ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

৬ কিলোমিটার এলাকায় নেই স্কুল, শিক্ষাবঞ্চিত ৫ শতাধিক শিশু

রুমন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১২, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৫:২৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০২১
৬ কিলোমিটার এলাকায় নেই স্কুল, শিক্ষাবঞ্চিত ৫ শতাধিক শিশু

বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত কিশোরগঞ্জের শহরতলীর চার গ্রাম। 

দীর্ঘ কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও সেখানে গড়ে উঠেনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে প্রতি বছর শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিশু। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা না থাকায় গ্রামের মানুষজন নিরক্ষরই রয়ে যাচ্ছে। ফলে শিশু শ্রম, নির্যাতন, মাদকাসক্ত ও বাল্য বিবাহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। অবশেষে সরকারি প্রকল্পের সুফল না পেয়ে, গ্রামবাসী নিজেদের অর্থায়নে ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলছেন স্কুল ঘর।

কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের যশোদল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মনিপুরঘাট, বাসুরদিয়া, কাটাখালি ও ব্রাহ্মণকান্দি গ্রাম। প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকার এ চারটি গ্রামে নেই কোনো স্কুল। শিক্ষার অভাবে দিনের পর দিন গ্রামগুলোতে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমন অবস্থায় গ্রামের নিরক্ষরতা দূর করতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় একটি পরিবার। ২০১৪ সালে আলমগীর হোসেন, আবু বাক্কার, আরশাদ আলী ও আশরাফ উদ্দিন তাদের পৈত্রিক ভিটে থেকে ৩৩ শতক জমি স্কুল নির্মাণে দান করে দেন। ‘হারুন-অর-রশিদ আব্দুল হেলিম প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে তৎকালীন শিক্ষাসচিব বরাবর দলিলও লিখে দেন তারা। পরবর্তীতে শিক্ষা সচিবের অনুমতিক্রমে একবছর একটি টিনসেড ঘরে স্কুল পরিচালনা করার পর অর্থাভাবে সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে, প্রায় সাত বছর পেরিয়ে যায়, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থাকলেও স্কুলটিতে পড়েনি কারো নজর। ২০১৪ ও ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প ‘বিদ্যালয় বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে আড়াইহাজার নতুন স্কুল নির্মাণ করা হয়। সে প্রকল্পে স্কুল নির্মাণের জন্য সার্কুলার অনুযায়ী জমির দলিলের ফটোকপিসহ আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যালয় নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ দিয়েও সেটি কেটে নেওয়া হয়। বরাদ্দ করা অর্থ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিটমহলে বিদ্যালয় স্থাপনে যোগ করা হয়। ‘এ যেন মরার উপর খড়ার ঘা’ তবুও গ্রামবাসী আশাবাদী। তাই কেউ নগদ টাকা, কেউ টিন, কেউ পিলার, আবার কেউ স্বেচ্ছায় শ্রম দিয়ে স্কুল নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। ছোট ছোট শিশুরাও নতুন স্কুলে পড়ালেখা করার স্বপ্ন বুনছে। শিশুদের চোখে মুখে নতুন দিনের হাতছানি। তাই তো সারাক্ষণ স্কুল ঘরের সামনেই তাদের খেলার আসর। পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত অন্যান্য এলাকার শিক্ষকগণও দায়িত্ব নিয়েছেন বই সংগ্রহ ও শিশুদেরকে পড়াশোনা করানোর।

পার্শ্ববতী আরজত আতরজান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির বাচ্চু রাইজিংবিডিকে জানান, এ চারটি গ্রামে যুগ যুগ ধরে কোনো স্কুল নেই। আর সে কারণে এখানকার পরিবেশও ভিন্ন। এ গ্রামগুলোকে নিরক্ষতার গ্রামও বলা চলে। সারাদেশে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে একই গ্রামে দুটি করে সরকারি স্কুল। কিন্তু এ গ্রামগুলোতে একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল পর্যন্ত নেই। অথচ পৌরসভার খুব সন্নিকটে এ গ্রামগুলো। তাই তিনি এ এলাকার মানুষের দাবির প্রতি নজর রেখে কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সাংসদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।

কথা হয় গ্রামগুলোর সুবিধাবঞ্চিত কিছু শিশুর সঙ্গে। তারা রাইজিংবিডিকে জানায়, তাদের বাবা-মা এখানে স্কুল না থাকায়, অন্য স্কুলে নিয়ে যায় ভর্তি করাতে। কিন্তু সে স্কুলগুলোতেও আমাদের ভর্তি নিতে চায় না। খুব কষ্ট করে ভর্তি করালেও অনেক দূরের স্কুল হওয়ায় নিয়মিত ক্লাসও করতে পারে না তারা। অনেকেই আবার স্কুলে যেতে না পেরে বিভিন্ন শিশু শ্রমে যুক্ত হয়। তাই এখানে স্কুলটি হলে গ্রামের সকল শিশু একসঙ্গে স্কুলে পড়তে পারবে।

ভূমি দাতা মো. আলমগীর হোসেন রাইজিং বিডিকে বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। অনেক দূর-দূরান্তের স্কুলে আমাদের যেতে হয়েছে। এ চারটি গ্রামে কোনো স্কুল না থাকায় প্রতি বছর শতশত ছেলে-মেয়েরা নিরক্ষর হয়ে পড়ছে। তাছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম ও গৃহ নির্যাতনও বেড়ে যাচ্ছে। এসব চিন্তা থেকে গ্রামের সকলের পরামর্শে নিজেরাই জমি দান করেছি। এখন সবার একান্ত প্রচেষ্টায় স্কুল নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রায় সাতবছরে স্কুল নির্মাণে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প এলো আর গেলো কিন্তু আমাদের দিকে কেউ নজর দেয়নি। এখন আমরা স্কুলটিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করছি।’

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সুব্রত কুমার বণিক রাইজিংবিডিকে জানান, সরকারি নির্দেশনায় এখন আর কেউ ইচ্ছে করলেও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করতে পারবে না। যেকোনো একজন ভূমি দান করবে, সেখানে সরকারিভাবে স্কুল নির্মাণ এবং শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। আর এ স্কুলটির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো কাগজপত্র আমার হাতে পৌঁছায়নি। যদি কাগজপত্র আমাদের অফিসে আসে, তাহলে অবশ্যই সরকারি নির্দেশ মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াসহ সরেজমিনে পরিদর্শন করা হবে।

এদিকে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্কুল নির্মাণ না হওয়ার ক্ষোভ ও আক্ষেপ রয়েছে গ্রামবাসীর। সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্কুলটি ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ লাভ করবে এমন প্রত্যাশাও তাদের। তাই তারা আশাবাদী শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুণ্যভূমি যশোদল ইউনিয়নের এ গ্রামগুলোতে সরকার দৃষ্টি দিবেন।

কিশোরগঞ্জ/বুলাকী

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়