ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৯ম পর্ব

মুম রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৭, ৯ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৩:১৯, ৯ ডিসেম্বর ২০২২
নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৯ম পর্ব

তারপর প্রত্যেক টার্মে একটা করে পিটুনি আমি একসাথে সবাইকে দিতাম, স্বগৌরবে একা এবং আমার ডেস্কের সামনে গিজগিজ করতো বাকী সবাই প্রতিযোগিতার ফলাফল... শিক্ষক থামে, ‘প্রথম হয়েছে...’ ... ওরা সবাই থামে, তোমাকে বিস্মিত করতে... একটা আবেশ ছড়িয়ে পড়ে... মনোহর উত্তেজনা... এই তো এলো, আমার নাম পুরো ক্লাসে অনুরননিত হলো, শিক্ষকের জিহ্বা থেকে বেরিয়ে, প্রত্যেক ছাত্রের চাহনির উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াতো লাগলো। এই আমার নাম... ওদের সবার উপরে এটা জোয়ারের মতো ছড়িয়ে পড়লো। ডেনিস লেস্যু, বাচ্চারা, এই তো সে, ডেনিস লেস্যু, সেই গ-মুর্খ, গীর্জার বেদীর সেই খারাপ মেয়েটি, উপায় নেই কোন, আমি তোদের সবার চেয়ে ভালো করেছি। সেই কণ্ঠস্বর জোরে আর দ্রুত বেগে ক্রমানুসারে বাকী নামগুলো পড়তে থাকে, আমার প্রয়োজন নেই ওগুলো শোনার, আমি যা শুনতে পাই তা হলো নিজের ভেতরেই আমার নিজের নামের প্রতিধ্বণি, উষ্ণ আর জীবন্ত এখন। মারা খা, হারামি বেকুবের দল। আরো ডিকটেশন, আরো যোগবিয়োগ গুণভাগ, আরো তীর, কখনোই ওদের কাছে আমাকে পরাজিত হতে দেবো না! ওরা হয়তো ধীরে ধীরে পোকার মতো বেয়ে উঠবে... সামনে আসার জন্য, আমার উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, আমি তাই আরো আরো বেশি করে স্কুল নামের এই খেলায় প্রবেশ করি।

আমার মা উল্লসিত, সে দোকানের সবাইকে বলতো আমি স্কুলে খুব ভালো করছি। ‘সব কিছুতেই ভালো!’  সে যেন আনন্দ সামলাতে পারছে না, বিস্ময়কর। ‘সে একদম প্রথমবারের মতো ঠিকঠাক করেছে, জানো...’ সে গুরুত্বের সাথে একটা ইঙ্গিতও দিতো ‘ওরা  বলেছে, ও একজন শিক্ষক হবে!’ তখন আমি কাউন্টারের আড়ালে লুকিয়ে থাকতাম যাতে ওরে দেখতে না-পায়, আমি যেন শুনছি তা বুঝতে না পারে। ‘ও কিন্তু লোক-দেখানো মেয়ে না, তোমরা এমন ভাবতে পারো... কিন্তু ও এই সব কিছু নিজে নিজে করেছে, ওকে কারো কিছু বলতে হয়নি।’’ এটা সব সময়ই ওদেরকে পীড়া দিয়েছে যে আমি অহংকার করিনি, বড়াই দেখাইনি, এমনকি আমার স্কুলের নম্বর নিয়েও কথা বলিনি। আমার জন্য এটা একমাত্র স্কুলের বিষয়, ক্লাসের বিষয়, অন্যদের দেখানো, শিক্ষককে দেখানো, কিন্তু আমার বাবা মা কিংবা ক্রেতাদের দেখানোর জন্য নয়। তারপরও আমি আমার সম্পর্কে মায়ের কথা বলা পছন্দ করি, নিচু স্বরে, সাবধানী ভঙ্গিতে, তার জন্য স্কুল ছিলো শ্রদ্ধা করার মতো কোন নিষিদ্ধ শহর, কিন্তু তার মেয়ের জন্য, ডেনিসের জন্য এটা ছিলো একটা সুযোগ, ব্যবহার করার মতো সুযোগ। আমার নাচতে ইচ্ছা করে আর হাসতে মন চায়, যখন আমি তার কিছু কিছু কথা শুনি। আমি স্কুলকে শ্রদ্ধার উপযুক্ত কিছু মনে করি না এবং আমার মনে হয় না যে আমি বিশেষ সুযোগ প্রাপ্ত।

ওগুলো সুখের দিন ছিলো, ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত, যখন আমি দুটো জগতে যাতায়ত করতাম, আর কোন রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই একটা থেকে আরেকটাতে যেতে পারতাম। যতোক্ষণ তুমি এটা ঠিকঠাক করো, শপথ বাক্য শব্দ আর অনুরণনের শব্দ বাড়ির জন্য রেখে দাও, যা আমাদের ধূসর-সুবজ ঘরের কোণাটার মতো, আমি চেষ্টা করি যেমন প্যানের তলায় আটকে যাওয়া ক্যাসোলের  শেষাংশ তুলে আনতে চেষ্টা করি তেমন। আর স্কুলে, আমি এমন ভান করতাম যে আমি মনে করি যা আমাদের শেখানো হচ্ছে তা যথার্থ এবং গুরুক্বপূর্ণ, শিক্ষকদের কৌতুকে হাসতাম, পঁমের গল্প, র্যামি আর কোলেটের গল্প, কারো নির্বোধ মার্কা কথাতেও ভয়ে খাবি খাওয়ার ঢং করতাম, যদিও আমি এইসবকে মোটেও পাত্তা দিতাম না আমি। তুমি যে আলাদা সেটা দেখাতে যেও না। এই পন্থায় তুমি ওদেরকে বেকুব বানাতে পারবে। 
আমি একটা সুখি সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পেরেছি বহু বছর। একটা দ্বিচারী আচরণ, শেষের ক্লাসগুলোর শুরু পর্যন্ত, পরিমিত সহজ ভঙ্গিতে...পাশাপাশি দুটো পৃথিবী বেশি কোন সমস্যা ছাড়াই চলেছিলো। স্কুল আর বাসা, আমার বাবা যে মুখ নিচু করে তার স্যুপ খায় গবগব করে, আর মাস্টার মশাই, গর্বিত আর আরোপিত একটা বন্ধুত্বের ভান করে তারা সব কিছুকেই বন্ধ করে দিতে পারে। বাকী মেয়েরা টানা ইলাস্টিক আটা পোশাকে পরে আর বাড়িতে আমার বন্ধুরা ঢিলা প্যান্টিতে, ছেঁড়া ঝুলে পরা বুকের কাছে খোলা কিনারা দেয়া কাপড় পরে। 

স্কুলে আমরা সবাই একসাথে ক্লাস থেকে ক্লাসে যাই। অন্যরা সনাক্ত করতে পারে যে আমি ভালো মার্কস পাই আর ক্লাসে সেরা। সেই জ্ঞান আমাকে উষ্ণ, মুক্ত, সুরক্ষিত অনুভূতি দেয়। আমি ছিলাম ছোট্ট রাজরাণী। শিক্ষকরা আমার সবকিছুকে ক্ষমা করে দেয়, খাবার ব্যবহার, দেরিতে আসা, ক্লাসে কথা বলা, সব কিছু, কারণ আমি দশে দশ পাই আর আমার পড়াটা সবসময়ই জানি। আড়ষ্ঠ-ঠোঁটের মাস্টারনি সে যথাবিহিত উলোট পালোট করে। আমি তার ব্যাখা শোনার প্রয়োজনও বোধ করি না, আমি নিশ্চিত যে তার কথা না-শুনেই আমি আমার কাজ করতে পারবো। অন্য মেয়েরা উসখুশ করে, খাতায় আঁকিবুকি কাটে, ইরেজার, পেন্সিল শার্পনার আদান প্রদান করে, আর আমি সব সময় আমার প্রিয় খেলাকে প্রশ্রয় দেই। আমার কল্পনায় আমি ওদের সবাইকে বদলে দেই, অদলবদল করি, কারো চুলের নকশা একদিকে বদলে দেই, তো কারো পোশাক বদলে দেই, আমি জেনকে একটা বালকে রূপান্তরিত করি আর রোসেলিনকে- যে কিনা স্কুলে দিন দিন খারাপ থেকে খারাপ করছিলো, বেচারীকে আমি আরেকটা বালক বানিয়ে নেই কল্পনায়, ভীষণ চকচকে সোনালী চুলের। আমি স্বপ্ন দেখি কেমন হতো যদি স্কুলটা সহশিক্ষার হতো... আমাদের পড়ার ডেস্কটা বড়ো হতো, টেবিলগুলোও, বেঞ্চের বদলে বিছানা থাকতো। আমার খাবার দাবার ক্লাসরুমে আনা হতো। আমি আর বাড়িতে যেতাম না, আমরা সবাই একসাথে বড় হতাম সবকিছু চোখের সামনে আর আমাদের শিক্ষকরা অব্যর্থ নির্দেশনা দিতো, ক্যালকুলাস আর পাটিগণিতের ঘুমপাড়ানি সুরে আমরা ঘুমাতে যেতাম, কোন ছেলের মাথাকেই বালিশ ভেবে ঘুমিয়ে পড়তাম সন্ধ্যায়। তরুণ ছেলেদের মুখ রাত্রিরে ফিরে আসতো, হাত এলোমেলো চলতো নাইট গাউনের ভেতরে... অন্যরা যদি জানতো আমি কী সব ভাবি... কিন্তু এমনকি নিরবে চ্যাটচ্যাটে অপরাবোধও কম ভারী হয়ে ওঠে যদি তুমি ভালো নাম্বার পাও।

কেবল আমিই জানতাম সেই সব গোপন জিনিস আমার বাড়ির সঙ্গীরা মেয়েরা যে সব উন্মোচন করেছে বাথরুমে কিংবা দেয়ালে আঁকা ছবিতে। অন্য মেয়েরা বিস্ময়ে হতবুদ্ধ হয়ে যেতো মারিয়া গোরেত্তির’র গল্প শুনে। আমি অনেক বন্য স্বপ্ন দেখতাম, অসতী সব স্বপ্ন, ওই বোকা মেয়েটা কেন চুমু খেতেও অস্বীকার করেছিলো। কোনভাবেই ঈশ্বরর আমাকে ভালোবাসবে এমন কোন উপায়ই নেই। ফার্স্ট গার্ল এখানে লাস্ট। দোকানদারের মেয়ে লেস্যু, পুরুষ দ্বারা পরিবেষ্ঠিত যারা অঝরে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়, একটা খারাপ মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত তার প্রথম কনফেশনে আর আবার ক্লাসেও ভালো ছাত্রী, তার জন্য কোন আশা নেই... আমি টার্মস পরীক্ষায় বেশ ভালো করি, আসলে যথেষ্ট গর্ব বোধ করি, আমি আমি যদি চাইতাম তাহলে আমার কথিত ফিটফাট আর যথার্থ সহপাঠীদের সামনে কেলেঙ্কারি ঘটাতে পারতাম, যত্তোসব নষ্ট প্রেয়সীর দল। 

আমি যা জানি তার সব কিছু একদম ক্লাসের সামনে উন্মোচন করতে পারতাম, সেই সব জিনিস যা কয়েক বছরে আরো রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিলো, সেই সব জিনিস যাদের অস্তিত্ব ওদের সন্দেহের মধ্যেও ছিলো না। কোন কোন ক্ষেত্রে, আমি জানি আমার ঊরু বেয়ে উষ্ণ রক্ত বয়ে যায়, রক্তের দাগমাখা কাপড়, চিলেকোঠায় একটা পেরেক থেকে তা ঝোলে, শক্ত, লাল দাগ আমার পেটিকোটে। একটা গুপ্তধনের মতো, যা আমি একা উপভোগ করি, বালক আর বালিকাদের মুত্রের মিশ্র গন্ধ, হালকা হাতেরএকটা চুলকানি স্পর্শের আরাম দেয়... আমি পাশের মেয়েটার ব্লাউজের দিকে চুপেচুপে দৃষ্টি দেই, ছোট্ট দুটো বিস্ময়কর টিলা সেখানে আটকে আছে, বিশাল ইভলিন একদিন আমাকে স্বাগত জানায়, তার কম বয়স্ক বন্ধু, আমাদের দুজনেরটার পার্থক্য নির্ণয় করতে, আমি আমার আঠালো আঙুল নিরবে সরিয়ে নেই। আমি লজ্জিত ক্লোপার্টের কুঠুরিতে যে গোপন খেলা খেলেছিলাম গত গ্রীস্মে আলোময়, মরচে পরা পরিবেশে তার সঙ্গে স্কুলকে গুলিয়ে ফেলার জন্য। যে স্কুলকে আমি মনে করার চেষ্টা করি একটা নিঁখুত জগত হিসেবে, যেখানে আমিও ভান করি নিঁখুত হওয়ার, এ পরিবেশ সেই কুঠুরি আর আমাদের দোর গোড়ার কাছের গোলাপি পুলের পাশে বমি করা মাতালের থেকে আলাদা... আমি অন্য জগতকে আমার মাথায় করে, আদর্শ হিসেবে নিয়ে আসছিলাম... অথচ শুরুতে আমার মাথায় আদর্শ হিসেবে ছিলো জোয়ান অব আর্ক, তারপর অভিজাত ফরাসীরা, রাজা ডেভিড, সেন্ট লুই... আর ভূগোল পাঠদানে শ্রেণীকক্ষ যেন সরে সরে যায়, যেন একটা বড় কাফেলা যাত্রা করছে, শহর গ্রাম পেরিয়ে, লোয়া নদীর  উৎসে যেখানে আল্পস পর্বতে তার জন্ম হয়েছে, সাহারা মরুর বালু এসে যেন আমার চোখে লাগে... আসলে কোন উপায়ই ছিলো না যে শিক্ষকদের শব্দগুলো স্বয়ং আমার মনে বিনা বাধায় ছাপা হয়ে যেতো, এমনকি তাদের বলার ভঙ্গিও আমার স্মরণে থাকতো, সেই সব শব্দ আমাকে নতুন দিগন্ত খুলে দিতো, আমি ভুলে যেতাম দোকানে আসা লোকদের কাদাময় পায়ের ছাপ, খাওয়ার সময়কার বকবকানি, অপমান সব দূরে সরে যেতো... আমার তরফ থেকে এখানে কোন চেষ্টাই করতে হতো না, শব্দগুলো, ছবিগুলো একটার পর একটা আসতো আর আমি তাদের অনুসরণ করতাম... আবার আমি যখন দোকানে ফিরতাম আমি এর সব কিছুকে মন থেকে মুছতে পারতাম না। আমি মেঘের প্রেমে পরেছিলাম, সন্ধ্যায়, একদিন যখন বাড়ির কাজ করছিলাম, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কাঠুরিয়াদের, ই-িয়ানদের গ্রাম, গোলাপি রঙে স্নান করা, আর সিংহরা যেন আসছে তীরের পাশে শান্তভাবে জল খেতে। 

তবে ততোদিনে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার আমি করে ফেলেছিলাম, যা আমাকে সব সময় অনুসরণ করতো, আমাকে জোর করে আমার বাইরে নিয়ে যেতো, আমার চারপাশের জগতকে হাওয়া করে দিতো, তা হলো বই পড়া, ব্যাকরণ আর শব্দ ভা-ারে ভরা বই। আদর্শ শিশুরা, সব সময়ই এক ভাই এক বোন, হলরুম সহ বিশাল বাড়ি, একটা লিভিং রুম, একটা বাথরুম, এক ঐকতানে বসবাস, স্নানের নির্দিষ্ট সময়, ডিনার পরিবেশন করা হয়েছে, বাবা হলো একজন ব্যবসায়ী আর মা এক সুন্দরী গৃহবধূ... তারা তাদের বাচ্চাদের বলে ‘ডার্লিং’ খুব মিষ্টি করে ডাকে আর বাচ্চাগুলো বলে খুব সুন্দর ছোটখাটো এক বৃদ্ধাকে বলে, ‘ধন্যবাদ গড মাদার’। দিনের কাজকে কেউ সন্ধ্যায় টেনে নিয়ে যায় না, কেউ ঝগড়া করে না আর কেউ মাতলামি করে না। বইয়ের ভাষা আমাদের ভাষা না, এটা তাদের কাছে অসাধারণ, যে সব বাগধারা তোমাদের সতর্ক করে তা এক সম্পূর্ণ আলাদা জগত। রেমি’র মা, ‘বিদায়ের অনুমতি দিন’ তাদের বন্ধুদের সাথে এই ভঙ্গিতে কথা বলে। আমার মা এই রকম দৃশ্যে একদম বেমানান, আমার বাবা তো এমন করে কথাই বলতে পারবে না। তারা বরং দুজচারজনের সঙ্গে খুব ব্যক্তিগত ভঙ্গিতে আলাপসালাপ করে, প্যাঁচাল পারে আত্মীয়, সঙ্গীজন কিংবা স্বজনদের সঙ্গে। সেইসব শব্দগুলো আমাকে আকৃষ্ট করে, আমি ওদেরকে আয়ত্ব করতে চাই, আমার সঙ্গে রাখতে চাই, আমার নিজের লেখাতেও রাখতে চাই। আমি ওগুলো আমার নিজের জন্য রাখি আর একই সঙ্গে আমি যেন বইগুলো যে সব বিষয়ে বলে তাদের সব কিছুর সঙ্গেই কথা বলছি আমার মতো করে। আমার নিবন্ধ সমূহে একটা কল্পনার ছাপ আছে যাতে মনে হয় ডেনিস লেস্যু পুরো ফ্রান্স ঘুরে এসেছে- আমি তো র্যুয়ে  কিংবা লে হাভ্রে  থেকে বেশি দূর যাইনি, যারা সিল্কের অর্গান্ডি পোশাক, সিল্কের দস্তানা, তুলতুলে গাউন পরে, কারণ এইসব জিনিস বইতে ছিলো যা আমি পড়েছি।

আমি অন্যদেরকে আমার বানানো গল্প থামাতে দিতাম না, আমি এই সব গল্প আবিষ্কার করেছি যাতে আমার জগতের চেয়েও সুন্দর, নিঁখুত, ধনী শহরে থাকতে পারি। একটা শব্দের জগত, আমি বইয়ে পাওয়া শব্দগুলোর প্রেমে পড়েছিলাম। আমি সেগুলোকে হৃদয় দিয়ে আয়ত্ব করেছিলাম। আমার মা আমাকে একটা ‘লারুস অভিধান’ উপহার দিয়েছিলো, এর মাঝখানে ছিলো গোলাপি পৃষ্ঠা আর মা খুব গর্বের সঙ্গে শিক্ষকদের বলেছিলো আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই অভিধানে নাক ডুবিয়ে রাখি। আভিজাত্যে ভরপুর! অপরিচিত শব্দ, ভঙ্গুর, ভারহীন, দারূণভাবে সাজানো, যেগুলোকে জোরে শব্দ করে পড়লে আমার কাছে সত্যিকার মনে হতো না। অবিশ্বাস্য, এটা বুঝতে হলে তোমাকেও এটা করে দেখতে হবে। বলা যায় যে, বর্ণিন বেচারাতো এটা চেষ্টা করার সাহসও পায় না। অভিভূত, আমি অভিভূত হয়েছি, যদিও বাড়িতে কেউ বুঝতে পারে না আমি কী বলতে চেয়েছি... সেই কারণেই আমি আমার নতুন শব্দগুলোকে কেবল লেখাতে ব্যবহার করি, আমি তাদেরকে কেবল সেই আকৃতি বা গঠন দেই আমার পক্ষে যা জানা সম্ভবপর। আমি নিজে সেইগুলো কথা বলায় ব্যবহার করতে পারিনি। ‘ভালো ফলাফল সত্ত্বেও মৌখিক অভিব্যক্তি প্রকাশে সে দূর্বল’ আমার রিপোর্টে এমন কথা লিখতেই অভ্যস্ত ছিলো ওরা... আমি দুটো ভাষার মধ্যে নিজেকে বহন করি, একটা হলো কালো অক্ষরে ছাপা বইয়ের ভাষা যা গৌরবান্বিত ঘাসফড়িংয়ের মতো, বিপরীতভাবে, স্থূল, তেলতেলে, ভারী সব শব্দ যা তোমার পেটের মধ্যে, মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটা করবে, তোমাকে কাঁদাবে সিঁড়ির উপরে বিস্কুটের কৌটা সহ কাঁদাবে, কিংবা হাসাবে কাউন্টারের তলায়... ‘ক্রুব্ধ পিতা তিরস্কার করিলেন তাহার পুত্রকে’- ভাষা ও ব্যাকরণের বইগুলোতে এমন বাক্য লেখা থাকে, এর কোন মূল্য নাই, বরং বলা যায়, ‘ওই পিচ্চি ফাজিল শয়তানটা কাস্টমারদের ওখান থেকে চীজ চুরি করেছে বলে পিটানি খাইছে!’ আর দোকানটা অন্ধকার হয়ে ওঠে, আমার মা চেচাতে থাকে... এইসব হলো একমাত্র সত্যি জিনিস, যা তুমি সর্বত্র অনুভব করো, এমনকি দু’পায়ের মাঝেও... সারা রাত গোলাপী কুকি খেয়ে আমি বমি করেছি, আমার মা অন্ধকারে ফিসফিস করে বলেছিলো, ‘কিছু পিপারমেন্ট পান করো, এটা তোমার বমি ভাব কমাবে।’ বোতলের ভেতর বোতল ব্রাশগুলো ঘষতে ঘষতে আমার বাবা বললো, ‘সব বের করে দাও এখানে, খুকি!’

একটা উষ্ণ আরাম অনুভূতি, ‘নিজেকে ছুঁয়ো না, তুমি কানা হয়ে যাবে।’ পূজারী, পেট পূজা, পেটের পীড়া, অভিধান থেকে শব্দ আওড়ে যাওয়া ছিলো বেশ একটা খেলা আর এমন ভাব করা যে এ ভাষা এক কাল্পনিক দেশের ভাষা...  এ ছিলো এক অবাধ স্বেচ্ছাচার, অন্য জগতে প্রবেশের এক গুপ্তমন্ত্র। কিন্তু সেটা আমার অংশ ছিলো না, কখনোই যথার্থভাবে আমার অংশ হয়নি, আমি তো এক আলুথালু শস্তা বেশ্যা, যেমন আমার মা বলবে, যদি জানে যে আমি পা দুটো ফাঁক করে রেখেছি কোন এক বুড়ি ডাইনীর স্পেকুলামের  সামনে, এইসব শব্দ আমার  ব্যবহার করা উচিত, বর্নিন, জিদ কিংবা ভিক্টর হুগোর শব্দ আমাকে ব্যবহার করা মানায় না। আহা, আমি কেমন গিলেছিলাম গল্প, উপন্যাস, সাহিত্যকে... আমার বাবা-মায়ের ব্যবহার করা শব্দ, কোন এক বিচিত্র উপায়ে পশ্চাতে ঘুরছে, যেগুলোকে আমি এড়িয়ে চলতাম কিংবা ভুলে গিয়েছিলাম, কোন অর্থ ছাড়াই, লক্ষ লক্ষ অন্য শব্দের আড়ালে চাপা পড়া, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়কার হলুদ ব্যাকরণ বই, তারপর ‘লিসেট’, ‘ব্র্যাভ সোল’, এই সব বইয়ের পুরো সংগ্রহ, ভূমিকা আর টীকা টিপন্নী সহ কতো বই, পেপারব্যাক ক্লাসিকগুলো, ‘লেগার্দে’ আর ‘মিকার্ডে’র সিরিজ বইগুলো, এগুলো সব চারপাশ থেকে ঘিরে ছিলো। আমি এখন আর আমার নিজস্ব শব্দ খুঁজে পাই না, সত্যিকারের শব্দগুলো। যা আমি স্কুলে শিখেছিলাম, বইতে শিখেছিলাম, সেই সব আর আমার কোন কাজেই লাগে না এখন, হালকা হওয়ায় ভেসে গেছে সে সব, চোখে ধূলা, ধুর! 

‘এই খুকিটা, বরাবরই বইয়ে নাক ডুবিয়ে রাখে!’ আমার বাবা কাস্টমারদের আমার সম্পর্কে এমনই বলতেন। এর কোন উত্তর না দেওয়াটাও সন্তোষজনক ছিলো, বাইরে থেকে বরং দুটো চেয়ার টেনে আনতাম, একটায় বসতাম, আরেকটায় আমার পা রাখতাম আর নাস্তা রাখতাম আর নিজেকে আরামদায়ক রাখতাম সত্যিকারের ডেনিস লেস্যুরের সঙ্গে মানানসই হতে, নতুন ডেনিস লেস্যু, ডে কিনা ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হওয়া নির্বাচিত আদর্শ স্বর্ণকেশী শিশুদের বন্ধু। আমি সবখানে যেতাম আমার স্বপ্নের নায়কদের সাথে, আমি ওদের ছায়ায় বসবাস করতাম। যে সময় আমার পাউরুটি থেকে মাখন চেটে নিতাম, ছড়িয়ে দিতাম সেই মুহূর্তেই, আমি আমার নায়িকাদের সাথে মিলিত হওয়ার উপায় বের করে ফেলতাম। আমি চোখ বন্ধ করতাম, আমার রুটি আর মাখন খেতাম, কিন্তু সেটা ইতোমধ্যেই ঠা-া মুরগির মতো হয়ে গেছে আর আমি মনে মনে সেই নাস্তা খাচ্ছি যা আমার স্বপ্নের নায়িকা খাচ্ছে। তবে আমার সত্যিকারের পছন্দ ছিলো ট্র্যাজেডির নায়িকারা, কারণ ওদেরকে তখন আমি দোকান থেকে ক্যান্ডি এনে দিতে পারতাম আর আমার উষ্ণ বিছানায় ঠাঁই দিতে পারতাম। গল্প ফুরিয়ে গেলেও ওদেরকে ছেঁড়ে যাওয়া সহজ ছিলো না আর কেউ কেউ আমাকে মাসের পর মাস অনুসরণ করতো। আরো ভালো ছিলো, সেই নায়িকার নিরব সঙ্গী হয়ে যেতাম আমি। রিপোর্টার জেন আটকা পড়ে আছে আলপাইন পর্বতমালার এক গ্রামে, সে কৃষকদের সাথে অতি সামান্য খাবার ভাগ করে খাচ্ছে, গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যা আসরে আসছে তাদের লণ্ঠন দোলাতে দোলাতে আর সে দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটা তক্তায় ঘুমিয়ে পড়েছে, ভয়ঙ্কর চিৎকারের মধ্যে, যেমন চিৎকার আমি শুনতে পাই প্রতি রবিবারে কাস্টমারদের টাকা শোধ করার দিনে। কিংবা ক্ষুধার্ত কসেটের  ভাগ্যে জুটেছে একটা আন্তরিক ভোজ, তার বরফ জমা পা দুটোকে আগুনের পাশে উত্তপ্ত করার সুযোগ পেয়েছে, তাকে গ্রহণ করেছে এক আন্তরিক হৃদয়ের পরিবার যার নাম লেস্যু পরিবার, যারা তাকে নিজের কন্যার মতো যতœ নিয়েছে। যখন আমার বয়স দশ, স্যুজেট সাপ্তাহিক পত্রিকায় ‘ট্রু কনফেশন্স’ -এর গল্পগুলো ছাপা হতো। তাদের ঠোঁট স্পর্শ করতো একে অপরকে এবং তারা একে অন্যের বাহুতে এলিয়ে পড়তো। একই ভাগ্য দেখা যায় আমার সব নায়িকাদের ক্ষেত্রেই যখন আমি তাদের কথা ভাবি রাত্রিরে বিছানায় শুয়ে। কিন্তু তারা শুদ্ধ, সতী, আমার মতো নয়... সুন্দর সব গল্প যার মধ্যে আমি লুকিয়ে থাকতাম... যতোক্ষণ না আমি সচেতন হয়েছিলাম, লেখকের কোন অস্তিত্ব আমার কাছে ছিলো না, সে নেহাত এমন এক লিপিকর যে কেবল লিখে যাচ্ছে সত্যিকারের মানুষের জীবন। আমার মাথা ভরে উঠতো অসংখ্য চরিত্রে সমাহারে, তারা মুক্ত, ধনী এবং সুখী কিংবা বাস করছে গভীর হতাশার মধ্যে, সত্যিকারের ব্যাপার, ছালা মুড়ানো এতিম শিশুরা, পাউরুটির পোড়া অংশ খুটে খায়, ফিরে যাওয়ার মতো কোন লোক নেই তাদের জন্য। আমার স্বপ্নে আমি সবসময় অন্য কেউ হয়ে উঠতাম, প্রতি বৃহস্পতিবার বয়ে যেতাম লিসেট এর রোমান্টিক ভাষায়, আর প্রতি মঙ্গলবারে সুজ্যেটের সঙ্গে আর সেই সব নারী পত্রিকায় যা আমার মা কিচেনের কাপবোর্ডে সসপ্যানগুলোর তলায় রাখতো। আমি ক্রমেই দূরে ভেসে যাচ্ছিলাম... 

দোকান, আমার বাবা-মা নিশ্চিতই বাস্তব হতে পারে না। এক সন্ধ্যায় আমি ঘুমাতে গেছি আর জেগে ওঠেছি একটা রাস্তার পাশের বিছানায়। আমি হয়তো এসে গেছি জমিদার বাড়িতে, ভেতরে একটা বড় ঘণ্টা বাজছে আর আমি হয়তো বলছি, ‘এই তো আমি, আব্বু!’ কথাটা বলছি এক অভিজাত পোশাক পরিহিত ব্যক্তিকে যাকে ঘিরে খাবার পরিবেশন করছেন সুশীক্ষিত খানসামারা। আমি এটা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছিলাম যে র্যু ক্লোপার্টে আমার অন্য জীবনের অনুরূপ নয়, আমার উপরে কিছু রহস্যময় শক্তি বিচার প্রয়োগ করেছে, কিন্তু সেটা পরিচিত মূর্তি বেষ্টিত কোন ক্যাথলিক ঈশ্বর দ্বারা নয়, যারা স্বর্গ আর নরকের ধারণা নিয়ে পাপের বিষয়ে বজ্রাঘাত করছে না। বইয়েরা আমাকে অপরাধী মনে করায় না, নিঁখুত, স্বচ্ছ আমার নায়িকাদের জীবনে দোকান থেকে নানা ঘ্রাণের চিনিমাখানো বাদাম চুরির কোন ব্যাপার নেই, তাদের জীবনে নেই, বুড়ো কিছু মাতালের বিদ্রুপের সামনে আয়নার সামনে ঝাঁকি দিয়ে স্কার্ট তুলে ফেলার ঘটনা। বরং, বিপরীতভাবে, তারা আদর্শ ডেনিস লেস্যুর একটা অস্পষ্ট সীমারেখা টেনে রাখে, সেই একজন যাকে আমি মনে রাখি যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলে। এমনকি আমি ক্যাফের চিৎকার, চেচামেচি আর কোলাহলকে উপেক্ষা করতে শিখে গেছি, সামনে পিছনে টালমাটাল সেই লোকটা তার মনকে বোমার মতো উড়িয়ে দিয়ে ভাবছে কোথায় সে ধপাস করে পড়বে এবার? সেও আমার স্বপ্নে অনুপ্রবেশ করতে পারেনি। কেবল আমার মায়ের অপ্রত্যাশিত মর্মপীড়াদায়ক থাপ্পড়, বাবার সাথে তার তুমুল ঝগড়া, আর যে ক্রেতা কদর্য হয়ে ওঠে আর রান্নাঘরের সবকিছু ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়, এইসব আমার দ্বৈত জীবনকে নিষ্পেষিত করে, হৃদয়যন্ত্রণা দেয়, এটাকে একটা স্থির অবস্থায় এনে দাঁড় করায়। বাকী সব সময়ে আমার ফ্যান্টাসি জগতের রাজত্বই চলে, সকালে আমার কফিতে ‘দ্য রেড ই-িয়ান গার্ল ইন পেদ্রো’র প্রতিফলন দেখা যায়, ছোট্ট অভিবাসী, আর স্কুলে আমি জেন আয়ার , মিস্টা ব্রোকলেহার্স্টের ঘৃণার শিকার, চার্চের, লাঞ্চ টাইমে, অলিভার টুইস্ট  বসে আছে তার জাওয়ের মণ্ড নিয়ে দরিদ্র গৃহে।

নাডিন, ভিবিয়ান, ক্যারোলিনের কথা বলাই হয়নি যারা আমার বাড়িতে আসে যায় যে সব ধারাবাহিক কাহিনী আমি পড়ি তার সাথে তাল মিলিয়ে, তরুণ কিশোরীদের দীর্ঘ শোভাযাত্রা যাদের কাছ থেকে আমি ছিনিয়ে নেই তাদের অভিযানের গল্প যাতে করে তারা আমি হয়ে উঠতে পারে, আমার বাড়িতে আর বিনিময়ে আমি এইসব চেনা পরিবেশ থেকে পালাতে পারি। খানিক পরেই, কোন বই দ্বারা আমাকে প্রণোদিত হতে হয় না, আমি একটা নাম, একটা শহর, একটা পরিবার বানিয়ে ফেলতে পারি নিজে নিজেই। এইখানে আমি প্যারিসে আছি, রু ক্লোপার্টে বসেই হাজির হয়ে গেছি আড়ম্বরপূর্ণ ‘ষোলতম’ পাড়াতেই। প্রত্যেক সকালেই আমি চলে যাই রু দে লা রিপাবলিকে, আমি খোদাই করা পাথরের একটা বড় বাড়ি বেছে নেই, সেই সবগুলোর একটি যেখানে রয়েছে বিশাল আঙিনা আর লেস দেয়া পর্দা। সাড়ে এগারটায় আমার ফেরার সময়, সেখানে আমার বাবা-মা’র লাঞ্চের দাওয়াত পাওয়া অতিথিদের অসংখ্য গাড়ি রয়েছে। আমি দরজা খুলে দেই, ক্রেতারা ঘুরে তাকায়, আমি একটা গর্বিত হাসি দেই সকল বর্গাদার চাষীদের, যেমন আমি ডেইলি’র উপন্যাসে পড়েছি। আমার মা ব্যস্ত কাজের লোকদের খবরদারি করতে,  আমার বাবা লাউঞ্জে বসে আছে, এখন আর কোন দোকান নেই আমাদের, কোন ক্যাফে নেই। আমি শোবার ঘণ্টা বাজার অপেক্ষাই থাকি। ম্যারি আঁতোয়া ড্যুকে , ষোড়শতম নাম, পার্টি, টেনিস, অশ্বারোহন... এমনি আরো কতো কী চলতেই থাকে। 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায় নির্বোধ গল্প বানিয়ে, ফালতু সব ভান করা, উন্মাদের গল্প সব... আমি নিশ্চয়ই সেই বয়সে কেবল তুলনা করতে শিখেছিলাম, আমি নিশ্চয়ই আমার মায়ের সাদা অভারল দেখিনি, যেখানে তলার দিকে গোল হয়ে মরিচার মতো দাগ, ‘ওটা ভিনেগারের’ মা বলতো, কোমরের তলার দিকটায় ধূসর দাগ, ক্যাশ রেজিস্টারের ড্রয়ারটা বেরুচ্ছে, ঢুকছে, বাবা খাওয়া শেষ করে তার ছুরিটা সজোরে নামিয়ে রাখছে টেবিলে, সোজা বাটি থেকে স্যুপ পান করছে, রাত্রিরে জঘন্য মাতালগুলো... 
হয়তোবা কখনোই আমার দুটো জগতের মধ্যে কোন ভারসাম্যই ছিলো না। আমি অবশ্যই একটাকে উল্লেখ্যসূত্র হিসেবে নিয়েছিলাম, যেটা বেশি জটিল ছিলো না। যদি আমি আমার বাবা-মায়ের জগত বেছে নিতাম, লেস্যুর বংশ, সেটা তাহলে নিশ্চিতই জঘন্য হতো, এই বংশের অর্ধেকই রেড ওয়াইনের বোতলে আচার হয়ে ছিলো, সেক্ষেত্রে আমি কখনোই স্কুলে ভালো করতে চাইতাম না, আমি হয়তো কাউন্টারের পেছনে বসে আলু বেচাবিক্রি করতাম, আমি হয়তো কলেজ পর্যন্ত যেতাম না। সামান্যই বিস্ময়কর যে আমি ওই দোকানটাকে, কফিশপকে ঘৃণা করতাম, এর বেচারা ক্রেতারা ধার শোধ করার পর যে চেহারা তাকে ঘৃণা করতাম। আমি অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করতাম, বের হওয়ার কী উপায়? কিন্তু কোত্থেকে, কিসের থেকে বের হওয়া? আমি স্কুলে যাওয়ার পথে অদ্ভূত স্বপ্ন দেখতাম। পৃথিবীর শেষ দিন এসে গেছে, আমি ছাড়া আর পৃথিবীতে কেউ নেই, মনেট আর প্রতিবেশিদের দুয়েকটা ছেলে আর সব বড় বড় বাড়িগুলো, সব বিশাল দোকানগুলো একদম আগের মতো রয়ে আছে... কী আনন্দই না আমাদের হতো!... রত্নভাণ্ডার, প্রচুর কেক, পোশাক আশাক... সারা বাড়িঘর ঘুমে আমি সবসময়ই স্বপ্ন দেখতাম, আমাদের নিজেদের সব স্বপ্ন... এর বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় ছিলো পৃথিবীর শেষ হয়ে যাওয়া। কি স্বপ্ন! ও হ্যাঁ, আমি ইতোমধ্যেই তুলনা করা শুরু করেছি, আমার ক্ষুদ্র পন্থাতেই, আমার জানা ভালো লোক আর অন্যদের মধ্যে, যেখানে আমার পরিবারও অন্তর্ভূক্ত। দুটো জিনিস আমার দুইজগতকে আলাদা করতে ত্বরান্বিত করলো। আমার মায়ের এ ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা ছিলো, কারণ আমার নিজের ভালোর জন্যই, এমন সে সব সময়ই বলতো।

সেই সুন্দর গ্রীস্মের সময় যখন আমি বিছানায় শুয়ে ধীরে ধীরে পড়ছিলাম ‘অনাথ’ উপন্যাসটি বারবার, সময় পার করছিলাম কিংবা আমি দুপুরের ছোট্ট পার্টির জন্য জিনিসপত্র মজুদ করছিলাম, সসেজ, চিনি, বিস্কুট, ডালিমের রসের সিরাপ। নিকটবর্তী বাড়ির দুটো ছেলে, মনেট আরও দুয়েকটা মেয়ে এলো আর খাবারগুলো খেলো, কাপড় শুকানোর আলনার আশেপাশে খেলতে লাগলো, ঘুরতে লাগলো ফাঁকা বাক্সগুলো ঘিরে। আমি ওদের উপর রাজ্য শাসন শুরু করলাম। চুইগাম ফোলানো, মাতাল সাজা, মারামারি করা, আমাদের দূর্দান্ত সময় কাটছিলো। কিন্তু পেছনের আঙিনাটা একসময় ছোট মনে হলো, সূর্য দেয়ালের পেছনে অস্ত গেলো, আমরা অন্য কিছু করার কথা ভাবছিলাম। আমরা রু ক্লুপার্টের গলির দিকে গেলাম। বেশি না, শত গজ দূরে, আমরা একটা ছোট্ট গোলাপের ঝাঁড়ের কাছে এলাম, সেটাকে ঘিরে আছে ছোট ছোট অসংখ্য ফুল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এগুলোকে কাগজের কনফেট্টির মতো বানিয়ে উৎসব করে উড়িয়ে দেবো আর ছেলেরা যতোটা পারে ততো কঠিন করে ঝোপগুলোকে ঝাকাতে লাগলো। এক বৃদ্ধা মহিলা নিরবে বেরিয়ে এলো, সে আমাদের দেখলো, সে জানে না আমাদের কী বলা উচিত। সে বলতে থাকলো, ‘হে ঈশ্বর, হে ঈশ্বর আমার!’ এটা হাসির বিষয়, কী এক বিরক্তিকর বৃদ্ধা! আমি ফুলগুলোকে উন্মত্তের মতো টানতে লাগলাম। আমার আঙুলে কাটার খোঁচা লাগলো আর রক্ত বেরুতে লাগলো, আমার পোশাক নোংরা হয়ে গেলো। সন্ধ্যার বাতাসে আনন্দ আর লড়াইয়ের ঘ্রাণ। ‘হারামজাদা, নির্বোধ!’ সে মাত্র বেরিয়ে এলো, ছেলেরা যতোটা জানে ততোগুলো গালিগালাজ ঝারতে লাগলো, নির্বোধ মাগী, বস্তাপচা বুড়ি মারানী, তখন সে দ্রুত ভেতরে চলে গেলো আর দরজায় খিড়কি টেনে দিলো। সে জানালা দিয়ে তার কুতকুতে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো আর অকস্মাৎ সে তার বিশাল লাল জিভ বের করে আমাদের ভেঙালো... 

আমরা ওকে একা রেখে চলে গেলাম, বিজয়ী বেশে বাড়ি ফিরলাম, চারিদিকে গোলাপের পাঁপড়ি, আমাদের ঘাড়ের নিচে, আমাদের কাপড়ে, আমাদের বেল্টে। মিশেলের পায়ে লম্বা ধূসর দাগ, প্যান্টের নিচ থেকে নোংরা জুতা পর্যন্ত চুইয়ে চুইয়ে নামছে সে রেখা। তার শার্ট ঝুলে পড়েছে। সে মেয়েদের ধাক্কা দিচ্ছে, চিমটি দিচ্ছে আর চুল ধরে টানছে। ‘থাম বলছি!’ মনেট গজগজ করে। ‘চলো ওরে ন্যাংটা করি!’ মিশেল কিছুই বললো না তবে সে আমাদের সঙ্গে মনেটেদের রান্নাঘরে এলো। অন্ধকার ঘরে তার পাগুলো কালো দেখালো, মনেটের মা ইতোমধ্যেই সাটার বন্ধ করে গিয়েছিলো। আমরা ওকে হেচকা টানে বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেললাম, হাত বাঁধলাম, সে নিজেই মেঝেতে শুয়ে পড়লো, ছোট্ট পিতলের বালতিটার পাশে যেটা স্টোভ থেকে চুইয়ে পড়া গরম জল ধারণ করে। আমরা ওকে একদম নিচে গেঁথে ফেললাম, আমাদের কনুই ওর পেটে ঠেকা দিলাম, ওর হাফপ্যান্ট খুলে ফেললাম। খালি পেট। সে নড়ছে না। একটা নিস্তেজ ছোট্ট জেলি ফিস, শুকনো, জীবন্ত জীববিদ্যা পাঠ করতে লাগলাম, খোঁচা দিলাম আর দেখলাম, হাত ভর্তি তুলতুলে মাংস যেন... আমাদের হাত একসাথে ওটার উপরে, ‘দেখো, তোমরা নরকে পুড়বে!’ হাত সরিয়ে নিলাম, আরো নিচে নিলাম, দেখতে চাইলাম এটা কতো ভারী, একটা খেলনার মতো একে পরীক্ষা করতে থাকলাম। ওই জেলিফিসটা জীবিত হয়ে উঠলো, বাড়লো, ফুসে উঠলো, শক্ত হলো, সাদা চামড়ার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেলো। দম বন্ধ প্রায়, খোলা মুখ... ‘আমি এর উপরে কোনটাকে দিতে পারি!’ পাশাপাশি তরবারি যাচ্ছে যেন, মনে রেখো সেন্ট মারিয়া গোরেত্তির কথা! ‘আমার আম্মা আসতেছে!’ মিশেল দ্রুত তার প্যান্ট পড়ে, মনেটের মা কিছু দেখে ফেলবার আগেই, কিন্তু তারপরও মনেট একটা চড় খায়, কারণ সে গরম জলের বালতিটা উল্টে ফেলেছে। মিশেল শিস দেয় ‘মা পিত্তে ফোলি’  নিজের উদ্দেশ্যে।

আমি একা বাড়ি যাই, আমার হাতটা ভারী বোধ করে পুরো মাংসের দলায় ডুবে যাওয়া, নরম আর শক্ত, ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ার গতি, আবার শুরু হওয়া, আঙুলগুলো জড়িয়ে আছে, আমার মগজে ছবিগুলো ভাসতে থাকে। আমার মা আমার জন্য দরজাতেই অপেক্ষা করছিলো। সে হামলে পড়ে, আমাকে মারতে থাকে, এ কোন সার্কাস! ‘শয়তান মেয়ে! কি বাজে একটা মেয়ে! আজ তোকে শিক্ষা দিবো! দেখ কী করি!’ কি করে সে মিশেলের ব্যাপারটা জানলো? পাঁচ মিনিট পর অবশ্য আমি জানলাম সেই ছোট্ট গোলাপের ঝাঁড়ের বুড়ি শয়তারটা আমাদের দোকানে এসে বিচার দিয়ে গেছে, সে পুরো কাহিনীটাই বলেছে, সে মাদাম লেস্যুকে বলতে এসেছে কারণ ডেনিস প্রাইভেট স্কুলে পড়ে এবং তার আরো ভালো শিক্ষা হওয়া উচিত ছিলো...  (চলবে)

নোবেলজয়ী আনি এরনোর উপন্যাস: ৮ম পর্ব                          

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়