারে। আমি স্কুলে ছুটে যেতাম দেড়টার ঘণ্টা বাজার আগে বোর্ডিংয়ের ছাত্রদের সঙ্গে গল্প করতে, আমি হেঁটে হেঁটে শহরের দিকে চলে যেতাম, দেখতাম নতুন নতুন দোকান তৈরি হতে। আমি যখন দৌড়ে বাড়ি ফিরতাম তখন আমি কখনোই হলুদ দালানটার দিকে তাকাতাম না, যেটাতে ‘লেুস্য’র ক্যাফে দোকান’ লেখা সাইনবোর্ড দেখা যেতো রাস্তার বাঁক থেকেই। আমি সোজা আত্মমগ্ন হয়ে দোকান পেরিয়ে ভেতরে চলে যেতাম আর ক্রেতারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমাকে দেখতো। আমি গিয়ে আমার মাখন রুটি খেতাম রান্না ঘরের কোণার টেবিলে বসে, যাওয়ার পথে কাপড় ইস্ত্রি করার স্ট্যান্ড, খবরের কাগজের স্তূপ কিংবা সেলাই করার বাক্স সরিয়ে এগুতাম। কিছু পুরনো লোক, সবসময়ই তারা একই রকম রয়ে গেছে, ফোর্চি যার ছিলো যক্ষা, ‘দীর্ঘস্থায়ীভাবে অচল’ লিভার সিরোসিসের রোগী, বুগো বোনহের, আমার দিকে খোলা দরজা থেকেই তাকিয়ে থাকতো। 

শূন্য চোখ, সিগারেটের মাথা, তারাই প্রথম লোক যাদের দিকে আমি শুভেচ্ছা জানানো বন্ধ করে দেই প্রথমে... আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বইয়ে সময় কাটাতাম, আমার বাড়ির কাজে। রাতের খাবারের আগ পর্যন্ত। সুনিুশ্চিত থাকতাম, যে আমি ঠিকঠাক সব জেনেছি, শব্দের জগতে দীর্ঘ পড়ে থাকার আনন্দ, ওদের বিশৃঙ্খল হতে দেখা, তারপর আবার একটা শব্দের কুঠুরিতে বন্দী করে ফেলার চেষ্টায় রত আমি। পরের পাঠের দিকে সব সময় তাকিয়ে থাকতাম, অনাবিষ্কৃত সাম্রাজ্য যেন তারা যেগুলোকে শিক্ষক অভিযান চালাবে পূর্বনির্ধারিত সময়ে। এই সময়ের মধ্যে এখনি যা কিছু শিখতে হবে এবং পরীক্ষার আগে... এখন আর চূড়ান্ত পরীক্ষা আগে যতো পড়া ভাবতেই মাথা ঘোরাতে শুরু করে... হয়তোবা এখন আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নাগাদ যা পড়তে হবে... ডেনিসের স্বপ্ন ছিল সমীকরণগুলো ওস্তাদের মতো আয়ত্ব করা, যখন আমি তিনজন অচেনা লোককেও টপকে গেছি, নিজেকে নিয়ে আমার স্বপ্ন হলো ভবিষ্যতে ব্যাগ ভর্তি করা বই, এমনকি দুই বগলের চিপাতেও বই, শেষ ক্লাসের ছাত্রীদের মতো ব্যতিব্যস্ত... আমি জানি, তখন আমি অনিবার্যভাবেই আলাদা হয়ে উঠবো। আমি একটা দূরত্ব থেকে সন্ধ্যাগুলোকে পছন্দ করতাম, দ্বিধাহীন কণ্ঠের কোলাহল, ডোমিনি খেলার ছকের শব্দ, বেসিনে গ্লাস পরিস্কারের টুংটাং আর ডোরবেলের মৃদ্যু ডিংডং। 

আর তারপর ছিলো রেডিও, ‘ডুরাট্য পরিবার’, তাদের শিশু তারকা ডপ, জেপি’র চুম্বন, ক্যাডামের গায়করা, তারা সবাই দিনগুলোকে, প্রহরগুলোকে রাঙিয়ে দিতো, যেমন জ্যামিতি জমিয়ে দিতো টাকা আর বিজ্ঞান তৈরি ছিলো বুধবারের জন্য। রাতের খাবার শুরু হতো নিস্তব্ধতা দিয়ে। আমার মা যে তিনটার সময় মেকআপ করেছিলো আবার, চুল আচড়ে ছিলো তাকে অপিরচ্ছন্ন আর ম্লান দেখায় নয়টায়। আমার বাবা খেতে খেতে তার ছোট্ট হিসাব-নিকাশ সারে, ‘মার্টন তিন গ্লাস গিলছে, ডাপন টাকা শোধ করছে। বোনহে কিছুই দেয় নাই, সে শনিবারে দেবে।’ আমি তাদের আলাপে, হিসবা নিকাশে মোটেও আগ্রহী নই, আমার মাথায় ঘুরছে কর্তা, প্রভু, শাসক, পুংলিঙ্গ, ‘বিড়ালটি টেবিলের উপরে’ এই সব শব্দ জটের পাশাপাশি শুনছি কিছু দেনা পাওনার আলাপ, শেষবেলার তেল বিতরণ করে যাওয়া, গুরুত্বহীন, বিবর্ণ। আমি যথাবিহিত শুনিই কেবল। ওই যে গেলো কালো ঘোটকী! ইতোমধ্যেই বিছানায় আমি, আমার নাক বইতে, স্লেভগার্ল কিংবা কুইন ব্রিজেট কামস অব এইজ, ট্রু কনফেশন এইসব বইতে... এইসব জায়গা থেকেই আমি আমার সংস্কৃতি আরোহণ করেছি, স্কুলের বাইরে, আমার মা আমাকে বই কিনে দিতো খবরের কাগজের দোকানে বইবিক্রেতার পরামর্শক্রমে। আমার বাবা উপরে আসতো, তার টাকার বাক্স নিয়ে, ক্যাশ রেজিস্টার তার বগলের তলায়। এমন শব্দ হতো যাতে মনে হতো সব কিছু ফেটে যাচ্ছে, ধুমধাম, ভাঙছে তার পায়ের তলায়, হাতের মোচড়ে, সিঁড়ি, দরজা, লাইটের সুইচ, বিছানা, সব। ‘শুভ রাত্রি, আমার ছোট্ট কন্যাটি!’ কিংবা ‘খুব ঘুমাও, রত্মা মা আমার’’ একটা টানা পার্টিশনের আড়াল থেকে সে বলতো, যেটাকে সদ্য ঘর থেকে আলাদা করার জন্য বসানো হয়েছে। আমি জানতাম, কেন এই বিভাজন, কিন্তু আমি ঠিকই তাদেরকে ওটা করতে শুনতাম, আর আমি বিছানার চাদরটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিতাম।

আমি ক্যাফের উপরে ঘুমাতে যেতাম, যেন সেটা একটা আবাসিক হোটেল। আমার বাবা-মা খেয়াল করেনি, আমি তাদের সঙ্গে প্রায় কথাই বলতাম না আর। আমি তাদের এড়িয়ে চলতাম... তারা আমার প্রতি ভালো, ‘তুমি যথেষ্ট খেয়েছো তো? তোমার কি কিছু লাগবে? নতুন কোন বই?’ আমার মা ভাবতো যা খুশি পড়াই আমার জন্য উত্তম। আরো মনে করতো আমি খুব ভালো একটা মেয়ে, কোন ভাব নাই, কোন বোকামিও নাই, বোধসম্পন্ন... তারা ক্রমে আমাকে কম থেকে কম দেখতে লাগলো। আমি সব সময় পড়ছি, কিংবা আলসেমি করে বেড়াচ্ছি, আমার শোবার ঘরে কিংবা রান্নাঘরে, কখনোই দোকানে বা ক্যাফেতে যাচ্ছি না। আমার মা আমার হয়ে অন্যদের কাছে ক্ষমা চায়, ‘বেচারির অনেক বাড়ির কাজ, ক্যাফের কাজে ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে না।’ কোনো কোনো ক্রেতা ভাবতো আমি বোধহয় সাহায্য করতে পারি: ‘এই যে খুকি একগ্লাস রেড ওয়াইন।’ আমি দ্রুত আসি, দ্বিধান্বিত: ‘আমার বাবা আসছেন!’ সে এটা মানতে পারতো না: ‘তা তুমি বাপু দুটো কামানোর জন্য কী করো!’ আমার বাবা আমার হয়ে উত্তর দিতো: ‘ওটার জন্য আমরা আছি এখানে, ওর দরকার নেই এখানে সাহায্য করার, ও স্কুলে যায়...’ তাদের পক্ষে এটা হজম করা কঠিন: ‘ও তা ওর বয়স কতো?’ তারা একটা অনুমান করার চেষ্টা করে আরো গুলায়: ‘সে কি একজন সেক্রেটারি হতে চায়?’ তারা এটাকে আলাদা করে উচ্চারণ করে- ‘সে-ক্রে-টা-রি’, আমার বাবা বলে, না, কিন্তু এটা বুঝতে তাদের সময় লাগে। আমি শুনতে থাকি বাবা কী করে এটার সমাধান করবে। ‘ও স্কুলে খুব ভালো করছে, আমরা ওর পড়া থামাবো না, উচিত হবে কি?’ সে এমন ভাবে বলতে চায় না যে আমাকে সে জোর করে পাঠাচ্ছো কিংবা এমনও নয় যে তার অনেক টাকা আছে... ‘যেহেতু ও পছন্দ করে এটা...’ আমি চুপ থাকি। ওরা নিশ্চয়ই স্কুলে ভালো করেনি। আমি ওদের মতো নই, আমি আলাদা। আমার তরফ থেকে ওদেরকে বলার কিছুই নাই। আমি কখনোই আর নিজেকে বলার সাহস রাখি না যে, অন্যকে সম্মান করো। কিন্তু তাতে কিছুর অদলবদল হবে না আর। আমি একটা মাগী। ‘তোমার বাবা মাকে সম্মান করো।’ 

সেটা তেমন বেশি কিছু নয়। সবচেয়ে বিশ্রি ব্যাপার ছিলো ওরা আমার প্রতি খারাপ ছিলো না, কিংবা কড়া ছিলো না। আমি এটা নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলিনি, কিন্তু স্কুলে, শহরে হাঁটতে হাঁটতে, পড়তে পড়তে, আমি তুলনা করতে শিখে গিয়েছিলাম। এমন লোক ছিলো যাদের চিনতে পারাও আনন্দের আবার অন্য রকম লোকও তো ছিলো। বারো বছর বয়স থেকে, আমার নিজের একটা তাপমান যন্ত্র ছিলো এসব মাপার। শ্রদ্ধেয় লোকদের গাড়ি থাকে একটা, একটা ব্রিফকেস, রেইনকোট, পরিষ্কার হাত তাদের। তারা ঠিক কথাটা বলে, যে কোনো সময়, যে কোনো জায়গাতেই। সশব্দে বলে বসে পোস্ট অফিসের লাইনে দাঁড়িয়ে, ‘তারা আমাদেরকে এতোক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা স্পর্ধা পায় কোথায়!’ যেখানে আমার বাবা কোন অভিযোগই করে না। এমনকি তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সবার পিছনে দাঁড় করিয়ে রাখলেও। কিন্তু তারা খুব চটপটে জবাব দিতো। তারা কখনো আমাদের ক্যাফেতে আসতো না। আমি শ্রদ্ধেয় নারীদের দেখে মুগ্ধ হতাম : তাদের নিজস্ব স্টাইল ছিলো, যেভাবে তারা চুল কাটতো, তাদের পোশাক, গয়নাগাটি, নম্র কণ্ঠ যা তারা কখনোই উঁচুতে তুলতো না। তারা কোণায় দাঁড়িয়ে গালগপ্পো করতো না। তারা শহরের কেন্দ্রে কেনাকাটা করতো, হাতের মধ্যে বড়ো ঝুড়ি নিয়ে। একটা সুনিশ্চিত স্বাচ্ছন্দ, এইটাই সেই শব্দ আর সুনিশ্চিতভাবেই স্বচ্ছ ও স্বাচ্ছন্দে ভরপুর তারা। বাকীরা সব আমাদের ক্রেতাদের মতো দেখতে : অভারঅলা পরা কামলা লোক, মাথায় ব্যারেট কিংবা ক্যাপ পরা, একটা গোঁফ। অসুস্থ বুড়ো লোক, সবকিছু ধুয়েমুছে গেছে, আকৃতিহীন যেন। এমনকি বিশেষ ভোজের দিন বিশেষ পোশাক পরলে, তুমি তাদের আলাদা করে চিনতে পারবে, কালো নখ, কাফবিহীন শার্টের হাতা, এমনকি যেভাবে তারা হাঁটে, হাতগুলো ঝুলে আছে, অনির্দিষ্ট, অনিশ্চিত নিজেদের ভেতরেই। তারা জানে না কেমন করে ঠিকঠাক কথা বলতে হয়। তারা চিৎকার করে। যে নারীরা কেনাকাটা করতে এসেছে, তারা স্লিপার পরা, তাদের তেলচিটচিটে শপিং ব্যাগ, সবগুলো দেখতে এক রকম, খুব মোটা কিংবা খুব চিকনা, কখনোই ঠিকঠাক আকারের নয়, নিমজ্জ্বিত বুক, হয় চ্যাপ্টা নয় কোমর পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে, বক্ষবাঁধুনি তাদের মাঝখানে গোলাগাল হয়ে আছে, থলথলে বাহু, তেল লেপা মাথা, ফাপানো চুল। 

এটা আমার কাছে কখনোই এমন মনে হয়নি টাকাই এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে, আমি ভাবতাম কেউ হয়তো জন্মেছেই পরিষ্কার বা নোংরা স্থানে, নিয়ম মতো কিংবা এলোমেলোভাবে। মাতলামি, কর্নড বিফের কৌটা, বাইরের ঘরের দিকে পেরেকে গাথা খবরের কাগজ, আমি ভেবেছিলাম, একজন হয়তো এমনটা চেয়েছে, এমন পছন্দ করেছে তাই এমনটাই হয়েছে। এটা আসলে তুমি যথেষ্ট চিন্তা করার সুযোগ না পেলে, যথেষ্ট পড়ালেখার সুযোগ না পেলে ধরতেই পারতে না, বিশেষত যখন একজন শিশু, সে হয়তো ভাবতেই পারে সবকিছুই পূর্ব নির্ধারিত। 

আমি আমার বাবা-মাকে এই দুই দলের কোনোটাতেই দাঁড় করাতে চাইনি। সত্যিই চাইনি। আমার মা মেকআপ দেয়, দোকানে তার কণ্ঠ উচ্চকিত, লোকে তার পরামর্শ চায় সচারাচর, বালতিতে কেউ লাথি দিলে তাকে ধরে আনে, যারা সামাল দিতে পারে না তাদেরকে ঠিক করতে আমার মায়ের সাহায্য নেয়। তারা অনেক ভালো দিক আছে। সে কায়দা করে কথা বলে না: ‘ওই সব আত্মগরিমায় ভোগা উন্নাসিকদের কথা আমার সঙ্গে বলো না। হেরিং মাছের গন্ধ তাদের নাজুক পেটকে পীড়িত করে!’ ফুটানি করা অহঙ্কারী মহিলাদের জন্য তার কাছে সময় ছিলো না, তারা তার পেছনে মুরগীর মতো ঠোঁট বেকিয়ে চলতো। ‘ওদের নিজেদের বাবারাই রাস্তায় ওদের চেনে না!’ আমার বাবাও ক্রেতাদের থেকে আলাদা ছিলেন, তিনি পানাহার করতেন না, সে সাত সকালে খাবারের বোঝা নিয়ে কাজে যেতো না, সবাই তাকে ‘বস’ বলতো আর বকেয়া বুঝে নেয়ার সময় সে ছিলো শ্রদ্ধা করার উপযুক্ত। ‘আমরা কামলা খাটি না, এটা আমরা তৈরি করেছি, এটা আমাদের নিজেদের ব্যবসা, নিজেরা তৈরি করেছি, একদম শূন্য থেকে তৈরি করেছি!’ 

আমি এর অর্ধেকটাই বিশ্বাস করেছিলাম। তারপর চোখ থেকে পর্দা সরে গেলো। আমি তাদেরকে নত হতে দেখতাম ‘গুরুত্বপূর্ণ’ লোকদের সামনে, আইনজীবি, চক্ষুবিশারদ তাদের সামনে ক্ষুদ্র। ওদের কেউ যদি কিছু বলতো, তারা চুপ হয়ে যেতো। তাদের ধারণাই ছিলো না এন মানুষদের সাথে কেমন করে কথা বলতে হয়, কখন দাঁড়াতে হয়, কখন বসতে হয়। যখন তারা আমার শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতো, তারা জানতো না কী বলা যায় উনাদেরকে। আমার বাবা সারাদিন যে শার্ট পরে থাকে সেটা পরেই ঘুমায়, শেভ করে সপ্তাহে তিনবার, তার আঙুলের নখ সবসময়ই ময়লা। আমার মা তার সারা গলায় পাউডার দিয়ে রাখে, বক্ষবন্ধনী পার হয়ে তার বেরুতে থাকে, কাপবোর্ড দরজার ওখানে এটা সেটা ধুতে ধুতে একদম পা বেয়ে তা নামতে থাকে... যখন সে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে, রাস্তায় কোনো চূড়ান্ত মৃত্যু পথযাত্রীকে দোয়া করতে আসে পাদ্রী কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মী যখন আসে, আমার মা খুব ফিটফাট গলায়, নম্র কথা বলতে চেষ্টা করে আর যেন পারলে তাদের পেছন চেটে দেয়। ‘বেচারা, ওরা আসলে সাধারণ ক্রেতা, তবে যথেষ্ট বিশ্বস্ত, কেবল খুচরো কিছু টাকা দেয়া বাকী আছে...’ সে ফিসফিস করে বলে। সে একেবারে খুশি করার জন্য নুয়ে পড়ে। ভীষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে যখন ফিটফাট পোশাক পরা কোন ক্রেতা আসে এবং তার টেবিলে চিনি কম থাকে। আত্মা-বিলোপ হয় তাদের, প্রতিটি শব্দ যেন ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বলে, ‘আমি আপনার জন্য কিছু মালাগা কিসমিস নিয়ে আসি, যদি চান।’ সেই ভালো ভদ্রমহিলা এদিক সেদিক অনিশ্চিতভাবে তাকায়, এমন আবর্জনা ধাচের স্থানে সে কেনাকাটা করতে অভ্যস্থ না, আর এদিকে আমার মা ডানা ঝাপটাতে থাকে পুরো দোকানের এদিকে সেদিকে এমুঠো কিসমিসে খোঁজে। ক্ষমা চাওয়ার সুরে বলে, ‘আমি দুঃখিত আমাদের এখানে কোন...’ আমাদের এখানে কখনোই কোন কিছু ছিলো না যা উঁচুদরের মানুষেরা চাইতে পারে। এটা উচ্চশ্রেণীর লোকদের মুদিখানা নয়, নেহাতই এক কোণার একটা দোকান। 

সত্যকে আরো বেশি লুকিয়ে রাখতে পারিনি। আমার বাবা মা তাদের ক্রেতাদের থেকে উত্তমতর ছিল। ‘ওরা আমাদের উপর নির্ভরশীল, ওদেরকে কেইবা বাকী দিবে?’ কিন্তু সব কিছুর পরও তারা ছোট্ট দোকানদার, জীবনকে চেঁছে নিচ্ছে, তলানি পর্যন্ত। আমি এটার মুখোমুখি হতে চাইনি। আমি একটা ছোট্ট বিকৃত শয়তান হওয়ার মতো যথেষ্ট খারাপ ছিলাম, আমার সহপাঠীদের মধ্যে বেমানান একটা পিণ্ড যার রয়েছে গোপনীয়তা আর ওরা তো দায়হীন এবং নির্দোষ... এতো কিছুর পরই কি আমি আমার বাবা মাকে অশ্রদ্ধা দেখাতাম? সব পাপ বইয়ে আছে। কেউ তার বাবা মার ব্যাপারে বাজে নয়। কেবল আমি। রেডিওতে সেই যে গান, ‘আমি চুরি করিনি, আমি খুন করিনি, তবে আমার মা যা বলেছিলো আমি তো তা শুনিনি’ এটাই হলাম আমি। আমি তো একটা বাজে সমাপ্তিতেই যাবো। আর এই গান ওরা গায় পারিবারিক ভোজ সভার পরে, যেখানে সবাই শোনে আর রূমালে নাক-মুখ মোছে, একজন বালককে নিয়ে এই গান যে প্রতি রবিবার তার মায়ের জন্য সাদা গোলাপ নিয়ে আসে। এটা আমাকে কাঁদাতে চায়, কিন্তু কারণটা ওদের মতো ন। আমি কখনো ওদের মতো নই। মাগী। মাঝেমাঝে আমার মনে হতো আমি এতিম হলাম না কেন। কিংবা আমি কখনো শপথ নিতে চাইতাম, আমি কখনোই আর তাদের সমালোচনা করবো না, আমি এমন ভাব করবো যে বাড়িতে আমার ভালো লাগে সব। স্কুলের শিক্ষকরা সন্তানের ভালোবাসাকে খুব গভীরভাবে দেখে : ‘এই যে প্রিয় ডেনিস,’ তারা আমার দুকাঁধে হাত রেখে বলে, ‘আশা করি তুমি তোমার পিতা মাতার প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ? তারা তোমার জন্য অনেক আত্মত্যাগ করছে! তারা তোমার লেখাপড়ার খরচ দিচ্ছে...’ ওদের কথা শুনে মনে হতো, এটা যেন সব সময় আমার মনে থাকা উচিত। 

আমরা তিন মাস আগে থেকেই মা দিবসের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি, কে সবচেয়ে ভালো মাদুর বুনতে পারে, কে সবচেয়ে সুন্দর গয়নার বাক্স বানাতে পারে সেটার চেষ্টা চলতে থাকে। কী ভালো মেয়ে, ও নিশ্চয়ই তার আম্মুকে অনেক ভালোবাসে! আমার এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই, আমার মা যাই বানাই এক কোণায় ফেলে রাখবে, সে এটার কথা আর বলবেও না দ্বিতীয়বার, সে মনে করে না আমাদের এ সবে সময় নষ্ট করা উচিত। যে শিক্ষিকা আমাকে বলেছে বাবা মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে, ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে, সে আমার বাড়িতে গিয়ে একদিনও টিকতে পারতো না, তারা ভয় পেয়ে যায়, কর্কশ স্বরে চেচালে, যদি তুমি জোরে হাঁচি দাও, নিজেকে চুলকাও কিংবা শব্দ হারিয়ে ফেলো তাহলে তারা ঘাবড়ে যায়। আর ওরা কি না আমাকে ভালো মেয়ে হতে বলে... একমাত্র উপায় হলো হলো নিজের চোখ বন্ধ রাখা, এমন ভাব করা যেন আমি কোন একটা হোটেলে অতিথি হিসেবে আছি আর দিনগুলো নেহাত পার করছি। সর্বোপরি, নোংরা, নিকৃষ্ট, চ্যাটচ্যাটে বস্তু থেকে দূরে থাকা।  (চলবে)

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৯ম পর্ব                           

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়